Some Important Website

বাংলা প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট সমুহ

Tuesday, August 23, 2016

৩০।গল্প-অনেক সুন্দর মন মাতানো গল্প।(১ থেকে ১০)

১।দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ ব্যাঙমানবী।

ব্যাঙমানবীদের আমি প্রথম দেখেছিলাম খুব ছোটবেলায়। তখনো আমাদের শহর সেভাবে মজবুত হয়ে গড়ে ওঠেনি। মাত্র কয়েক বছর আগে হয়েছে শহরের গোড়াপত্তন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন চারিদিকে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা চলছিল, তখন আমরা ডজনখানেক পরিবার মূল জনপদ থেকে অনেক, অনেক দূরে সরে এসে এখানে বসতি গড়েছিলাম। পরে লোকমুখে খবর পেলাম, জনপদগুলোও যুদ্ধে গুড়িয়ে গেছে। জীবিত মানুষের সন্ধান পাওয়াই এখন দুষ্কর। নগরীর পর নগরী, জনপদের পর জনপদ শুধুই ধ্বংসলীলা, কোথাও জীবনের সন্ধান নেই। সেই সময়টাতে আমরা সবকিছু ছেড়েছুড়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে চলে আসি বসতি গড়ার জন্য। পেয়েও যাই একটি সবুজ উপত্যকা। একটি ঝর্ণা রয়েছে উপত্যকার ধারে, রয়েছে একটি গভীর কুয়ো। পানির জন্য আমাদের তেমন চিন্তা করতে হয়নি। খাবারের জন্যও না। জঙ্গলে শিকার করে কিংবা ফলমূল সংগ্রহ করে খেতাম আমরা। কেউ কেউ চাষবাষও শুরু করে দিয়েছিল।কিছুদিন পর আমাদের সাথে আরো কিছু পরিবার এসে যোগ দেয়। দেখতে দেখতে জঙ্গলের মাঝখানে অনেক খানি জায়গা উজার করে একটি ছোটখাটো শহর, একটি ছোটখাটো সভ্যতা গড়ে তুললাম আমরা। আমাদের সাথে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এই একটি জিনিসের তেমন অভাব নেই, আগ্নেয়াস্ত্র। যে কোন ধ্বংস জনপদের আনাচে কানাচে চাইলে অনেক অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। তখনই হঠাৎ একদিন ওদের দেখতে পাই আমরা। আমার মা উপত্যকার ধারে যে কুয়োটা রয়েছে, সে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য দড়ি বেঁধে বালতি ছুড়েছিল পানির ভেতর। অমনি ভেতর থেকে অদ্ভুত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ শোনা গেল। মা চিৎকার করে উঠল। আমরা সবাই ছুটে গেলাম তার চিৎকার শুনে। শহরের প্রহরার দায়িত্বে থাকা তরুণ ছেলেরা বন্দুক বাগিয়ে দৌড়ে এল। কুয়োর ভেতর থেকে লাফ দিয়ে উঠে এল একটি অদ্ভুত জন্তু। আমরা কেউ এমন কিছু আগে কখনো দেখিনি। পিচ্ছিল শরীর তার। ব্যাঙের মতো অনেক দীর্ঘ, ভাজ করা হাত এবং পা। কিন্তু মুখমণ্ডল, গলা এক ধরনের মেয়েলী গড়নে তৈরি। এক রকম কলা পাতার আবরণে শরীর ঢাকা তার, যেন পাতার তৈরি পোশাক পরেছে। মাথায় বেশ ঝাঁকরা চুলও আছে। শুধু চোখগুলো টকটকে লাল রঙা। চোখের মনির চারিদিকে সাদা অংশের জায়গায় অদ্ভুত রকম সুন্দর লাল রঙ, যেন মাছের কানকোর লাল। প্রাণীটা আমাদের দেখে সাপের মতো লকলকে, তিন ভাগে চেরা জিভটা বের করে অদ্ভুত রকম ফোঁস ফোঁস শব্দ করল। তারপর তীব্র গতিতে ছুটে পালাল লম্বা লম্বা হাত পা ব্যবহার করে।শহরের সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এমন প্রাণী দেখে। কেউ বাপের জন্মে এমন কোন প্রাণী দেখেনি কিংবা এমন কোন প্রজাতির কথা শোনেনি। শহরে কোন জীববিজ্ঞানী ছিল না। তাই কেউ প্রাণীটা আসলে কি, সে সম্পর্কে কেউ ধারণা দিতে পারল না। দু’জন ডাক্তার ছিল, তারাও এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারল না। সে রাতে শহরে আলোচনা সভা বসল। এই প্রাণীটি নিশ্চয়ই একা নয়, এর মতো আরও আছে এখানে। থাকলে তারা আমাদের জন্য হুমকি কিনা সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। এরা কতটা বুদ্ধিমান সেটাও একটা প্রশ্ন। এদের গায়ে কাপড়মতো কিছু ছিল, তার মানে শুধু বুদ্ধিমত্তাই নয়, সমাজবদ্ধ জীবনও হয়তো তাদের আছে। আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণ হলো পরে। আস্তে আস্তে আমরা আবিষ্কার করলাম, এই প্রাণীগুলো শুধু এখানে না, আশেপাশে সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এবং তারা তেমন বুদ্ধিমানও নয়। আমাদের উপত্যকার পেছনে একটি কচু গাছে ছেয়ে যাওয়া জঙ্গল ছিল। বড় বড় কচুগাছ সেখানে, চার-পাঁচ ফুট হবে। কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আছে কচুগাছগুলো। এই কচুবনে আমরা প্রচুর ব্যাঙমানবী আবিষ্কার করলাম। প্রতিটি কচু পাতার নিচে একটি করে ব্যাঙ। এটাও বুঝতে পারলাম তারা আমাদের জন্য মোটেও হুমকি নয়। তারা চুপচাপ থাকে। পোকা মাকড় ধরে খেয়ে বেড়ায়। জলায়, ডোবাতে কিংবা কোন কুয়োর ভেতর ব্যাঙের মতো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়। তাদের মধ্যে নারী পুরুষ আলাদা আছে কিনা বোঝা গেল না। কারণ সবার চেহারাই মেয়েলী। কেঁচোর মতো উভলিঙ্গ নিশ্চয়ই নই। তবে কোনটা ছেলে, কোনটা মেয়ে সেটা বোঝার উপায় নেই। ব্যাঙমানবীরা যে সুখাদ্য হতে পারে সেটা একদিন শহরের কিছু ডানপিটে ছেলে আবিষ্কার করে ফেলল। তারা শিকারে বেরিয়েছিল সেদিন। শিকার টিকার না পেয়ে শেষে একটা ব্যাঙমানবী ধরে আনে এবং শহরে এসে আগুনে পুড়িয়ে খায়। অদ্ভুত সুস্বাদু নাকি সেই মাংস। ব্যাঙ-মানবীদের মানবী বললেও তারা তো আর মানুষ নয়, হয়তো উন্নত প্রজাতির কিছু ব্যাঙ। তাই দুয়েকজন আপত্তি জানালেও একসময় গা সওয়া হয়ে যায়। অনেকেই ব্যাঙমানবীদের ধরে ধরে খেতে থাকে। একটা ব্যাঙমানবীকে আমার তখন খুব ভালো লেগে যায়। আমি যেখানে খেলাধুলো করতে যেতাম, সেখানে প্রায়ই আসত সেটা। লাফ ঝাপ দিয়ে আমার আশেপাশে ঘুরত। ছোট ছিলাম, একা একা খেলাধুলো করতাম, আমার বয়সী তেমন কেউ ছিল না, তাই ব্যাঙটাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে ভালোই লাগত। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে থাকি, ব্যাঙ মানবীর সাথে আমার বন্ধুত্ব গভীর থাকে। একসময় সে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকত। বাবা মা কিংবা বড় কেউ তেমন কিছু বলত না। ব্যাঙটাকেও কেউ ঘাঁটাত না। শহরে পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল, ছোটখাটো স্কুল ছিল একটা। আর বই ছিল প্রচুর। বড়রা যে যেভাবে পেরেছে, দূর দূরান্তের পরিত্যক্ত জনপদে গিয়ে বই পুস্তক সংগ্রহ করে এনেছে, নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে। সে সব বই পড়ে আমি গণিত, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভূগোল, সমাজ ইত্যাদি শিখতে থাকি। আমার সঙ্গে সেই ব্যাঙমানবীও থাকত সারাক্ষণ। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে ব্যাঙ পোষা শুরু করল, আর সেটাই ছিল কাল। ব্যাঙমানবীরা তুলনামূলক ভাবে অন্য প্রাণীদের থেকে বুদ্ধিমান তা আঁচ করে নিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু এতটা বেশি তা আশা করিনি। আমরা যা শিখতাম, যা করতাম, ওরাও আস্তে আস্তে সব শিখে নিতে লাগল, অথচ আমাদের বুঝতেও দিল না। আগের মতোই শান্ত, নির্বিরোধী, বোকা সেজে থাকত।তারপর একদিন হলো সেই সামরিক অভ্যুত্থান। আমরা যেমন বিভিন্ন পরিত্যক্ত-ধ্বংস জনপদ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আনতাম, বই সংগ্রহ করে আনতাম, ওরাও আনত। আমাদের জানতে দিত না। ওরা নিজেরা সে সব অস্ত্র শস্ত্র পরিচালনা শিখে নেয়। তারপর একদিন আক্রমণ করে বসে। ব্যাঙদের অগঠিত হাত দিয়ে অস্ত্র পরিচালনা সম্ভব সেটা আমরা কেউ কল্পনাও করিনি। সেদিন প্রথম জানলাম। তবে দেরি হয়ে গিয়েছিল, করার কিছু ছিল না তেমন। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করে ওরা, কয়েকশো ব্যাঙ এক সাথে, সাথে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। প্রথমে যতটুকু সম্ভব প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা আমরা করেছিলাম বটে আমরা, তবে সফল হইনি। আমাদের ১৪ বছরের গড়া নগরী ধ্বংস হয়ে যায় একরাতেই। শহরের প্রতিটি মানুষ মারা যায় সে রাতে। সবাই যদি মারা যায় তাহলে এই গল্পটি বলছে কে? কেউ কি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল? না, কেউ বাঁচেনি। এই গল্পটি আমি সেই ছেলেটার মতো করে বলতে চেষ্টা করেছি, যে প্রথম ব্যাঙমানবীদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল। আমি হলাম সেই ব্যাঙ মানবী, যে মানুষের প্রথম বন্ধু, প্রথম পোষ্য ছিলাম।মানুষের পর এই নগরীতে আমরা বসবাস করছি, মানুষের ইন্টেলেকচ্যুয়াল কাজগুলো সব আমরা শিখে নিয়েছি। এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মানুষ যখন আমাদের ধরে ধরে খাওয়া শুরু করল, তখন এটাই বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল আমাদের। শক্তিশালীরা টিকে থাকবে, দুর্বলরা বিলীন হবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।পৃথিবীতে আর কোথাও কোন মানুষ অবশিষ্ট আছে কি না জানি না, তবে তারা যদি কখনো এই নগরীতে আসে, আমাদের সাথে লড়াই করে নগরীর দখল আদায় করতে হবে তাদের। নতুবা পৃথিবী ছেয়ে যাবে ব্যাঙমানবীতে।(সমাপ্ত)
এই সিরিজটা শুরু করেছিলাম বছরখানেক আগে। ঘুমোলে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতাম বলে স্বপ্নগুলো লিখে রাখতাম ঘুম থেকে উঠে। সেখান থেকে গল্প লিখতাম। এভাবে চারটা পর্ব লিখেছিলাম। কাজে এসেছিল লেখাগুলো। আমার দুঃস্বপ্ন দেখা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তখন। আজকাল আবার দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। অনেক রকম দুঃস্বপ্ন। বেশিরভাগই জীবনের নানা ধরনের জটিলতা সংক্রান্ত। তবে কিছু কিছু বেশ ভয়ংকর। যেমন গতকাল স্বপ্নে দেখলাম-একটা পাহাড়ের উপর আমরা কয়েক জন মানুষ বসে আছি, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে প্রচন্ড। পাহাড়ের নিচে মেয়েলী চেহারার বড় বড় কিছু ব্যাঙ কচুপাতার নিচে বসে আছে। আমাদের মধ্যে একজন বলে উঠল-আমাদের খাবার ফুরিয়ে এসেছে, এগুলো খাওয়া যায়। বলেই বল্লম দিয়ে ব্যাঙটাকে গেঁথে ফেলল মাটির সাথে। বাকী ব্যাঙগুলো পালিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেল। ভাবছি সিরিজটা নতুন করে শুরু করব আবার। 

