২১।শূন্যমাত্রিক
বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম যাত্রী ছাউনিতে বসে। প্রায় আধঘন্টা হতে চললো, বাসের দেখা নেই। আমার পাশে বসে ছিলেন দুইজন ভদ্রমহিলা, একজন ভদ্রলোক, তার সন্তান এবং কলেজ পড়ুয়া দুটি ছেলে। বসে থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত হয়ে উঠে গেছে। আপাতত আমি একা। এই যে বাসের অপেক্ষায় এভাবে যাত্রী ছাউনিতে বসে থাকা, এটাকে এক ধরণের বিলাসিতা বলা যেতে পারে। ঢাকা শহরে বাসে উঠতে হলে প্রয়োজন পেশীশক্তি, দৌড়ের দক্ষতা, এবং সূক্ষ্ণ ইনটুইশন ক্ষমতা। দূর থেকে বাসের আগমন দেখে আগেভাগেই প্রস্তুত হয়ে সবাইকে পিছে ফেলে দৌড়িয়ে কোনমতে বাসের পাদানিতে পা রাখতে পারলে তবেই তাকে দক্ষ নাগরিক বলা যেতে পারে। আমিও এভাবেই বাসে উঠি। কিন্তু আজ আমার অত তাড়া নেই। সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়েছি। যাত্রী ছাউনিতে বসে বাদাম খেতে খেতে মানুষ দেখতে ভালো লাগছে। অবশ্য এখানে প্রায় সবাই একই রকম দেখতে। বাসে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, ঘামে জর্জর মানুষগুলো বাসায় ফিরলেই তবে তাদের প্রকৃত রূপ ফিরে পাবে। ঘরে ফেরাটা কী সুন্দর, কোমল; আর রাস্তায় তারা বদমেজাজী, ঝগড়াটে, খিস্তিবাজ ! তবে এদের মধ্যে একজনকে দেখে বেশ আলাদা লাগলো। তাকে লক্ষ্য করছি মিনিট পাঁচেক ধরে। জলপাই রঙের গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট আর বদখত ঢোলা একটা শার্ট পরা। মাথায় ক্রিকেট খেলোয়ারদের মত একটা ক্যাপ পরে আছে। কাঁধে একটা শান্তি নিকেতনী ব্যাগ। সেখান থেকে কী যেন একটা কাগজ বের করে বিলি করছে সবার কাছে। কাগজ দেয়ার সময় কী কী যেন বলছে, দুর থেকে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ মানুষই বিরক্ত হচ্ছে। কেউ কেউ বেশ গলা চড়িয়ে ধমক দিচ্ছে। কৌতুহলী কেউ কেউ অবশ্য কাগজ নিচ্ছে। তাদের বেশিরভাগই উঠতি তরুণ। কিছুক্ষণ পর সে বিশ্রাম নেবার জন্যে আমার পাশে এসে বসলো। আমি কিছুটা বিরক্তি কিছুটা আগ্রহ নিয়ে তার ঝোলাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বিলি করছে সে? আমার আগ্রহ ভরা চোখ তার দৃষ্টি এড়ুলো না। সে একগাল হেসে আমার উৎসুক দৃষ্টিকে দক্ষ ফিল্ডারের মত ক্যাচ করে নিলো! -কী ভাইজান! আগ্রহা লাগে ভিতরে কি আছে দেখার জন্যে? -তা তো কিছুটা লাগেই! -এর ভিতর আছে টেলিফোন নাম্বার। হাজার হাজার টেলিফোন নাম্বার। আমি ফ্রি বিলি করি মানুষের কাছে। সমস্যা হইলো, মানুষ ফ্রি জিনিস নিতে চায় না। সন্দেহ করে। অবশ্য সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। খামোখা টেলিফোন নাম্বার বিলি করতে কেই বা কবে দেখছে! -হু বুঝলাম। কিন্তু আপনি টেলিফোন নাম্বার বিলি করেন কেন? এতে আপনার লাভ কী? আর নাম্বারগুলোই বা কাদের?-অনেক প্রশ্ন একসাথে কইরা ফেললেন। খাড়ান, জবাব দেওয়ার আগে গলাটা একটু ভিজায়া নেই।সে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। বোঝাই যাচ্ছে খুব তৃষ্ণার্ত। পানি পান শেষ করে গল্প শুরু করলো আবার।-একসময় আমার ফোনে কথা বলার খুব নেশা ছিলো। যে কোন খান থেকেই নাম্বার পাই না কেন, বাথরুমের দেয়ালে, স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে, টাকা-পয়সায়, পার্কের বেঞ্চিতে; আমি নাম্বারগুলা কালেক্ট করতাম। প্রতিটা নাম্বারেই একবার অন্তত মিসকল দিছি আমি। অনেকেই কলব্যাক করতো। ভুল করে মিসকল দিয়ে ফেলছি এই বলে লাইন কেটে দিতাম। তা সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন! -অদ্ভুত তো! কেন এমন করতেন? সে আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলতে থাকলো,-তো এভাবে নাম্বার যোগাড় করতে করতে হাজারের ওপর হয়া গেলো। তখন ঠিক করলাম অনেক তো পেলাম, এখন দেয়ার পালা। আমি দ্বিগুণ উৎসাহে নাম্বার যোগাড় করতে লাগলাম। এবার আরো কম সময়ে ১০০০ নাম্বার পেয়ে গেলাম। এইগুলাই এখন মানুষের মাঝে বিলি করি। -কিন্তু এসব করে আপনার লাভ কী বললেন না? -লাভ কিছু না। আমার দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে। অনেকেই আমার দেয়া নাম্বারে ফোন-মিসকল দিতে যায়া প্রেম-বন্ধুত্ব পাতায়া ফেলে। এসব দেইখা আমি বড়ই আনন্দ পাই।-দূর থেকে দেখা মানে? আপনি কি যাদেরকে নাম্বার দিচ্ছেন তাদের বেডরুমে ঢুকে পড়েন? অচেনা-অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই যেখানে ক্ষীণ সেখানে আপনি তাদের প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব দেইখা ফালান? কী আজগুবী কথা! -হ, আজগুবীই বটে। অনেক কথা বললাম। যাই এখন। যাওয়ার আগে আপনাকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে যাই। এটা হয়তো আপনার কাছে খুব আজগুবী মনে নাও হইতে পারে। লোকটা চলে গেলো। কতরকম মানুষ যে আছে এই ঢাকা শহরে! আলগোছে কাগজটা তুলে নেই আমি। একটা ফোন নাম্বার লেখা। নাম্বারটা কেন যেন আমার খুব পরিচিত মনে হয়। কার নাম্বার ছিলো যেন এটা? পকেটে রাখা ফোনটা তীক্ষ্ণ চিৎকারের সাথে ভাইব্রেট করছে। অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করার পর ও পাশ থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়। কান্নার শব্দ। একজন তরুণী কাঁদছে। কী যে হাহাকার সে কান্নায়! কী যে ব্যাকুল করা অশ্রূস্রোত! ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমায়। ঘটনাটির অস্বাভাবিকতা আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেললো না। বরং এটাই মনে হতে লাগলো যে, হঠাৎ করে কোন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসা এবং ওপাশ থেকে তরুণীর কান্নার শব্দ শোনা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বরে সে যেন আরো উৎসাহিত হলো কাঁদতে। তারপর হঠাৎ করেই কলটা কেটে গেলো। আমি তৎক্ষণাত তাকে কল করতে গিয়ে পূর্বানুমান