২।দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ শয়তানবিদ্যা।

বৃষ্টির রাতে ভরপেট বিরিয়ানি খাওয়ার পর বেশ ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছিল জিব্রানের‚ ইচ্ছে হচ্ছিল শিয়রের কাছের জানালাটা খুলে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ে‚ কিন্তু বন্ধু পূরব এবং তার স্ত্রী মেহজাবিন বাঁধ সাধল। মেহজাবিন ভালো বিরিয়ানি রাঁধে। সিলেটে যখনই আসে‚ তখনই ওদের বাসা থেকে ঘুরে যায় জিব্রান‚ বলা চলে অনেকটা বিরিয়ানির লোভেই। তাছাড়া চা বাগানের পাশে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়িটাও জিব্রানের খুব পছন্দ। তাই এবার একটা বিশেষ কাজে সিলেটে আসতেই এই বাড়িটাতে ঢুঁ মারার লোভ সামলাতে পারেনি। তারপর রাতে ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর যেই না একটু গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পায়তারা করছে‚ অমনি স্বামী-স্ত্রী ওকে চেপে ধরল। মেহজবিন বলল- "জিব্রান ভাই‚ অনেকদিন আপনার কোন কেসের গল্প শুনি না। এবার শুনব। কোন একটা রোমহর্ষক কেসের গল্প বলেন প্লীজ!" জিব্রান পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট‚ তার জীবনে বেশ কিছু অদ্ভুত এবং গা ছমছম করা‚ গায়ে কাঁটা দেয়া কেস পেয়েছে সে। যখনই ওদের বাসায় আসে‚ তেমন কোন কেসের গল্প বলে। "না মেহজাবিন‚ আজ নয়। ঘুম পাচ্ছে খুব।" "আরে‚ এত কষ্ট করে আপনাকে বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়ালাম‚ এখন একটা গল্প শোনাতে পারবেন না?" "গল্প শোনার লোভে বিরিয়ানি খাইয়েছ বুঝি?" "হ্যা। আপনি যেমন বিরিয়ানির লোভে আমাদের বাড়িতে আসেন‚ আমি তেমনি গল্প শোনার লোভে বিরিয়ানি রাঁধি।" "আচ্ছা। দাড়াও‚ মনে করি কোন গল্পটা বলব।" পূরব পাশ থেকে বলে উঠল- "ভূতের গল্প বল জিব্রান। বৃষ্টির রাতে ভূতের গল্প ভালো জমবে।" "ভূতের গল্প? ভূতের গল্প তো জানি না।" "একটাও না!" "নাহ।" "আধিভৌতিক কিছু?" জিব্রান একটু ভাবল। তারপর বলল-"ভৌতিক কোন কিছু আমি বিশ্বাস করি না। ভৌতিক কোন বিষয় ঘটতে দেখিনি জীবনে। তবে একবার একটা কেস পেয়েছিলাম‚ ঠিক কেসও বলা যায় না‚ আনপ্রফেশনাল হেল্প আরকি! তবে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা সামনে এসেছিল।" পূরব এবং তার স্ত্রী দু'জনেরই চোখ চকচক করে উঠল আগ্রহে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগেও মানুষের ভূত-প্রেত-পিশাচ নিয়ে আগ্রহ এতটুকু কমেনি। কেন কমেনি সেটা গবেষণার বিষয়। পূরব বলল- "বল‚ বল!! সেটাই বল।" জিব্রান লম্বা দম নিল। বলতে লাগল ঘটনাটা। “চাকরী জীবনে ঢোকার পর আমার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেল। গ্রামের বাড়িতে তেমন যাওয়া হয় না‚ গেলেও বছর-দু'বছরে একবার মাত্র। তখন আমি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর ইংরেজিতে দু'টো বই লিখেছিলাম। বই দু'টো বেশ সমাদৃত হয়েছিল দেশে-বিদেশে। মোটামুটি নামডাক হয়েছে‚ পসার বেড়েছে। তখনকার কথা। সেবার শীতকালে বাড়িতে গিয়েছি। আমাদের বাড়ি বরিশালের খুবই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জায়গার নাম চাঁদপাশা। খাল পেরিয়ে যেতে হয়‚ সেখানকার অনেক গ্রামে ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনও। বাবা মা এবং পরিবার পরিজনকে এতদিন পর কাছে পেয়ে বেশ আনন্দ হচ্ছিল আমার। শহরের ধোঁয়াটে বাতাস থেকে মুক্তি পেয়ে মন-প্রাণ ঝরঝরে লাগছিল খুব। গ্রামে আসার পরদিনই পাশের বাড়ির মনসুর চাচা বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিলেন আমাকে। দেশি মুরগি ভুনা করে জম্পেশ আয়োজন করে বসলেন। বাড়িতে চাচার দুই মেয়ে‚ এক ছেলে এবং চাচী থাকে। মেয়ে দু'টোর বয়স একজনের ১৮ আরেকজনের ২০‚ ছোট ছেলের বয়স ১৬; বড় মেয়েটার বিয়ে হবো হবো করছে‚ পরের বার যখন আসব তখন হয়তো চাচার নাতিপুতিও দেখতে পাব। যাই হোক‚ খাওয়া দাওয়া শেষে চাচা আমায় নিয়ে উঠোনে দু'টো চেয়ার পেতে বসলেন। ভাব সাব দেখে মনে হলো কিছু বলতে চান তিনি। আমার ধারণা সত্য হল। চাচা একটা পান চিবাতে চিবাতে বললেন- "শুনছি তুমি নাকি পাগলের ডাক্তার হইছ? রোগী টোগী দেখ?" "জী চাচা ঠিক শুনেছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট হয়েছি। কনসাল্টিং করি।" "সেইটা কি জিনিস?" "মনের রোগ ভালো করার একটা উপায়!" "আচ্ছা! ভালো! তোমারে একটা কথা কইতে চাইছিলাম।" "বলুন চাচা।" "সমস্যাটা হইল মোর ছোড পোলারে লইয়া।" "আপনার ছোট ছেলের কি হয়েছে?" "সেইদিন কি দেইখ্যা জানি ডরাইছে!" "কি দেখে ভয় পেয়েছে?" "ওর মুখ হইতেই শোন।" বলেই তিনি হাঁক ছাড়লেন- "ছালাম‚ বাইরে আয় তো!" ছালাম নামের কিশোরটি বাইরে বেরিয়ে এল। হার জিরজিরে শরীর তার‚ দেখে মনে হচ্ছে অপুষ্টিতে ভুগছে। গায়ে সবুজ রঙের একটা পুরনো জরাজীর্ণ পাঞ্জাবি‚ নোংরা লুঙ্গী। গালে অল্প দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। সে সসংকোচে আমাদের সামনে দাড়াল। চাচা বললেন- "ওর নাম ছালাম। পাশের গ্রামে আমার দোয়ান চালায়। হেইদিন রাইতে কি দেইখ্যা জানি ডরাইছিল। ডরাইছে ঠিকই‚ কিন্তু কি দেইখ্যা ডরাইছে হ্যা কয় না। ওই ছালাইম্যা‚ তোর ভাইজানরে ঘটনা খুইল্যা ক'‚ উনি ডাক্তার।" কিশোর ছেলেটা যেন লজ্জা পেয়ে আরো গুটিয়ে গেল। তার মধ্যে অস্বস্তি‚ বিব্রতবোধ এবং দ্বিধা দেখতে পেয়ে চাচাকে বললাম- "চাচা‚ আপনি ঘরে যান‚ আমার মনে হয় ছালাম আপনার সামনে কথা বলতে চাচ্ছে না।" আমার ধারণাই ঠিক‚ চাচা চলে যেতেই ছালাম নামের ছেলেটার মুখে একটু কথা ফুটল। সে লাজুক লাজুক গলায় তার ভয় পাওয়ার ঘটনাটি বলতে লাগল আমাকে। গুছিয়ে কথা বলতে পারে না সে‚ উচ্চারণ আড়ষ্ট‚ গলায় বরিশালের তীব্র আঞ্চলিক টান‚ তারপরও আমি তার কথাগুলো বুঝতে পারলাম। শুদ্ধ বাংলায় তার কথাগুলো অনুবাদ করলে অনেকটা এমন হয়- "জিব্রান ভাই‚ আমি ভয় পেয়েছিলাম পরশুদিন রাতে। আমি পাশের গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করি। স্কুল শেষে হিসেব-নিকেশের কাজ করি একটা মুদির দোকানে। দোকানে কাজ শেষ হবার পর আমি মসজিদে আছরের নামাজ পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি‚ কখনো কখনো গ্রামের ছেলেদের সাথে আড্ডা দিই । তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরি। সেদিনও ফিরছিলাম। সন্ধ্যার পর খালপার ঘেঁষে রাস্তাটা একদম নির্জন হয়ে যায়। একপাশে খাল‚ আরেকপাশে ধানক্ষেত‚ রাস্তার দু' ধারে উঁচু উঁচু গাছ। জনবসতি তেমন নেই বললেই চলে। কয়েকটা চায়ের দোকান আছে খালপারে। মাগরিবের আযানের পর বন্ধ হয়ে যায় সেগুলোও। শীতের সন্ধ্যা। সেদিন জোছনা ছিল। জোছনার আলোতেও পথঘাট তেমন পরিষ্কার নয়। ঘন কুয়াশায় তিন চার হাতের বেশি দৃষ্টি চলে না। আমি প্রতিদিনই এ রাস্তা ধরে হাঁটি‚ তাই ভয় পাচ্ছিলাম না মোটেও। পনের-বিশ মিনিটের মতো সময় হেঁটেছি‚ তখন হঠাৎ শুনি‚ আমার আশে পাশে কে যেন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে‚ ঘন‚ দ্রুত এবং গভীর নিঃশ্বাস। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম না কাউকেই। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। পাত্তা না দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। তিন কদম সামনে এগোতেই শরীর হিম হয়ে গেল। একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে পথ আগলে। প্রচন্ড সুন্দরী‚ ভরাট শরীর। মেয়েটার শরীর থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। পুরো শরীরে একটা সুতোও নেই তার‚ পুরোপুরি নগ্ন। ঘন এবং দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটা। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢেউ তুলছে শরীরে। প্রথমে আমি ভয় পেলাম। তারপর বোঝার চেষ্টা করলাম মেয়েটা কে এবং এখানে‚ এই অবস্থায় কি করে এসেছে। ভাবলাম‚ কোন পাগল টাগল না তো! হয়তো গ্রামের কোন বাড়ির মেয়ে‚ মাথায় সমস্যা আছে‚ তাই রাত বিরেতে নগ্ন হয়ে চলে এসেছে বাইরে। আমি ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- "আপনি কে? বাড়ি কোথায় আপনার?" মেয়েটা কেমন যেন অস্থির চোখে তাকাল আমার দিকে তাকাল। তারপর বিরক্ত গলায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলল- "কথা কইস না‚ তুই এইহান দা ভাগ। বিরক্ত করিস না মোরে। এহন মোর নাগর আইব। নাগরের লগে পিরিত করমু।" "কে আসবে?" "কানে হুনছে না? মোর নাগর‚ মোর ভাতার।" বরিশালে ভাতার মানে স্বামী। মেয়েটার স্বামী আসবে? আসলেই ভালো। পাগল বউকে ঘরে ফিরিয়ে নেবে। তখন হঠাৎ মনে হলো‚ গ্রামের প্রায় সবাইকে তো আমি চিনি। মেয়েটার স্বামীকেও চিনব হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম- "আপনার স্বামীর নাম কি?" মেয়েটা রাগী চোখে তাকিয়ে বলল- "তুই এহনো খাড়াইয়া আছস? যা ভাগ। মোর নাগর আইলে তোরে মাটির তলে পুইত্যা থুইবে।" "কি নাম আপনার স্বামীর?" "বেলায়েত। বেলায়েত‚ নাম হুনছস?" "বেলায়েত? না তো। কোথায় থাকেন তিনি?" "জাহান্নামে থাকে। যা ভাগ!" এমন সময় হঠাৎ ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোন একটা ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। এবার আমি সত্যিকারের ভয় পেলাম। বুঝলাম‚ ঘটনা স্বাভাবিক নয়‚ অতিপ্রাকৃত কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমি। কাছাকাছি আসতে ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেলাম। ঘোড়াটার গায়ের রং ধূসর‚ কেমন যেন ঝাপসা। মনে হচ্ছিল ঘোড়া ভেদ করে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। এরপর যা ঘটল‚ তাতে আমার জ্ঞান হারানো খুব স্বাভাবিক ছিল। কি করে অতক্ষণ টিকেছিলাম জানি না। তবে‚ জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভয়ংকর কিছু দৃশ্য দেখলাম আমি। ঘোড়াটা কাছে আসতে অশ্বারোহী লোকটাকে দেখতে পেলাম ভালো করে‚ এই পৃথিবীর কোন সৃষ্টি নয় সে‚ অন্য কোন জগতের‚ অন্য কোন পৃথিবীর প্রাণী। তার শরীরটা মানুষের‚ পা দু'টো ইঁদুরের মতো। শরীরের পেছন থেকে সাপের মতো দেখতে একটা লম্বা লেজ বেড়িয়ে এসেছে। ঘাড়ের উপর মাথাটা ঠিক যেন বিড়ালের মাথা; রোমশ মুখমণ্ডল‚ লম্বা কান‚ কিন্তু ঠোঁটটা গরুর ঠোঁটের মতো সুচালো এবং পুরু। সে আসতেই নগ্ন মেয়েটা "বেলায়েত! বেলায়েত!!" বলে চেঁচাতে লাগল। জবাবে গোঙাতে গোঙাতে মোটা-জান্তব কন্ঠে কি যেন বলল প্রাণীটা। অনেকটা গরুর হাম্বা ডাকের কাছাকাছি শব্দ‚ "উম্বু! ঊম্বব্বু!!" এমন। ঘোড়া থেকে নেমেই মেয়েটার উপর ঝাপ দিল সে‚ মেয়েটাকে নিয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ার ভঙ্গীটাও অদ্ভুত‚ কেমন যেন কাত হয়ে‚ পা গুলো বিদঘুটে ভাবে ছড়িয়ে শোয়া। মেয়েটাকে চুমু খেল সে ভয়ংকর প্রাণীটি। গরুর মতো ঠোঁট-জিভ দিয়ে ভয়ংকর ভাবে চুমু খেতে লাগল। মেয়েটা হাসতে লাগল খিলখিল করে। প্রচন্ড বিদঘুটে‚ পঁচা একটা গন্ধ আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। হয়তো প্রাণীটার মুখ থেকে আসছিল সে গন্ধ। অপার্থিব দুর্গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে‚ নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে আসার যোগার। এরপর মেয়েটার গলার বামদিকটা কামড়ে ধরে ধরল বেলায়েত নামের প্রাণীটি। জান্তব আওয়াজ করতে করতে প্রচন্ড কামড় বসাল। ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগল রক্ত। কিন্তু মেয়েটার মুখে কষ্ট পাওয়ার কোন চিহ্ন নেই‚ বরং খিলখিল হাসি আর আর গভীর পরিতৃপ্তির ছাপ তার চেহারায়। ঠিক তখন সেই ভয়ালদর্শন প্রাণীটি জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। প্রচন্ড আতঙ্কে জ্ঞান হারালাম আমি। জ্ঞান যখন ফিরল‚ তখন গভীর রাত। আমি তখনও সেই খালপারেই পরে আছি। জ্ঞান ফিরতেই বাড়ি চলে এলাম দৌড়ে। রাস্তা কম ছিল না‚ কিন্তু পুরো রাস্তায় একবারও থামিনি আমি। বাড়ির উঠোনে এসে প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হলাম ফের।" এ পর্যন্ত বলে হাঁপাতে লাগল ছালাম। একই সাথে ভয় এবং লজ্জা দেখতে পেলাম তার চেহারায়।ছালামের সাথে কথা বলার পর আমি সারারাত ধরে ভাবলাম। বেশ কিছু হাইপোথিসিস মাথায় আসল‚ কোনটাই তেমন শক্ত কিংবা যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। তবে একটা বিষয় পরিস্কার‚ ছালামের হ্যালুসিনেশন হয়েছিল‚ পুরো ব্যাপারটাই ছিল তার ভ্রম। কারণ‚ ঘটনার পরদিন সে খালপারে গিয়েছিল‚ সেখানকার মাটিতে কোন ঘোড়ার খুড়ের দাগ পায়নি সে। রাতে সেই মেয়েটার গলা হতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে দেখেছে‚ কিন্তু পরদিন সেখানে গিয়ে কোন ধরনের রক্তের দাগ-ছোপ পায়নি। এ থেকেই প্রমাণ হয়‚ সে যা দেখেছিল তা ছিল তার বিভ্রান্তি! কিন্তু এমন অদ্ভুত বিভ্রান্তিই বা হবে কেন তার! আমি সারারাত ভেবে অনেকগুলো সম্ভাবনা যাচাই বাছাই করার পর একটা একটা মোটামুটি স্ট্রং হাইপোথিসিস দাড় করালাম। সেটা অনেকটা এমন- মানুষ যখন একা কোথাও থাকে‚ হতে পারে খালি বাসায়‚ হতে পারে নির্জন কোন জায়গায়‚ তখন সে কি করে? খুব কমন একটা কাজ হলো ভয় পাওয়া। একা থাকলে অনেকেরই নানা রকম ভয় কাজ করে। ভূত-প্রেত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে হ্যালুসিনেশন হওয়ার আদর্শ সময় ওটা। কিন্তু সাইকোলজিতে কোন মানসিক অবস্থাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই এটাও উপেক্ষা করা যায় না যে‚ একা থাকা মানুষের‚ বিশেষ করে উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণদের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো‚ নারী সংক্রান্ত চিন্তা করা। ছালাম দীর্ঘদিন ধরে একা একা ঐ নির্জন রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরত। তার বয়স মাত্র পনের-ষোল বছর‚ এ বয়সী একটা ছেলের মধ্যে অনুভূতির তীব্রতা থাকার কথা। কাজেই একা নির্জন রাস্তা ধরে ঘরে ফেরার সময়টুকুতে তার মাথায় নারী-চিন্তা আসাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয় এবং অস্বাভাবিক নয় ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটাও। দু'য়ে দু'য়ে যোগ করলে যেটা দাড়ায়‚ তা হলো- পুরো ঘটনাটা ছিল তার ফিমেইল ফ্যান্টাসি এবং হরর ফ্যান্টাসি জনিত হ্যালুসিনেশন; একটি সুন্দরী নগ্ন মেয়ে এবং ভয়ালদর্শন এক পিশাচ! মানুষের মনের অবদমিত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কোন না কোন ভাবে ঘটবেই‚ ছালামের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। তবে এটা একটা সার্বজনীন এবং সহজ হাইপোথিসিস। আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম‚ তা হলো-ছালাম নামের কিশোরটির মনের ভিতরকার ভয় এবং ফ্যান্টাসির উৎস খুঁজে বের করা। সেই উদ্দেশ্যেই পরদিন ছালামকে নিয়ে আবার বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম- "ছালাম‚ তুমি যে প্রাণীটি দেখেছিলে সেটা ছিল গরু‚ ইঁদুর এবং বিড়ালের সংমিশ্রণ! তুমি কি এই তিনটা প্রাণীকে ভয় পাও?" "জে না। মুই ছোডকাল হইতে গেরামে থাহি। ইন্দুর-বিলয়রে ডরামু ক্যা?" আমি নানা ভাবে প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম যে সে কি কি ভয় পায় এবং সেই ভয় পাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে এমন কোন উপাদান আছে কি না‚ যা থেকে সে রাতের সেই ভয়ংকর প্রাণীটাকে সৃষ্টি করতে পারে তার মস্তিষ্ক। আমি ক্ষান্ত দিলাম তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য বের করতে না পেরে। আমি যেদিন ঢাকা ফিরব‚ সেদিন মনসুর চাচাকে বললাম‚ "চাচা‚ একটা অনুরোধ করলে রাখবেন?" "অবশ্যই রাখব। তুমি এই গ্রামের সবচেয়ে মেধাবী পোলা। তোমার অনুরোধ কি ফেলতে পারি! কি অনুরোধ কও বাবা?" "ছালামকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে শহরের কোন একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। এই গ্রামে পড়ে থাকলে সেটা আরও বাড়বে। শহরে থাকলে অনেক বন্ধু-বান্ধব হবে। জীবনের নানা দিক দেখবে‚ ভালো পড়াশোনা করবে। ওর জন্য এসব খুব জরুরি।" চাচা আমার অনুরোধ ফেলেননি‚ কয়েক মাস পর ছালামকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। আমিই ছালামকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম‚ হোস্টেলে তুলে দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বাসায় এনে ওর কাউন্সেলিং করাতাম। ছালাম এখন কলেজের ছাত্র। বেশ ভালো আছে সে।” স্তব্ধ হয়ে গল্প শুনছিল মেহজাবিন এবং পূরব। জিব্রান শেষ করতেই পূরব চিন্তিত মুখে বলল- “গল্প এখানেই শেষ? তুই না বললি কিছু অমীমাংসীত ব্যাপার আছে গল্পে।”জিব্রান করুণ হাসি হেসে বলল-"হ্যা। এ গল্পে দু'টো অমিমাংসিত বিষয় আছে। প্রথমত‚ সেই ভয়ানক প্রাণীটার চিন্তা কি করে ছালামের মাথায় এসেছিল‚ সেটা আমি বের করতে পারিনি। দ্বিতীয় বিষয় হলো‚ সেই নগ্ন মেয়েটা ভয়াল দর্শন প্রাণীটাকে ডাকছিল বেলায়েত বলে।" "তো?" "Demonology বুঝিস? ডেমনোলজি মানে শয়তান বিদ্যা। গ্রীক-রোমান বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন ডেমন বা শয়তানের গল্প রয়েছে; মাইথোলজিক্যাল চরিত্র সব। তেমনি এক শয়তানের নাম ছিল বাইলেথ (Byleth) বা বেলেথ (Beleth)। বেলেথ ছিল নরকের এক রাজা। সে একটা ধূসর ঘোড়ায় চড়ত। তার মুখমণ্ডল ছিল বিড়ালের মত। সে তার সঙ্গিনীদের গলার বামদিকে কামড়ে ধরে মেরে ফেলত। ছালাম যে প্রাণীটার কথা বলেছিল তার সাথে কিন্তু বেলেথের মিল আছে। আবার মেয়েটাও তাকে ডাকছিল বেলায়েত নাম ধরে। বেলেথ আর বেলায়েত শব্দ দু'টো কাছাকাছি নয়? ছালামের মতো এক গেঁয়ো কিশোরের পক্ষে রোমান মাইথোলজি সম্পর্কে জ্ঞান থাকার কথা নয়। তাহলে এই বেলায়েত নাম এবং বেলায়েতের বর্ণনা কি নেহায়েত কাকতালীয়?" "মাই গড!" মেহজাবিন বলল‚ "বেলেথের সাথে বেলায়েতের এই অদ্ভুত মিলের বিষয়টা কি সাইকোলজিক্যালি ব্যখ্যা করা যায় না জিব্রান ভাই?" "যায় আবার যায় না। জলপরীর কথা ধরো। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ‚ বিভিন্ন দেশের অনেক নাবিক জলপরী দেখেছে বলে দাবী করেছে। তবে জলপরী বা মার্মেইড এর কোন অস্তিত্ব বিজ্ঞানীরা পাননি। কিন্তু মজার বিষয়‚ জলপরী সংক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পরস্পরের সাথে মিলে যায়। আমি বলছি না যে জলপরী আছে‚ আমি বলতে চাচ্ছি যে একই রকম কল্পনা‚ ফ্যান্টাসি কিংবা বিভ্রান্তি অনেক মানুষের মধ্যে হয়ে থাকে। কেন হয়ে থাকে সেটা সঠিক ভাবে আজও জানা যায়নি। মানুষের মন কোন সহজ বস্তু নয়!" বলতে বলতে জিব্রান হাই তুলল। ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু পূরব-দম্পতি স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবছে‚ তাদের বোধহয় গল্পটা এখনও হজম হয়নি। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি! 
কিছু কথাঃ এই গল্পের পেছনের গল্পটা বলি, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, গ্রামের রাস্তায় এক তরুণী আর একটি অল্পবয়সী ছেলে একটা গরুর মতো দেখতে কিম্ভূত প্রাণীর সামনে দাড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। প্রাণীটা মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে ভয়ংকর বিদ্ঘূটে ভঙ্গিতে চুমু খেতে থাকে এবং এই দৃশ্য দেখে ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই স্বপ্ন থেকে আমি চমৎকার একটা সাইকোলজিক্যাল প্লট পেয়ে যাই, গল্প লিখেও ফেলি; কিছু ট্যাবু ব্যাপারকে মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলাম সেই গল্পে। তারপর ব্লগে দিয়েছিলাম, সেটা প্রায় এক বছর আগের কথা। পরে গল্পের একটা অংশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ট্যাবু যে কোন বিষয় নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু মন্তব্য খুব বেশি আক্রমণাত্মক হবার পর আমি গল্পটা মুছে দিয়েছিলাম। এখন আবার নতুন করে, বিতর্কের অংশটা বাদ দিয়ে, নতুন করে লিখলাম গল্পটা।