অনুযায়ী ফোনটি বন্ধ পাই। কী মনে করে যেন পাগলাটে লোকটার দেয়া কাগজটার সাথে ফোন নাম্বারটা মিলিয়ে দিতে গিয়ে দেখি সব ঠিকই আছে, শুধু শেষের সংখ্যাটায় গরমিল। লোকটির প্রদেয় নাম্বারটিতে শেষ ডিজিট ৯, আর ক্রন্দসী মেয়েটার শেষের ডিজিট ৫। অদ্ভুত। সত্যিই অদ্ভুত। এই দিনটার কথা ভোলা যাবে না কখনও। "মাঝরাত্তিরে চাঁদের কাস্তে/ ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে"বারান্দায় বসে সুমনের গান শুনতে শুনতে রাতের আকাশের দিকে তাকাই। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ। চাঁদটাকেও কাস্তের মতো লাগছে দেখতে। গাছ-গাছালির শরীরে আবেদনময়ী নায়িকার মতো অল্প-স্বল্প জোছনার পোষাক। প্রকৃতিচারণে মগ্ন হয়ে কেমন যেন একটা ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। এই সময়ে ফোন এলো। অচেনা নাম্বার। আবারও সেই বুকে তুফান তোলা কান্না। আবারও আমার মনে হাজারো জিজ্ঞাসা। কিন্তু সে কোন প্রশ্নের জবাব দেয় না। কাঁদতেই থাকে অনবরত। কাঁদতেই থাকে। তার কান্নাটা আমার খুব পরিচিত লাগছে। এভাবে কে কাঁদতো? কাউকে কি আমি কাঁদিয়েছি এমন করে? মনের নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঘাঁই মারতে থাকে মাংসখেকো মাছেরা। মনে পড়ছে...মনে পড়ছে...-তুমি কি জিনাত? প্রশ্নটি করার সাথে সাথে লাইন কেটে গেলো। এরপর সে ফোন বন্ধ করে রাখবে, এ কথাটা জানা স্বত্তেও আমি ডায়াল করি আবার। বেশ কয়েকবার। নাহ! বুঝে গেছি আজ রাতে আর ফোন চালু হবে না। মাথায় একগাদা ধূসর স্মৃতি, আর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন জমে গিয়ে প্রচণ্ড ভারি করে তুলেছে ওটাকে। ঘুম দরকার। একটা লম্বা ঘুম। জানি না মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো মেরি-গো-রাউন্ড খেলে আমাকে ঘুমুতে দেবে কি না। জিনাতের কথা এতদিন কীভাবে ভুলে ছিলাম আমি! জিনাতের ধারণা ছিলো সেই আমার প্রথম প্রেম এবং সারাজীবন আমি তাকে সাথী করেই থাকবো। বড্ড পিউরিটান মনোভাবের গ্রাম্য মেয়ে ছিলো সে। অনেক সাধাসাধি করে তার হাত ধরতে পেরেছিলাম। আর চুমু? সে তো দূর অস্ত। মাঝে মাঝে যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, শ্যামলা, লাজুক মেয়েটির মুখে যেন হাজার মোমবাতি জ্বলে উঠতো। সে হয়ে উঠতো দ্যূতিময়। তার এই দ্যূতি সংরক্ষিত ছিলো শুধুমাত্র আমার জন্যে। কিন্তু হায়! সে আমাকে যা দিতে চেয়েছিলো তার কিছুই আমি নিতে পারি নি। আমি ক্রমশ কামুক এবং বেহায়া হয়ে উঠছিলাম। আমি তো আর শুধু হাত ধরার আমলের অবাস্তব বোকা বোকা নায়ক নই! আমার লকলকে লোলভরা লোলুপ লাল জিভ চাইতো ওকে চেটেপুটে খেয়ে শেষ করে দিতে। ওর দ্যূতি, আমার বিচ্যুতি। একদিন বিচ্যুতি পর্যায় থেকে আমি উড়ে গেলাম বৈপ্লবিক বিকৃতিতে। ওর ঠোঁটে, বুকে,গালে, পেটে পাগলের মত চুমু খেতে লাগলাম। ওকে প্রায় বিব্রস্ত করে ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যায়ে আর যাওয়া হলো না কারো আগমন ধ্বনি শুনে। যাওয়ার সময় আমি ওকে শাসিয়ে গেলাম, এই ঘটনা কাউকে বললে একেবারে খুন করে ফেলবো। তার চোখ ছিলো অশ্রূসজল। সে অল্প অল্প ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। জিনাতের সাথে এর পরেও আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। সে ছিলো বিবর্ণ, দীপ্তিহীন। আমি কয়েকবার তাকে স্যরি বলে সম্পর্কটা আবারও জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে পেয়েছিলাম তার নির্বাক দৃষ্টি, অশ্রূসিক্ত চোখ। একদিক দিয়ে ভালোই ছিলো সেটা। এরকম একটা সেকেলে, ন্যাকা মেয়ের সাথে সারাজীবন কাটানো চরম বোরিং হবে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এতদিন পর সে ফিরে এলো কী মনে করে? আর ফিরলোই যখন, খামোখা ফোন করে কাঁদার কী মানে! এটা এক ধরনের বাজে প্র্যাঙ্ক ছাড়া আর কিছু না। সেই ফোন নাম্বার বিলি করে বেড়ানো পাগলাটে লোকটার সাথে কী ফন্দী এঁটেছে কে জানে! অবশ্য জিনাতকে যতটা চিনি, সে এমন করার মেয়েই না। একবার কাউকে ছেড়ে গেলে সে কখনও তার কাছে ফিরে আসবে না। কী যে হচ্ছে আজ! জিনাতের কথা মনে করে মনটা খারাপ লাগছে। আরেকবার যদি ফোন করতো, তাহলে খুব করে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। ফোনটা বাজছে। রাত একটা বাজে। আবারও সেই ভূতুরে কল? কাঁপাকাঁপা হাতে কল রিসিভ করলাম আমি। ওপাশ থেকে মৃদু লয়ে কেঁদে চলেছে কেউ। আগের মত অত তীব্র না। যথারীতি লাইনটা কেটে দিলো কিছুক্ষণ পর। রিসিভড কলের লিস্টে দেখি, এইবার যে নাম্বারটি থেকে ফোন এসেছিলো, সেটার শেষে পাঁচ নয়, ছয়! কী হচ্ছে এসব? আমার মতিভ্রম হলো না কি! প্রথম প্রথম লোকটার অদ্ভুত আচরণকে পাগলাটে এবং খেয়ালীপনা মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন ব্যাপারটাকে মোটেও সামান্য বলে মনে হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটাকে একটা লজিক্যাল প্যাটার্নে ফেলতে গিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে যাই। লোকটার প্রস্থানের পর পরই মেয়েটার ফোন আসা, এ না হয় মানলাম। বারান্দায় প্রকৃতি দেখার সময় সে ফোন করেছিলো এটাও না হয় মানা গেলো। কিন্তু বিছানায় শুয়ে যখন জিনাতের কথা ভাবছিলাম, তার সাথে আমার কৃত অসদাচরণের কথা ভেবে যখন অনুতপ্ত হচ্ছিলাম তখন কেন জিনাতের ফোন আসবে? আর তখন কেন সে সেই সর্বগ্রাসী, এলোমেলো করে দেয়ার মতো ডুকড়ে ডুকড়ে কান্নার বদলে মৃদু লয়ে ফোঁপাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতেই হবে। এখন সেই রহস্যময় লোকটাকে জায়গা মত পেলে হয়!