৩।দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ অবসেশন।

ব্রাম স্টোকার একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন যে অক্টোপাসের মতো দেখতে একটি প্রাণী তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তার ঘাড়ে শ্বদন্ত বসিয়ে রক্ত চুষে খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠে বসেই তিনি লেখা শুরু করে দেন, কারণ স্বপ্নের স্মৃতি মানুষ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে থাকে। এই স্বপ্নের সারাংশ থেকেই স্টোকার ড্রাকুলা গল্পটির প্লট দাড় করিয়েছিলেন এবং টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম করে, বিভিন্ন বই পত্র, মিউজিয়ামের নথি ঘেঁটে এবং স্থানীয় রূপকথা ইত্যাদি একসঙ্গে করে বিখ্যাত "ড্রাকুলা" বইটি লিখেছিলেন। দুঃস্বপ্ন থেকে গল্প লেখার এই ধারণাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি নিজের কিছু দুঃস্বপ্নকে পরিমার্জিত করে কয়েকটি গল্প লিখেছি। ভাবছি, ধারাবাহিক ভাবে, বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন নিয়ে লিখব। তবে বলে রাখি, এই লেখাগুলো আমি ঘুম থেকে উঠে লিখিনি, ঘুম থেকে উঠে এক-দুই লাইনে টুকে রেখেছি, পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিনতে লিখেছি।

অবসেশন
শিহাবের কথাঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, হাওয়ায় অহনার চুল উড়ছে, শাড়ীর আঁচল বেসামাল হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে এদিক সেদিক, অহনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার বিষণ্ণ চোখ দু’টো দিয়ে সমুদ্র দেখছে গভীর মনোযোগে। একটা দু’টো পাখি যখন ডেকে উঠছে অনিয়মিত সুরে, অহনা তখন শরীর স্থির রেখে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে পাখিগুলোকে। সাগরের তীরে “কিয়ায়া কিয়ায়া” শব্দে কোন পাখি ডাকে জানি না। ডাকগুলো একটু অদ্ভুত, আগে শুনিনি আমি। অহনাও শোনেনি বোধহয়। তবে ডাকটা শ্রুতিমধুরও বেশ। কানে লেগে থাকে অনেকক্ষণ।অনেকক্ষণ সাগরের তীরে বসে থাকার পর আমরা হাত ধরাধরি করে বালুচরি ধরে হাটতে লাগলাম। চোখের মতো, অহনার হাত দু’টোও বেশ শীতল। দুর্বলভাবে আমার হাত ধরে রেখেছে সে। হাটছে আস্তে আস্তে পা ফেলে। তাল মিলাতে আমাকেও হাটার গতি কমিয়ে দিতে হয়েছে অনেক। অহনার অদ্ভুত রোগটা ধরা পড়ে চার মাস আগে। অহনা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে হঠাৎ করে। চা বানাতে গিয়ে হাত থেকে চায়ের কেটলি ফস্কে যায়, হাটতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে যায় হঠাৎ করে, লিখতে গিয়ে হঠাৎ খাতার উপর ঘুমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার চেহারা ফ্যাকাসে-বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। কলম, পেন্সিল, পেপারওয়েট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জড়বস্তু চিবোতে থাকে কারণে অকারণে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার পর এনিমিয়া ধরা পড়ল ওর, মানে এক ধরনের রক্তশূন্যতায় ভুগছে সে। চিকিৎসা চলতে থাকে অহনার। দীর্ঘ দু’মাসের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয় অহনা। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখতে হয়েছিল মাঝখানে বেশ কিছুদিন। মোটামুটি সুস্থ হবার পর ডাক্তার বলল, শহরের বাইরের কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। অহনার ধুলোবালিতে এলার্জি আছে, সে কারণে শহরের বাইরে যেতে বলল নাকি এনিমিয়ার চিকিৎসার জন্য সেটা বোধগম্য হয়নি আমার! কিন্তু ডাক্তারের আদেশ শিরোধার্য, আমরা পরের সপ্তাহেই কক্সবাজারে চলে আসি। ট্যুরিস্ট স্পট থেকে একটু দূরে, সাগরের তীর ঘেঁষে একটা বাংলো বাড়িতে উঠি আমরা। বেশ কিছুক্ষণ দুর্বল পায়ে হাটার পর অহনাকে বললাম, “চলো, ফেরা যাক। এত হাটলে দুর্বল হয়ে পড়বে তুমি।”অহনা কিছু না বলে সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। আমি তাকিয়ে একটা বড়সড় পাহাড় দেখতে পেলাম, সাগরের অনেকটা কাছে গিয়ে থেমেছে সেটা। সাগর আর পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গাটায় গোড়ালি সমান পানি আসা যাওয়া করছে। জোয়ারের পানি বোধহয়। তবে অহনার আঙুল বরাবর আরও সামনে তাকিয়ে আমি একটা গুহা দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে, চোখে পড়ে কি পড়ে না এমন একটা গুহা। দূর থেকে দেখে অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে মনে হচ্ছে। আমি অহনাকে জিজ্ঞেস করলাম-“কি ওখানে অহনা?”“পাখিগুলোর অদ্ভুত ডাকগুলো ওখান থেকে আসছে, শুনতে পাচ্ছ না?”আমি একটু মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম, হ্যা, আসলেই শোনা যাচ্ছে অল্প অল্প। কিয়া, কিয়ায়া...কেমন সুরেলা কিন্তু গম্ভীর ডাক। অহনাকে বললাম, “পাখিগুলো বোধহয় ওখানেই থাকে। গুহার দেয়ালে বাসা বেঁধেছে হয়তো।”“চলো, গিয়ে দেখি।”“না অহনা, আজ নয়। আজ অনেকটা হেটেছ তুমি। কাল যাব।”“আচ্ছা।” অহনা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। ইদানীং অহনা চুপচাপ রাজি হয়ে যায় সব কথায়। কেমন মায়া লাগে ওর জন্য। বেচারির শরীরের দুর্বলতা মনকেও দুর্বল করে তুলেছে। বাংলোটা কাছেই, দু’মিনিটের পথ এখান থেকে। একতলা বাংলো। তবে পাটাতনের উপর উঁচু করে তৈরি করা। সাত আটটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে হয়। আমরা যখন সিঁড়ি পেরিয়ে আমাদের কামরার দরজা খুলতে যাব, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলাম। জানালার পাশে ছোপ ছোপ দাগ। কিছু বিদঘুটে তরল ছড়ানো ছিটানো এখানে সেখানে। একটা বোটকা গন্ধ এসে ঝাপটা মারছে নাকে। কিসের দাগ সেটা বুঝতে পারলাম না, হয়তো আমাদের অনুপস্থিতিতে এলাকার দুষ্টু ছেলেপেলেরা কাঁদা টাঁদা মেখে খেলাধুলো করতে এসেছিল, কে জানে। তবে আমি কেয়ারটেকারকে ডেকে তখনই পরিষ্কার করতে বললাম দাগগুলো। 

অহনার কথামাঝরাতে গোঙানির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। কেমন একটা চাঁপা শব্দ আসছে কোথা থেকে যেন। আর সেই পাখির ডাকের মতো শব্দটা শোনা যাচ্ছে, কিয়া, কিয়ায়া...! খুব কাছ থেকে আসছে শব্দটা। ডান দিকে তাকাতেই একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পেলাম। সাপের মতো দেখতে একটা প্রাণী, আকারে তিন হাত হবে, কিন্তু অনেক বেশি মোটা, প্রায় ১৫ ইঞ্চি ব্যাস হবে, প্রাণীটা শিহাবের পা কামড়ে ধরেছে। মুখের ভেতর সারি সারি দাঁত প্রাণীটার, কুমীরের মতো ধারালো আর বড় বড়। প্রাণীটার লেজের দিকে তাকিয়ে দেখি আরও ভয়াবহ জিনিস দেখতে পেলাম। শামুকের মতো দেখতে দু’টো শূর বেরিয়ে এসেছে, সেগুলোর মাথায় দু’টো চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে দেখছে শিহাবকে। ভারী একটা কাঠের ফুলদানী দিয়ে শিহাব ক্রমাগত বাড়ি মারছে প্রাণীটার গায়ে, কিন্তু সেটার কোন বিকার নেই। শিহাবের পা থেকে রক্ত ঝরছে। মুখ থেকেও।আমি দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসলাম। আমাকে উঠতে দেখে যন্ত্রণাকাতর গলায় শিহাব বলল, “অহনা, ওটার চোখ দু’টো নষ্ট করে দাও!”ঘরের কোণের টেবিলে একটা ফল কাটার ছুরি পড়ে ছিল কয়েকদিন ধরে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছুরিটা তুলে নিলাম হাতে। দুর্বল হাতে সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করলাম প্রাণীটার চোখ বরাবর। আঘাত করলাম, কিন্তু লাগল না ঠিক জায়গায়। প্রাণীটা গলা দিয়ে হিসহিসানীর মতো আওয়াজ করল। আমি দ্বিতীয় বার আঘাত করলাম চোখের দু’টো শূরের সংযোগস্থলে। এবার লাগল। ছুরির আঘাতে চোখ দু’টো আলাদা হয়ে যেতেই প্রাণীটা শিহাবের পা ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে মোচড়াতে লাগল। দেখতে দেখতে নিথর হয়ে গেল ওটার শরীর।আমি শিহাবের হাত ধরে ভয়ার্ত গলায় বললাম, “কি ছিল এটা শিহাব?”“জানি না, অদ্ভুত কোন প্রজাতির প্রাণী! তবে যেটাই হোক, সেই পাহাড়ের গুহায় বোধহয় এরা থাকে। আমরা পাখি ভেবেছিলাম এগুলোকেই। ভাগ্যিস গুহায় ঢুকিনি আমরা।”বলেই শিহাব হুংকার ছেড়ে কেয়ারটেকারকে ডাকল, “রমিজ, রমিজ!”

কথোপকথনপরদিন সকালে শিহাবের পা ব্যান্ডেইজ করে দিল স্থানীয় ডাক্তার। ভাগ্যিস দাঁতে বিষ ছিল না, শুধু আহত হয়েছে শিহাব। বিষ থাকলে আরো বড় ক্ষতি হতে পারত।ডাক্তার চলে যেতে অহনা শিহাবকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল, “আচ্ছা শিহাব, তুমি কি কাল রাতে জেগেছিলে, যখন সেই প্রাণীটা এসেছিল?”“হ্যা, ছিলাম।”“কি করছিলে?”“তেমন কিছু না, মস্কুইটো স্টিকগুলো নিয়ে যে আর্টিকেলটা লিখছিলাম গত ক’মাস ধরে, সেটা দেখছিলাম বসে বসে।”“তোমার বাক্স ভর্তি মস্কুইটো স্টিক, যেগুলো তুমি আফ্রিকার এক জঙ্গল থেকে এনেছ?”“হ্যা।”“আমি স্টিকগুলো দেখেছি, খুব সরু আর লম্বা, মশার রক্ত চোষার শূরের মতো, তাই না? সে জন্যই নাম মস্কুইটো স্টিক!”“হ্যা। ঠিক বলেছ।”“এই শূরগুলো দিয়েই কি এতদিন আমার রক্ত পান করতে?”শিহাব ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। “মানে, কি বলতে চাও?”“কাল রাতে যখন ঘুম থেকে উঠলাম ধস্তাধস্তির শব্দে, তোমার ঠোঁটে রক্ত লেগেছিল। দু’য়ে দু’য়ে চার মেলালাম। আমার এনিমিয়া হবার পেছনে আসলে তোমার হাত ছিল। তুমি এত দিন ধরে একটু একটু করে আমার রক্ত পান করছিলে। মস্কুইটো স্টিকগুলো দু’বছর আগে যখন তুমি যখন আফ্রিকাতে পাও, তখন তুমি খেলাটা শুরু করো। আমার শিরায় স্টিক বসিয়ে রক্ত চুষে খেতে তুমি, তাই না? আমি ঘুমের মধ্যে হালকা টের পেতাম। সন্দেহ ছিল সামান্য, কাল রাতে পরিষ্কার হলো!”“মাই গড! কি বলছ তুমি অহনা। আমি এমন কেন করতে যাব?”‘কারণ তুমি একটা সাইকো! তোমার রক্তের প্রতি নেশা আছে। আমি নেট ঘেঁটেছি সকালে, এটাকে বলে রেনফিল্ড’স সিনড্রম, রক্ত পান করার তীব্র নেশা আছে তোমার মধ্যে।”শিহাব কিছু না বলে কেমন ভাবলেশ চোখে তাকিয়ে রইল অহনার দিকে।“ওভাবে তাকিয়ো না শিহাব, আমি রেগে নেই তোমার উপর। রোগ আর রোগীকে ঘৃণা করা এক নয়। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে শিহাব। শিগগিরি...”

৪।দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ আয়না-ভীতি।

ব্রাম স্টোকার একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন যে অক্টোপাসের মতো দেখতে একটি প্রাণী তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তার ঘাড়ে শ্বদন্ত বসিয়ে রক্ত চুষে খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠে বসেই তিনি লেখা শুরু করে দেন, কারণ স্বপ্নের স্মৃতি মানুষ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে থাকে। এই স্বপ্নের সারাংশ থেকেই স্টোকার ড্রাকুলা গল্পটির প্লট দাড় করিয়েছিলেন এবং টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম করে, বিভিন্ন বই পত্র, মিউজিয়ামের নথি ঘেঁটে এবং স্থানীয় রূপকথা ইত্যাদি একসঙ্গে করে বিখ্যাত "ড্রাকুলা" বইটি লিখেছিলেন। দুঃস্বপ্ন থেকে গল্প লেখার এই ধারণাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি নিজের কিছু দুঃস্বপ্নকে পরিমার্জিত করে কয়েকটি গল্প লিখেছি। ভাবছি, ধারাবাহিক ভাবে, বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন নিয়ে লিখব। তবে বলে রাখি, এই লেখাগুলো আমি ঘুম থেকে উঠে লিখিনি, ঘুম থেকে উঠে এক-দুই লাইনে টুকে রেখেছি, পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিনতে লিখেছি।

আয়না-ভীতি
"সুমন, আমার চোখের দিকে তাকাও।"
"বলো যুথী।"
"না, তুমি তাকাচ্ছ না। তাকাও আগে।"
"আচ্ছা, তাকালাম। বলো।"
"এ কি, তুমি কাঁপছ কেন?"
"কাঁপছি না।"
"কাঁপছ!"
" না তো!"
"তোমার কি হয়েছে বলো তো। ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দেখি তুমি গুটিসুটি মেরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এক কোণে বসে আছো, মাঝে মাঝে প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াও। কেন?"
"জানি না।"
"তুমি আমাদের শহরের বাসাটা ছেড়ে এই নির্জন এলাকায় বাসা নিয়েছ, গত কয়েক মাসে আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় যাওনি, অফিসেও যাওনি। কেন? "
"এমনি, শরীরটটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"
"তুমি ঘরকুনো হয়ে পড়লে কেন এভাবে? আগে তো ঘুরতে অনেক পছন্দ করতে। অথচ গত সপ্তাহে নিজের আপন মামাতো বোনের বিয়েতেও যাওনি। কি হয়েছে তোমার বলো তো সত্যি করে?"
"কিছু না যুথী! বললামই তো, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"
"না, আরও কিছু ব্যাপার আছে। তুমি লুকোচ্ছ!"
"কিচ্ছু লুকোচ্ছি না।"
"তাই? তাহলে বলো যে বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলেছ কেন? আজকাল দাড়ি কামাতেও আয়না ব্যবহার করো না। কেন? কেন তোমার আমার সেলফোন দু'টো বিক্রি করে বাসায় ল্যান্ড লাইন এনেছ?"
"এমনি।"
"এমনি? এটা কোন উত্তর হলো?"
"হুম।"
"তোমার মানসিক সমস্যা হয়েছে সুমন, তোমাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব কাল।"
"না!!"
"না, নিয়ে যাবই।" 
"প্লিজ না!"
"ঠিকাছে, নেব না। এক শর্তে,তুমি আয়নায় মুখ দেখবে আমার সামনে বসে। আমার ধারণা কোন রহস্যময় কারণে তুমি আয়না দেখতে ভয় পাচ্ছ।"
"আয়না? আয়না কই পেলে তুমি? সব আয়না তো আমি ফেলে দিয়েছি।"
"আমার পার্সে একটা ছোট আয়না ছিল।"
"সর্বনাশ, কোথায় সেটা? এক্ষুণি ফেলে দাও!"
"কেন ফেলে দেব? দেব না। তুমি আমার সামনে আয়নায় নিজের মুখ নিজে দেখবে।"
"ঠিকাছে, কিন্তু তারপরই তুমি ফেলে দেবে আয়নাটা।"
"আচ্ছা।"
সুমন নিজের চেহারা দেখল আয়নায়, ছোট্ট গোল আয়নায় তার লম্বাটে মুখটা অদ্ভুত দেখাল।
"হয়েছে, এবার ফেলে দাও যুথী।"
"না। ফেলব না। কেন ফেলব? আমি জানতে চাই, আয়না রহস্যটা কি!"
"দোহাই লাগে, ফেলে দাও ওটা।"
"না। ফেলব না। আমি জানতে...."
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল যুথী। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে পেয়েছে সে। কি ভয়ংকর! তার চোখের মনির অংশটা পুরোপুরি সাদা, কোন কালো অংশ নেই। সাদা চোখের কিনারায় রক্ত জমেছে। চেহারাও কাগজের মতো সাদা,যেন রক্তশূন্য। কালো কুচকুচে ঠোটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দু'টো শ্বদন্ত; ঠিক যেন হিংস্র কুকুরের দাঁত। কি ভয়ংকর!
"এসব কি সুমন? আমার চেহারা..."
"ইটস ওকে যুথী। আই লাভ ইউ! তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা..."
"কিন্তু আমার হয়েছে কি সুমন?"
"জানি না! দু'মাস ধরে তোমার শরীরের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানি না। যেদিন তোমার দাঁত গজাল, তুমি রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। যখন ফিরলে, তখন তোমার দাঁত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেই থেকে প্রতিরাতে তুমি একই কাজ করো। কিন্তু সকালে উঠে ঠিকঠাক আচরণ করো আবার।"
"সেজন্যই তুমি বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে রেখেছ? সেজন্যই এই দুর্গম এলাকায় বাসা নিয়েছ? আত্মীয় স্বজনকে এড়িয়ে চলছ এজন্যই?"
"হ্যা যুথী। কিন্তু তুমি মন খারাপ করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"কেমন করে ঠিক হবে? আমি কি পিশাচে পরিণত হয়েছি সুমন?"
"যুথী,রাত হয়েছে। কাল এসব আলোচনা হবে।"
"তুমি কি ভয় পাচ্ছ সুমন? রাত হলে কি আমি আমি প্রেতাত্মা হয়ে যাব?"
"প্লীজ,এখন ঘুমোতে চলো।"
"না।"
যুথী উঠে দাড়াল। আজ তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। রক্ত তৃষ্ণা, অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি।

৫।দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ কুকুরের ডাক।

কুকুরের ডাক
১.বান্ধবীর বিয়ে হতে রাত করে ফিরছিল তিতলি, সঙ্গে ওর বড় ভাই শিমুল। রাস্তার বিপরীত দিক থেকে ছুটে যাচ্ছিল একটা কুকুর। দেখতে কেমন বিদঘূটে, কালো লোম গুলো কেমন যেন অশরীরী। তিতলির পাশ দিয়ে যাবার সময় এতটাই গা ঘেঁষে যাচ্ছিল যে, তিতলি প্রায় আঁতকে উঠে পাশে সরে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সরে যেতে পারেনি সে, কুকুরটার একটা পা ওর পায়ের পাতার উপর দিয়ে ঘঁষা লেগে চলে গেল, কুকুরের ধারালো নখের আঁচড়ে বেশ একটা ক্ষত তৈরি হলো জায়গাটাতে। আর্তনাদ করে উঠল তিতলি। শিমুল উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? তিতলি জবাব না দিয়ে প্রবল যন্ত্রণায় চেপে ধরল ক্ষতটা। কুকুরটা মুহুর্তে থমকে গিয়ে তিতলির দিকে তাকাল। কি ভয়ংকর চোখ কুকুরটার! এক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকেই আবার ছুটে গেল, যেদিকে যাচ্ছিল।
২.ঘরে ফেরার পর ক্ষতটা এ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডিজ করে দিল তিতলির মা। তার চাচা ডাক্তার, সে কিছু ওষুধের নাম দিল, সেগুলো খেতে বলল তিতলিকে। ব্যাথা কমে গেলেও কুকুরের ভয়ার্ত চোখের দৃষ্টি ভুলল না তিতলি। 
৩.সেই ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। এখনো ক্ষত সারেনি তিতলির। যেমন ছিল, তার চেয়েও দগদগে হয়েছে। বেশ ক’জন বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে সে, ওষুধও খাচ্ছে, কিন্তু ক্ষত মোটেও কমছে না। প্রায় রাতে সেই কুকুরের ভয়ার্ত দৃষ্টি মনে পড়ে তিতলির। 
৪.আরো এক সপ্তাহ পরের কথা, প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে আজ তিতলির পায়ে। সে নিজেও জানে না, কেন এত ব্যাথা হচ্ছে, কেনই বা সেরে যাচ্ছে না। জলাতঙ্কের টিকাও সে নিয়েছে, কিন্তু কিছু হচ্ছে না কিছুতেই। তার উপর, ব্যাথার জায়গাটা যতটা না যন্ত্রণা দিচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে চুলকানি। খুব চুলকাচ্ছে জায়গাটা, কিছুক্ষণ পর পর অদ্ভুত রকম কামড় দিচ্ছে ভিতর থেকে। সেই রাতে শেষমেষ ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হলো তিতলিকে। 
৫.পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিতলি আবিস্কার করল, তার ক্ষত প্রচন্ড রকম চুলকাচ্ছে, অবিশ্বাস্য রকম চুলকাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, কেমন একটা বিদঘূটে মোচড় দিচ্ছে তিতলির পায়ে। সে দ্রুত উঠে বসে নিজের পায়ের উপর ঝুঁকে পড়ল ক্ষতটা দেখার জন্য। দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না সে! তার পায়ের ভেতর ক্ষত হতে একটা জীবন্ত শতপদী বের হয়ে আসছে, অর্ধেক বাইরে সেটার, অর্ধেক ভেতরে। একটু একটু করে বেরোচ্ছে।গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিল তিতলি!
৬.কোন ওষুধে কাজ হচ্ছে না, প্রতি ২-৩ মাস পরপর অদ্ভুত অদ্ভুত শতপদী পোকা বেরোচ্ছে, এমন ভয়ংকর কেস কোন ডাক্তার কখনো পায়নি। ক্ষতটাও বড় হয়ে চলেছে দিন দিন। ক্ষত যত বড়, শতপদীও ততো বড়। তাই শেষমেষ বাধ্য হয়ে পা-টা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল ডাক্তাররা।
৭.অপারেশনের দিন ডাক্তাররা ভয়াবহ চমকে গেল, চিৎকার দিয়ে উঠল একজন নার্স। কারন তিতলির কাটা পা থেকে শুধু শতপদী আর শতপদী বেরোচ্ছে। অপারেশন থিয়েটার ছেঁয়ে গেছে শতপদীতে! নার্সের চিৎকার ছাপিয়ে, দূরে কোথাও কুকুরের ডাক শোনা গেল।

৬।ফেরা ...

..... শেষ বিকেলের নরম আলো ঝিকমিক করছিল ক্যাপ্টেন টনি স্যামুয়েলসেনের ব্যাজ এ। ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ২৫০ মিটার লম্বা বিশাল কমার্শিয়াল ফ্রেইটার এমভি কলম্বাসের ব্রিজে দাঁড়িয়ে কফির মগে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। শক্তপোক্ত নরওয়েজিয়ান লোকটার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, আর কয়েক সপ্তাহ পরই অবসর নিচ্ছেন। এটাই ক্যাপ্টেন হিসেবে স্যামুয়েলসেনের শেষ ভয়েজ। নাবিক হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। ডেক ক্যাডেট হিসেবে জীবন শুরু করে ধাপে ধাপে ক্যাপ্টেন হয়েছেন। জীবনের মহামুল্যবান ত্রিশটি বছর সাগরে কেটে গেছে। পোড় খাওয়া লোক, দেখলেই বোঝা যায়। 
সাগরের এক ধরনের নেশা আছে। যৌবনে এই নেশায় আকৃষ্ট হয়েই জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন। ইদানিং তার খুব ক্লান্ত লাগে। বন্দরে বন্দরে ঘুরতে মন টানে না। নরওয়ের দক্ষিণে ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে ফেলে আসা পরিবারের কথা মনে পরে। স্ত্রী লিন্ডি, একমাত্র মেয়ে লিনা আর মাত্র হাঁটতে শেখা নাতনী এমিলি - তার শেষ জীবনের ভালবাসা।
- তোমাকে ভালবেসে আমি কিছুই দিতে পারিনি লিন্ডি ...। শেষবার ছুটিতে যখন বাড়ি গিয়েছিলেন, বলেছিলেন স্যামুয়েলসেন।- পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগটাই তুমি আমাকে মিস করে কাটিয়েছ টনি। আমার কাছে এটা কম কিছু নয়। হেসে বলেছিল লিন্ডি।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফার্স্ট মেট তার দায়িত্ব বুঝে নিতে এসেছে।- হ্যালো রবিন, স্টারবোর্ডে কি অবস্থা? হেসে ফার্স্ট মেটকে বললেন স্যামুয়েলসেন। - হ্যালো স্যার! ওদিকটাতে সব গোছানো আছে। কয়েকজন এশিয়ান ডেক ক্যাডেট গিটার বাজিয়ে এরই মধ্যে হেরে গলায় গান জুড়েছে। সারাদিন পর ওরা এতো এনার্জি কোত্থেকে পায় ঈশ্বর জানেন।- ওরা তরুন, রবিন। ওদের রক্তই আলাদা। ওরা আমাদের মত বুড়িয়ে যায়নি। দেখি আজ একবার ওদিকে যাব।- আমি কি আসব স্যার?- না না। আমি শুধু একটু ঘুরে আসব।
মেইন ডেক থেকে স্টারবোর্ড প্রায় দুশো মিটার। ইদানিং অনেকটা দূর মনে হয়। ধীরে ধীরে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন। হঠাৎ টানা টানা সুরের একটি গান তাঁকে থামিয়ে দিল। গানের কথা বোঝা যাচ্ছেনা, গায়কের গলাও আহামরি ভাল না, কিন্তু কি ভীষণ আকুতি ঝরে পরছে সুর থেকে! আহা! কি অনির্বচনীয় বিষাদ! যেকোনো মহান সঙ্গীতের কি ভীষণ আকৃষ্ট করার ক্ষমতা!
গান গাইছিল ডেক ক্যাডেট আনিস। বাংলাদেশের ছেলে। ওকে রিক্রুট করার একমাত্র কারন ওই দেশের মানুষ পিপড়াদের মত কর্মঠ। এও ব্যাতিক্রম নয়। সন্ধ্যায় সমবয়েসি আরও কয়েকজন ক্যাডেটকে নিয়ে ওই গান গায়। মাঝে মাঝে রাম খেয়ে পাগলামি করে। নাবিকদের জীবনে এসব স্বাভাবিক। ডিউটির পর জুনিয়রদের পাগলামি বানিজ্যিক জাহাজে প্রশ্রয়ের চোখেই দেখা হয়। এরা যে অমানুষিক পরিশ্রম করে তাতে এটুকু প্রশ্রয় না দিয়ে চলে না।
- হ্যালো ক্যাডেট! কি গান গাচ্ছিলে?পেছনে স্বয়ং ক্যাপ্টেনকে দেখে ধরমর করে উঠে দাঁড়ায় আনিস।- সরি স্যার। এই এমনিতেই। আর গাইবো না স্যার। কোনমতে জবাব দেয় সে।- না না, ভাল গান।- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আপনার ভাল লেগেছে?- সুরটা চমৎকার, কিন্তু কথা গুলো বুঝিনি। একটু বুঝিয়ে বলবে, সান?- আসলে স্যার এটা নাবিকদেরই গান। একজন সেইলর নীল সাগরকে ডেকে বলছে তাকে মুক্তি দিতে। তার বন্দরে বন্দরে ঘুরতে মন টানছে না। বাড়ির কথা মনে পরছে। একলা বাড়িতে তার স্ত্রী তার পথ চেয়ে আছে। টিপিক্যাল সেইলর'স সং, স্যার। - ও, তাই? বাহ বেশ বেশ। ক্যারি অন।- ইয়েস স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। পোর্ট সাইড হয়ে মেইন ডেকে ফিরে যাচ্ছেন স্যামুয়েলসেন। অনেকদিন আগে শোনা একটা গান মনে পরছে তার। কি যেন নাম গানটার? Jamaica Farewell ! নাকি Kingston Town? বয়স হয়েছে। স্মৃতি আজকাল লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করে। 
- বয়স টনি, বয়স। বয়স আমাদের কাছে আনবে। দেখে নিও। বলেছিল লিন্ডি। 
গানের কথা গুলো মনে পরেছে। কি আশ্চর্য মিল গান দুটোর মাঝে। দূর দেশের দুই মানুষ একই আবেগ নিয়ে একই রকম দুটো গান লিখে ফেলেছে। কি অদ্ভুত। ভালবাসার প্রকাশে বোধ হয় সবাই এক হয়ে যায় ...
গুন গুন করে গান গাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন টনি স্যামুয়েলসেন। -
...... I'm sad to say I'm on my wayWon't be back for many a dayMy heart is downMy head is turning around I had to leave a little girl in Kingston town......
তোমাকে ভালবাসি লিন্ডি। আমি আসছি।

৭।আনন্দভ্রম

"এই চলো না আত্মহত্যা করে ফেলি! এমন করে তাকিও না আমার কথা শুনে। তুমি ভালো করেই জানো আমি কোন দুঃখবিলাসী সুপার সেনসেটিভ টিন নই। জীবন সম্পর্কে বরাবরই ইতিবাচক ভাবনা করে এসেছি। তুমি তো ভালো করেই জানো, দীর্ঘস্থায়ী ডিপ্রেশন অথবা সাময়িক তীব্র জীবন অনীহা কোনটাই আমার মধ্যে নেই। আমি বরাবরই ছটফটে, চঞ্চল, উদ্যমী, ভালোবাসায় পূর্ণ মানবী। আমি সাজতে ভালোবাসি, নাচতে ভালোবাসি, গাইতে ভালোবাসি, আর ভালোবাসি ভালোবাসতে। শীতের সকালগুলোয় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে না থেকে বারান্দায় গিয়ে কুয়াশা দেখেতে ভালোবাসি। গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে ঘুঘুর ডাক শুনে উন্মনা হতে ভালোবাসি। ভালোবাসি জীবন। আমার কথা কি তোমার কাছে পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে? হতেই পারে, তোমাকে দোষ দেবো না। এলোমেলো কথা আর অগোছালো অনুভূতিগুলো সত্যিই বড় বিভ্রান্তিকর; জীবনের মত। মৃত্যুতে কোন বিভ্রান্তি নেই। বিশেষ করে আত্মহত্যায়। আর তা যদি হয় দুজনে মিলে একসাথে হাতে হাত, অধরে অধর মিলিয়ে তাহলে তো রীতিমত শৈল্পিক সুষমায় মণ্ডিত এক মহাকাব্য রচিত হবে প্রকৃতির বায়োস্কোপঘরে। আমার হাতটা ধরে দেখো, খুব গরম না? আমার শরীরের ভেতরে রক্তকণিকারা ছুটোছুটি করছে প্রবল বেগে, জলপাই বন থেকে পাতার পাল্কি নিয়ে আসছে ফিঙে পাখির দল। তুমি কখনও পাতার পাল্কিতে চড়েছো? জানি তো চড়ো নি। চড়ার কথা ভাবোও নি। এমন কী কখনও এর নামই শোনো নি। এসব সবসময় শোনা যায় না। এসব সবাই শুনতে পায় না। খুব ভাগ্যবান যারা, আর যাদের কল্পনাশক্তিতে মিশে থাকে মৃত্যুর আহলাদে আপ্লুত জীবনবোধ, শুধু তারাই এসব খুব গোপন কথা জানতে পারে।
তুমি বলছো জীবনবোধে ভাস্বর থাকে যারা তারা কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? মৃত্যুকে সবকিছুর বিনাশ ভাবছো কেন বোকা? মৃত্যু হল লাল জর্জেট শাড়ী পরা, কানে জূঁইদুল, পায়ে ঘাসের নুপূর পরিহিত এক লাজুক বোকা মেয়ে। অবশ্য বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই সে ভয়ংকর হিংস্র বিশালদেহী, কালো আলখেল্লা পরা, সবুজ চোখের ভয়ানক হন্তারক। তোমার কাছেও কি সে এমন? এত কিসের ভয় বলো তো? মৃত্যুকে তারাই ভয় পায়, যারা জীবনের দেয়া উপচে পড়া উপহারগুলো দেখেও দেখে নি, শুনেও শোনে নি, বুঝেও বোঝে নি। যারা হাঁটে নি শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা দূর্বাঘাসের পথে, যারা শোনে নি বসন্তের গান; কোকিলের সুরকাব্য, যারা বোঝে নি শেষরাতের স্বপ্নে টুনটুনি পাখির কিচিরমিচিরে বুনে দেয়া জীবনালেখ্য। কী হলো, কিছু বলছো না কেন? এত চুপচাপ স্বভাব তোমার! অবশ্য একদিক দিয়ে এটা ভালোই, আমার বকবক করতে খুব ভালো লাগে, তাই চাই একজন মনোযোগী শ্রোতা। তুমি ঠিক তাই। তুমি একজন ধ্যাণমগ্ন ঋষি, নির্বিকার নীরবতায় বুনে যাও হিরন্ময় মুহূর্তের নকশীকাঁথা। তোমার সাথে হীরকমুহূর্তগুলো স্মৃতিস্মারক হিসেবে সংগ্রহ করি আমি। আর তাই জীবন-মৃত্যু-আত্মহত্যাচিন্তা-জীবনের আনন্দভ্রম, সবকিছুর দোলাচলে ঘুরতে ঘুরতে, লাফাতে লাফাতে, আমি খুঁজে নেই বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়ার আশ্চর্য সাদৃশ্য, তাদের সঙ্গমস্থল; এক নীল মোহনায় লীন হয়ে যাই। কত কী পড়ে মনে! প্রথম স্কুলে যাবার দিন, প্রথম ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলা, প্রথম ছক্কা মারা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া, প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া, শেষবারের মত বাবা-মার সাথে সাগরদর্শন, তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া... দেখেছো, কী বিটকেলে বুদ্ধিঅলা দুষ্টু আমার মনটা! আমার মুড অফ করে দিতে চায়! উহু বাবা, অত সোজা না! আমার মন খারাপ হয়ে গেলেই আমি তোমার কথা ভাবি...
আমাদের প্রথম দেখা হওয়াটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে? সেই যে, তোমরা কলোনির ছেলেপিলেরা ক্রিকেট খেলছিলে, মাঝখানে উটকো আপদের মত উদয় হলাম আমি। গোঁ ধরলাম, আমাকেও খেলায় নিতে হবে। তোমাদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেলো। কেউ নিতে চায়, কেউ চায় না। আর তুমি! বড্ড বিরক্ত হচ্ছিলে, চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছিলে, খেলায় বিঘ্ন হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছিলে। তোমার হুড়োহুড়িতেই সবাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল আমায় খেলায় নিতে। আমাকে দাঁড় করিয়েছিলো লং অনে। তুমি বোলিং করছিলে। বেশ ভালো পেস ছিলো তোমার বলে। একটা ফুলটস বল ব্যাটসম্যান সপাটে চালিয়ে দেয়ার পর সেটি আমার কাছে এলে আমি মিসফিল্ড করে বসি। কিছুটা নার্ভাস ছিলাম কী না! তুমি চোখ গরম করে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে। তোমার সেই রাগরক্তিম চোখ আর ঋজু ভঙ্গি দেখেই প্রেমে পড়ে যাই আমি। এরপর যে কটা দিন কলোনিতে ছিলাম, প্রতিদিনই ক্রিকেট খেলেছি তোমাদের সাথে। তারপর হুট করেই চলে যাওয়া। তোমার সাথে একান্তে কত কথা বলার ছিলো, তার কিছুই হলো না। যাকগে, অবশেষে এই জীবনসায়াহ্নে এসে যে তুমি আমার কাছে এলে, এর জন্যে আমি ভুলে যেতে পারি গত সহস্র দিনের অপরাগতা, অবহেলা, আর অনাদর। 
ওহ! জীবনসয়াহ্ন কথাটা শুনে তুমি রাগ করছো? হ্যাঁ সত্যিই, এই শব্দবন্ধটা বড়ই বুড়োটে, নিষ্প্রাণ আর বিষাদী শোনায়। তাহলে কী বলা যায়? জীবনের ট্রানজিট পয়েন্ট? এটা হয়তো খুব একটু কাব্যিক শোনায় না, তবে আমার বর্তমান অবস্থানকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এটাকেই উপযুক্ততম মনে হয়। আবারো রাগ করলে? উপস! ভুল করে ফেলেছি। স্যরি স্যরি! 'আমার' নয়, কথাটি হবে 'আমাদের'। আমরা দুজনে হাতে হাত ধরে মিশে যাব অমানিশার মন্দ্রসপ্তকে। আকাশে ছুড়ে দেবো উড়ালফানুস। তারাদের কাছ থেকে নিয়ে আসবো উজ্জ্বলতার অভিধান। তারপর সব শিখে নিয়ে আমরাও মহান আকাশে, মহাবিশ্বের বর্ননাতীত বিশালতায় নিজেদের বিলীন করে দেবো। আর ভুলে যাবো চেপে বসতে থাকা শয়তান অতীতের কূটচালসমূহ"
-রিনা, একটু দুধ খাবে মা?-উফ! তুমি যাও তো বাবা এখান থেকে! দেখছো না আমি এখন মীরুর সাথে কথা বলছি!-দুধটুকু খেয়ে নিয়ে তারপর কথা বলো। তুমি তো প্রায় কিছুই খাচ্ছো না গত কয়েকদিন যাবৎ। শরীর খারাপ করবে তো!-আমার শরীর খুব ভালোই আছে। তোমরা খামোখাই এত দুশ্চিন্তা করছো। -ডাক্তারের কথা শুনতে হয় মা। এত জেদ ধরলে চলে? তুমি না লক্ষ্ণী মেয়ে? খেয়ে নাও মা। -আচ্ছা দাও... এহ কী ভীষণ বাজে গন্ধ! এ কী খাওয়া যায়! 
মাত্র দুই চুমুক কোনমতে গিলেই পেটের যাবতীয় খাদ্যদ্রব্যাদী বমি করে উগড়ে দিলো রিনা। তার বাবা আর মা ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন মেয়ের এই ভীষণ দুর্দশা। কী সুন্দর, কী প্রাণচঞ্চল ছিলো তাদের মেয়েটা! হঠাৎ করে...
"সেই অতীত... সেই বিচ্ছিরি অতীত...
হঠাৎ একদিন সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। অল্প একটু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে যেতাম। ক্রিকেট খেলতে গেলে দৌড়ে একটা রান নেয়ার পর আর দ্বিতীয় রান নিতে পারতাম না। এভাবে বেশ কয়েকবার রানআউট হবার পর খেলাটাই ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম, শরীরটা বিশ্রাম চাইছে। আমার মন ভীষণ রেগে গেলো এতে। শরীরটাকে আচ্ছা করে বকে দিলো। কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়া শরীরটা কোন প্রত্যুত্তর করলো না। শেষতক শরীর আর মনের পতাকা বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তে আমার কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া সাব্যস্ত হলো। আর তখন থেকে নানারকম উটকো লোক এসে বিরক্ত করতে থাকলো। উৎসাহী আত্মীয়স্বজন, উপযাচক চিকিৎসক, সহানুভূতিশীল বন্ধু বান্ধবেরা। বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে গল্প করতে আমার ভালোই লাগতো। তবে তাদের আচরণের মধ্যে এক ধরণের করুণা প্রকাশিত হতো, যা আমার অসহ্য লাগতো। কী এমন হয়েছে যে দলবেঁধে এসে দেখে যেতে হবে! তাদের সঙ্গ ধীরে ধীরে আমার কাছে অসহনীয় ঠেকতে লাগলো। আর সেইসময় যেন রূপকথার জগৎ থেকে হাজার ক্রোশ পাড়ি দিয়ে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় করে তুমি চলে এলে। আর চারপাশের সবকিছুই রঙ ফিরে পেতে শুরু করলো। আমি সেরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু উজবুক ডাক্তার আর অবুঝ বাবা-মা তা বুঝলে তো! ওরা আমাকে আবদ্ধ করে ফেললো বাড়ির ভেতরে, ক্রিকেট খেলা বন্ধ, সাইক্লিং বন্ধ। ওরা আমাকে খেতে দিতো রোগীর পথ্য। পাতলা চিকেন স্যুপ আর কাঁচকলা ভর্তা দিয়ে জাউভাত। ইয়াক! এসব খেলে কি কেউ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে? এসব খেলে আমি শক্তি পাবো কোথায়? তানজিলের তুমুল গতির বলে ডাউন দ্যা উইকেট এসে ছক্কা মারবো কীভাবে? রোজি, ইষিতা আর অপুদের সাইকেল রেসে টেক্কা দিবো কীভাবে? এই স্তব্ধ আবদ্ধতায় আটকে পড়ে হয়তো বা আমি নিঃশেষ হয়ে যেতাম যদি তুমি না থাকতে। তোমার স্পর্শে আমার গায়ের র্যা শগুলো মিলিয়ে গিয়ে উপহার দিতো যন্ত্রণাহীন এক অপূর্ব সমদর্শিতা। গলার কাছে ফাঁস হয়ে থাকা খাবারগুলো স্লিপারে চড়ে স্লাইড করে নিচে নেমে যেতো। এভাবেই আমি এক নতুন ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আবিষ্কার করি, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে থাকি। আর তখনই আমার মাথায় জীবন থেকে মরণের মাঝখানের ট্রানজিটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার বদলে নতুন জীবনে (বোকারা যাকে মৃত্যু বলে), স্থানান্তরিত হবার চমৎকার পরিকল্পনাটি মাথায় আসে। আর তুমিও এতে সায় দিলে। কথা দিলে একসাথে এই পথ পাড়ি দেবার। আমি সাহস পেলাম, শক্তি পেলাম। তারপর থেকেই আমি আর এইসব বিস্বাদ ঔষধ, জঘন্য খাবার, করুণামিশ্রিত চোখ, কৃত্রিম সহানুভূতি, ক্রিকেট অথবা সাইক্লিং না করতে পারার আফসোস, সবকিছুকে নির্বিকারভাবে অগ্রাহ্য করে এই আনন্দভ্রমণের জন্যে কাউন্টডাউন করতে লাগলাম।" 
-রিনার অবস্থাটা বেশ ক্রিটিকাল পর্যায়ে চলে গেছে। অবস্থার অবনতি যদি এই হারে হতে থাকে, তাহলে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে ওর আয়ু আর বেশিদিন নেই। মাসখানেক বড়জোর। আমরা অবশ্য একটা লাস্ট ট্রাই করতে পারি। খুব এক্সপেনসিভ এবং জটিল একটা অপারেশন করতে হবে। সেখানে অবশ্য সাফল্যের সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু এ ছাড়া আর কোন গতি দেখছি না। আপনারা কি এটা করাতে ইচ্ছুক? -জ্বী। শেষ চেষ্টাটা করে দেখা যাক। -আচ্ছা। আপনাদের একটা কনসেন্ট ফর্মে সাইন করতে হবে।
"এই যে রাজপুত্তুর, কিছু বুঝতে পারছো? নাহ, তোমার এই সরল ঔদাসীন্যে তুমি অনেক কিছুই ওভারলুক করো। চারিপাশের খোঁজ-খবর তো রাখো না কিছুই। ওদের ষড়যন্ত্রটা টের পাচ্ছো? ওরা আমাকে কাঁচঘেরা, শব্দরোধী এক বিষাক্ত ঘরে নিয়ে যাবে। যেখানে একবার গেলে আর কেউ ফিরে আসে না। মৃত্যু। আমি খুব ভয় পাই মরে যেতে। নিঃশব্দ একটা ঘরে মুখোশে ঢাকা একদল মানুষের ছুরি কাঁচির নিচে আমার রক্তাক্ত দেহকে ওরা ঢেকে দেবে সাদা চাদর দিয়ে। আমার খুব শীত করবে হয়তো। হয়তো তখন আমি এতদিনের উপেক্ষা করা যন্ত্রণাকে শতগুণ বিবর্ধিত অবস্থায় সহ্য করব। আমি পারবো না, পারবো না! আমার খুব কান্না পাচ্ছে। তুমি কবে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে বলো তো? সময় কিন্তু বেশি নেই। ওরা ওৎ পেতে আছে আমাকে ধরার জন্যে। তবে আমি খুব সজাগ থাকি সবসময়। রাতে ঘুমোই না। আসলে সত্যি কথা বলতে কী, প্রচণ্ড বেদনা হয় সারা শরীরে। ঘুমোতে পারি না। আমি এতদিন সব সহ্য করতে পেরেছিলাম তোমায় ভেবে, আমাদের আত্মহত্যা পরবর্তী নতুন জীবন শুরু করার আশ্বাসে। কিন্তু এখন আর পারছি না। তোমাকে বলতে ভয় লাগে। কারণ তুমি এতদিন আমাকে জেনে এসেছো প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর, ভয়ডরব্যথাবেদনাহীন উচ্ছল এক তরুণী হিসেবে। সেই মেয়ে যদি সংসারের হাল টানতে টানতে ক্লান্ত, বৃদ্ধাবয়সী অসুখে জর্জর, সারাক্ষণ ব্যথায় কোঁ কোঁ করতে থাকা মহিলার মত কাতরাতে থাকে তাহলে তুমি আমাকে অগ্রাহ্য করবে না তো? মনে করবে না তো, পরের জনমে দুজনে একসাথে মিলে বসতি গড়ার আনন্দভ্রমণের যে বৈপ্লবিক পরিকল্পনা করেছিলাম, তা ছিলো শুধুই আমার আনন্দভ্রম? তুমি ভাববে না তো আমি এই ভ্রমণের জন্যে মোটেও উপযোগী নই, আমি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবো? এই যে, শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা? আমার বেডের পাশের দেরাজটাতে এক কৌটো ফেনোবারবিটন আছে। খুব সাবধানে ওটা বের করে নিয়ে এসো। কেউ যেন টের না পায়। হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত সময়। নাউ অর নেভার! পালাতে হবে, পালাতে হবে আমাদের এই ভয়াবহ বন্দীদশা থেকে। আমি এখন খুব উত্তেজিত বোধ করছি। শারীরিক ব্যথা বেদনা কিছুই অনুভব করছি না। আমি তৈরি, হ্যাঁ আমি তৈরি। তুমি কোথায়? কোথায় হারিয়ে গেলে? আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো না? "
-এই, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? খবরদার, খবরদার বলছি থামুন! বাবা! মা! তোমরা ওদের ভয়াবহ চক্রান্ত বুঝতে পারছো না? ওরা কেউ মানুষ নয়। ওরা দানব। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে বাঁচাও তোমরা। আমি এত সহজে মরতে চাই না! নাহ তোমাদের কিছু বলে লাভ হবে না। মীরু কোথায়, মীরু! তোমরা মীরুকে মেরে ফেলেছো। আমাকেও মেরে ফেলবে, তাই না? -চুপ কর মা! কিচ্ছু হবে না তোমার। তুমি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। তখন তুমি যত খুশী ক্রিকেট খেলবে, সাইকেল চালাবে, সালসা ড্যান্স শিখবে, আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে যাবে...
অপারেশন টেবিলে শায়িত রিনা আতঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মুখোশ পরা মুখগুলোর দিকে। অতঃপর এ্যানাসথেটিস্ট তার চেতনা নাশ করে। 
শহরের অপরপ্রান্তে মীরু তখন এলভিস প্রেসলির গানের সাথে নাচছে, 
"It's now or never,come hold me tightKiss me my darling,be mine tonight

৮।কসমিক সিম্ফোনি... (সায়েন্স-ফিকশান) পর্ব-১

মহাকাশযান নরমেন্ডির মিটিং রুমে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তাদের সামনের ডিসপ্লে স্ক্রীনে। ছোট বড় নানা রকম ডিসপ্লে বোর্ডে নরমেন্ডির তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ, গতিবিধি এসবের নিখুত হিসেব দেয়া আছে। প্রতি মুহূর্তে তা পরিবর্তিত হচ্ছে।
লিও এই অভিযানের দলনেতা। এটা তার দ্বিতীয় অভিযান। প্রথম অভিযানে সিন্ড্রা গ্রহের এককালে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল প্রমাণের পর বিজ্ঞান পরিষদ তাকে দ্বিতীয়বারের মত আরেকটি মিশনে পাঠিয়েছে। অথচ বয়সে সে তেমন বড় না। অন্তত দলনেতা হবার মত নয়। মাত্র পচিশটি বসন্ত পেরিয়েছে সে। এর মাঝে বেশ কিছু বছর কেটে গেছে শুধু মাত্র এক স্পেস স্টেশন থেকে আরেক স্পেস স্টেশনে কাজ কাজ করতে করতেই। পৃথিবী দেখা হয় নি বহু বছর ধরে। মনে মনে সে ভেবে রেখেছে এই মিশনের শেষে বিজ্ঞান পরিষদকে অনুরোধ করবে কয়েকটা দিনের জন্যে তাকে পৃথিবীতে ছুটি কাটাতে সুযোগ দেবার জন্যে।
লিওর সহকারী হচ্ছে জিম। সিড্রা মিশনেও সে একি সাথে ছিল। শক্ত পোক্ত শরীরের অধিকারী জিমকে দেখলেই প্রথমে ইন্টার স্পেস রেঞ্জারদের কেউ বলে ধারণা হতে পারে। খুলি কামড়ে ধরা মিলিটারি ছাটে চুল কাটা জিমকে দেখলে তা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে সে একজন এটমিক ইঞ্জিনিয়ার। নরমেন্ডির নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটরের মেইন্টেইনেন্স করা তার কাজ।
আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো এখানে? অস্বস্থির সাথে জিজ্ঞেস করল ইরা। দশটা অরবিট দেওয়া এর মাঝে শেষ হতে চলল। লিওর দিকে ফিরে বলল ইরা, চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
এই নরমেন্ডির একমাত্র জীব বিজ্ঞানী ইরা। তার ই৫৫ ভাইরাসের জীন কোড আবিষ্কার করার মাধ্যমে বিজ্ঞান পরিষদে একজন উঠতি জীব-বিজ্ঞানী হিসেবে নামডাক বেড়ে যায় তার। নীল চোখ আর লম্বা সোনালী চুলের অধিকারী ইরাকে প্রথম দর্শনে দেখলে মোটেও বিজ্ঞানী হিসেবে মনে হয় না। লিও মাঝে মাঝে ভাবে তাকে হয়তো অভিনেত্রী হিসেবে ভালো মানাতো! সে খেয়াল করে দেখেছে ইরা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন নাটকের লাইন আবৃত্তি করে বেড়ায়! হয়তো নাটকেই কাজ করার ইচ্ছে ছিল তার! কে জানে?
কিরু২ আঙ্গুল তুলে ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে নির্দেশ করল। দেখো সবাই, দেখে তো মনে হয় স্পেসস্টেশনটা একই গতিতে অর্বিট করছে নিজের অক্ষের চারপাশে। কোন অদ্ভুত ব্যাপার তো নেই মনে হচ্ছে।
সবাই তার নির্দেশিত স্পেস স্টেশানটার দিকে তাকালো। পুরোনো আমলের চতুর্থ জেনারেশন এর একটা স্পেসস্টেশন। প্রায় ষাট বছর ধরে এই কন্সটেলেশনে ডেটা সংগ্রহ করে যাচ্ছে। দেখতে বিশাল একটা ব্যারেলের মত। মাঝে একটা সমান ব্যাসের গর্ত আছে যা একেবারে কেন্দ্র পর্যন্ত চলে গেছে। চারপাশে অনেক এন্টেনা বের হয়ে আছে যোগাযোগ মডিউলকে সাহায্য করার জন্য। এখনকার স্পেসস্টেশনে যেটা দেখা যায় না।
কিছু ঘটে না থাকলে তো তৃতীয় মাত্রার সতর্ককারী বীকন নিক্ষেপ করত না তারা! আনমনে অদ্ভুত স্পেসস্টেশনটার দিকে তাকিয়ে থাকল জেনা। এই মহাকাশযানের শেষ অভিযাত্রী। কম্পিউটার প্রোগ্রামিঙ্গে তার দক্ষতার জন্যে বিজ্ঞান একাডেমী বিখ্যাত টরেন পদকে ভূষিত করেছে তাকে। জেনা খুবই কম কথা বলে। একমনে হয়তো দূরের কোন নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আঙ্গুল মুখে ঢুকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে। কেউ যানে না কি নিয়ে সে এত চিন্তা করে। তবে লিও একবার সেন্ট্রাল ডেটাবেসে খবর নিয়ে দেখেছিল জেনার সাথে একটা ঘটনা ঘটার পর থেকে সে এমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে সে অনেক চনচল ও প্রাণবন্ত মেয়ে হিসেবেই পরিচিত ছিল। কি ঘটনা ঘটেছিল তা জানতে পারে নি লিও। ব্যাপারটা নাকি অনেক গোপনীয়, বিজ্ঞান একাডেমীর কম্পিউটার তাকে অথরাইজ করে নি।
যাই হোক, কি হয়েছে এটাই তো বের করতে এসেছি আমরা নাকি? একটু হাসল লিও। আমার মনে হয়না তেমন কিছু বড় ব্যাপার ঘটেছে। আসলে আদি কালের স্পেস স্টেশান তো! তাই ভুলে কিছু সিগনাল পাঠিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু তা হলে সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে যখন বিজ্ঞান একাডেমী যোগাযোগ করতে চাইলো, তখন তারা কোন প্রকারের সাড়া দিলো না কেন? লিওর কাছে জানতে চাইলো কিরু২।
কিরু২ এর লাল চোখসুলভ সেন্সরের দিকে তাকালো লিও, ঘাড় ঝাকিয়ে স্রাগ করলো। হয়তো তাদের যোগাযোগ মডিউলের সমস্যা ছিল তাই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যাই হোক আমাদের সর্বোচচ সতর্কতা নিতে হবে। তৃতীয় মাত্রার সতর্ক সংকেত হালকা কিছু না। মহাকাশযান বিপন্ন হবার সম্ভবনা দেখলেও তৃতীয় সংকেত পাঠানো হয় না…
তৃতীয় সংকেত এর মানে কি? সামনে এগিয়ে জিজ্ঞেস করল ইরা।তৃতীয় সংকেত মানে হল মানবজাতি বিপন্ন হবার মুখে… গম্ভীর সরে জবাব দিল কিরু২।সবাই তার কপোট্রনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার কথা বিশ্বাস না করার কারণ নেই। কিরু২ দশম প্রজন্মের সেরা রবোট, মানব মনের সকল অনুভূতি দিয়েই তৈরি করা হয়েছে তাকে। এমনকি একটা মানুষের সমান মর্যাদা তাকে দেওয়া হয়েছে। তার মেমোরির মাঝে কি চিন্তা চলছে তা খুলে দেখাও পনচম মাত্রার অপরাধ। 
জিম গলা পরিষ্কার করে বলল, তাহলে আমাদের স্যুট আপ হয়ে থাকা উচিৎ। আর ডিফেন্স ম্যাকানিজম আরেকবার চেক করে দেখি…
তার দরকার হবে না। লিও তাকে বাধা দিল। আমি ট্রিনিট্রিকে বলে দিয়েছি আগেই। সে আমাদের এটমিক ব্লাস্টার আর স্পেস টু স্টেশান (এস২এস) টর্পেডো সিস্টেম অনলাইন করে রেখেছে।
শোন সবাই, টেবিলের উপর ভর দিয়ে দাড়ালো লিও। এটা কোন মিলিটারি স্পেস শিপ নয়। আর আমাদের কাজও মিলিটারি এসল্ট নয়। আমরা এখানে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যেই এসেছি। বিজ্ঞান একাডেমীও ব্যাপারটা হালকা ভাবেই নিয়েছে। তাই আমরা এখানে কি হয়েছে দেখে রিপোর্ট করেই চলে যাব। যদি কিছু সন্দেহজনক না থাকে…
আর যদি থাকে? ইতস্তত করে বলল ইরা।থাকলে… তাহলে ব্যাপারটা কি তা আমাদের দেখে আসতে হবে। গলা খাখরি দিয়ে বলল লিও। কিন্তু আমার মনে হয় না এমন কিছু… বিজ্ঞান একাডেমিও…
তাহলে এখনো তারা কেন কোন উত্তর পাঠাচ্ছে না। আচমকা বলল জেনা। মানে?মানে আমি এতক্ষণ ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি তারা কোন জবাব পাঠাচ্ছে না। গম্ভীর হয়ে বলল জেনা।
হতে পারে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাধ ঝাকাল লিও। আসলেই তাদের যোগাযোগ মডিওলটা গেছে। শোন! গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে। এখন আপাতত স্কেনার আর স্কাউটশীপ পাঠাচ্ছি। তাদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে পরবর্তি পদক্ষেপ কি হবে তা ঠিক করব। এখন যাও সবাই, যতটা পারো বিশ্রাম নাও। ট্রিনিটি, মিটিঙ্গের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হল।
মহাকাশযান নরম্যান্ডির সেন্ট্রাল কম্পিউটার ট্রিনিটি তার উজ্জ্বল বিপ বিপ আওয়াজ তুলে বড় স্কীনটা বন্ধ করে দিল।
( চলবে)

৯। কসমিক সিম্ফোনি... (সায়েন্স-ফিকশান) পর্ব-২

নিজের কেবিনে বসে আছে লিও। গালে হাত রেখে বাইরের অনন্ত বিস্তর মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সুইভেল চেয়ারটা আলতো করে এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে আর গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। মন বলছে কোথাও একটা ঘাপলা আছে। এই মিশনটা যেন হঠাৎ করেই দেয়া হল তাকে। আর তৃতীয় মাত্রার সংকেত পাওয়া একটা ঘটনা বিজ্ঞান পরিষদ কিভাবে এতটা সহজভাবে দেখছে তা বোধগম্য হল না তার। সে আশা করেছিল আরো অবিজ্ঞতাসম্পন্ন, দক্ষ দলনেতাকেই এই মিশনে দায়িত্ব দেবে তারা। 
ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। হয়তো তারা ভেবেছে এটা ফলস সিগনাল ছাড়া কিছু না।
চেয়ার থেকে উঠে গ্লাসের বিশাল উইন্ডো স্কীনের সামনে দাড়ালো লিও। এখান থেকে পুরো মহাকাশটাই যেন দেখা যাচ্ছে। শুধুমাত্র পাতলা একটা ট্রান্সপারেন্ট আবরণ… আর তার পরেই রয়েছে অসীম শুন্যতা…
ট্রিনিটি… শুনতে পাচ্ছো? মৃদু স্বরে বলল সে।
অবশ্যই মহামান্য লিও। একই ভঙ্গিতে স্পীকার থেকে ভেসে এল ট্রিনিটির গলা।তৃতীয় মাত্রার সংকেত অনেক বড় একটা ব্যপার তাই না?জ্বী মহামান্য লিও। মানবজাতির ধ্বংসের সম্মুখিন হলে এই মাত্রার সংকেত দেওয়া হয়। 
তাহলে আমাকে কেন পাঠানো হল? মানব জাতির অন্তরায়ের মুহুর্তে বিজ্ঞান একাডেমি কি আরো বিচক্ষণ লোককে খুজে পায় নি?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই মহামান্য লিও। আপনার দক্ষতার উপর বিজ্ঞান একাডেমির যথেষ্ঠ আস্থা রয়েছে। নাহলে এই মিশনে অন্য কাউকেই তারা অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করত।
কিন্তু চিন্তা করে দেখো, মহাকাশের দিক থেকে যোগাযোগ মডিউলটির দিকে দৃষ্টি ফিরালো লিও। আমি শুধু সিন্ড্রা মিশনে ছিলাম, জিমেরও প্রথম মিশন ছিল সেটা। ইরারও তেমন অবিজ্ঞতা নেই। শুধু কিরু২ আর জেনারই মোটামুটি অবিজ্ঞতা আছে বড় মিশনে যাবাব মতো। ব্যপারটা কি অদ্ভূত নয়?
আপনার যুক্তি বুঝতে পারছি মহামান্য লিও। অযথা চিন্তা করবেন না। বিজ্ঞান পরিষদ যেনে বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি না…
যদি না কি? উপরের দিকে তাকাল লিও। থামলে কেন?
মাফ করবেন মহামান্য। এটা বলার ক্লেয়ারিফিকেশান নেই আমার। চতুর্থ ধারার দ্বিতীয় মাত্রার অপরাধ।
চিন্তিত ভঙ্গিতে চিবুকে হাত বুলালো লিও। চতুর্থ মাত্রার যে কোন অপরাধই বিনা বিচারে যাবতজীবন নির্বাসনের সমতূল্য। আর দ্বিতীয় মাত্রার হলে তো আরো অনেক কঠিন ব্যপার।
ট্রিনিটি আমি এই অভিযানের দলপতি। আমার কাছে থেকে লুকাবে তুমি?আমি সত্যিই দুঃখিত লিও। এক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।
দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে আবার মহাকাশের দিকে ফিরল লিও। দূরে দেখা যাচ্ছে স্কাউট শীপগুলো। তাদের ডানার নিচের সতর্কতামুলক লাল রঙের লাইটগুলো জ্বলছে নিভছে। যে কোন সময় পর্যাপ্ত ডেটা সংগ্রহ করে চলে আসবে স্কাউটশীপ গুলো। দূরের প্রান্তরে বিশাল ডালাকৃতির স্পেসস্টেশনটার দিকে চোখ আটকে গেল তার। সিলিন্ডার আকৃতির স্পেসস্টেশনটার মাঝখানে চোখের মত গর্তটি আর্টিফিশিয়াল গ্রেভিটির জন্যে নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরছে। দেখে লিওর মনে হলো তার দিকে চোখটি তাকিয়ে আছে। বাটন টিপে গ্লাস উইন্ডোটা অন্ধকার করে দিল লিও।

১০।রূপাজীবী

কীভাবে এতোটা সময় আমাকে আমার কাছে থাকতে হবে ভাবতেই পারি না।রাজপথের কংক্রিটে, পিচের উদরে, কাভার্ড ভ্যানের চাকায় পিষেঅহরহ মরতে দেখেছি সোনালু, কৃষ্ণচূঁড়া ও বৃক্ষের অনাথ পাতা কেওদের রক্তে আজ যত্রতত্র গজে ওঠেছে শহীদ মিনার। আমি উদগ্রীব।
সমান্তরাল দুইশ ছয়খানা হাড্ডি দিয়ে ঈশ্বরদিয়াশলাই না বানিয়ে আমাকে মানুয করায় আমি বিষ্মিত, ক্ষুব্ধ।আমার দেহে ম্যাগমার উত্তাপআমি মানুষ, মানতে পারি না ।অলিয়েস ফ্রসেজে জীবিত আছে সভ্যতা, মানতে পারি না।ইতিহাসের যে সব খরস্রোতা নদীতে এখনো চলাচল করে মিথ্যার ইস্টিমারআমি তার গায়ে থুতু দেই।
ছাপার ডাইসের কবিতা- রঙ্গীন অলীক আশ্বাস আমি বিশ্বাস করি না।প্রিয়তমার হাত- বিশ্বাস করি না।মুক্ত বাজার অর্থনীতি- বিশ্বাস করি না।সাপের বিষদাঁত গণতন্ত্রের চেয়ে বেশী মৃত্যুমোহী- বিশ্বাস করি নাআমি বিশ্বাস করি না প্রেম, আমি বিশ্বাস করি না মোহ ও অলিন্দেআমি বিশ্বাস করি আগুনে, কালো দ্রোহে।আমি বিশ্বাস করি এ পৃথিবীকে শোষণ মুক্ত করতে পারেকেবল সংগবদ্ধ আগুন।
আমার স্থির বিশ্বাস আমি আবার মানুষ থেকে দিয়াশলাই হবো।সাড়ে তিন কোটি জাহান্নামের অভুক্ত কীট ছেড়েছি দেহেওরা আমাকে খেয়ে সাবাড় করুক, দ্র্রুত।আমি বিশ্বাস করি তারা হয়তো অচিরেইআমাকে মুক্ত করবে আমার থেকে।আমার হাড় হাড্ডি তারাই হবে দিয়াশলাই, তারাই জ্বালাবে আগুনএ পৃথিবী, তামাম নক্ষত্র জ্বলবেজ্বলে জ্বলে থিতু হবে। থিতু হবে সকল বর্ণহীন সত্য।

 
 
 

 
Share this article :

0 comments :

Contact Form

Name

Email *

Message *

 

About Author

Recent Comments