আজও যাত্রী ছাউনিতে বসে আছি। বাসের অপেক্ষায় নয়। সেই লোকটার জন্যে। আজকে আসবে কি? সদ্য পরিচিত কারো সাথে এ্যাপয়নমেন্ট না করে অপেক্ষা করলে সেটা ফলপ্রসু হবার সম্ভাবনা খুব কম। তারপরেও অদম্য কৌতুহল আর রহস্যভেদী মন হাল ছাড়ে নি। এইসব হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা আর চমক কতটা কাকতালীয় অথবা কতটা অতিপ্রাকৃত, এমন চিন্তায় গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে। হ্যাঁ, সেই লোকটাই। এত তাড়াতাড়ি তার দেখা পেয়ে যাবো ভাবি নি। লোকটা হয়তো বা আগে থেকেই জানতো অথবা অনুমান করেছিলো যে আমি আবার ফিরে আসবো এখানে। তার সাথে কী বলে আলাপ শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নেয়ার পর থেকে কী সব ঘটছে এগুলো প্রথমেই বললে লোকটা পেয়ে বসবে আমাকে। হয়তো বা সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকাও চেয়ে বসতে পারে। তাই আমি আমার অপ্রতিরোধ্য কৌতুহলকে শেকলবন্দি করে উদাস দৃষ্টিতে মানুষ আর বাস দেখার ভঙ্গি করলাম। -গরমটা আজকে কী পড়ছে দেখসেন?ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পান করে সে সুধোলো। যাক, এবার আর কথা বলতে সমস্যা হবে না। প্রাথমিক দ্বিধার ভাবটা কেটে গেছে। -হু। এই অক্টোবর মাসেও এমন গরম! গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে সাবধানে থাকতে হবে।মওকা মত জ্ঞান ঝাড়তে পেরে প্রসন্ন হয়ে ওঠে আমার মন। লোকটার কাছ থেকে উত্তর আশা করছিলাম, কিন্তু সে সিগারেট খেতেই মগ্ন।আমার কথা যেন কানেই নেয় নি। সন্ধ্যা নেমে আসছে। কতক্ষণ থাকে লোকটা ঠিক নেই। অগত্যা আমাকেই উপযাচক হতে হলো।-আপনার নাম্বার বিলি করার কাজ কেমন চলছে?-ভালো। গতকাল আমার উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হইছে। একজন তার কৃতকর্মের জন্যে বহুত আফসোস করছে, ভয়ও নাকি পাইছে। -আপনি এত সব কীভাবে জানেন? কেন এসব করেন? -কীভাবে জানি, সেইটা আপাতত গোপন থাক। কেন এসব করি, কইতে পারেন এইডা আমার একটা শখ। -শখ, না? মোটেও এটা কোন সাধারণ শখ না। এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। আপনি অনেক কিছু, প্রায় পুরোটাই আমার কাছ থেকে লুকোচ্ছেন। -আমি কিছু লুকাইতেছি না ভাইজান। আমি প্রকাশ করতেছি, জাগায়া তুলতাছি। মনের অন্ধকার কোণে লুকায়া রাখা পাপকে আর কত পুইষা রাখবেন? আপনি তো মানুষ হিসেবে ঠিক অতটা খারাপ না! এহ! আসছে আমার রবিনহুড! ক্লাশলেস, আনকালচার্ড একটা গ্রাম্য মেয়ের সাথে আমার সম্পর্কের ঘটকালি করতে চায়! এইসব লোককে বহুত চেনা আছে। খালি পারে উপদেশ দিতে, যেগুলোর ব্যবহরিক বাস্তবায়ন বলতে কিছু নেই। রেগেমেগে আমি লোকটার সাথে দুর্ব্যবহার করে বসলাম। -আরে যান যান! আর উপদেশ দিতে হবে না। রাস্তা মাপেন। ঐ যে একটা ওভারব্রিজ দেখা যাচ্ছে, ঐটা দিয়ে পার হন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। দেখলেন, আমিও কেমন উপদেশ দিয়ে ফেললাম! লোকটাকে প্রায় ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমি। এমন লাঞ্চনা স্বত্তেও লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে এক গাল হাসি হেসে বিদায় সম্ভাষন জানিয়ে চলে গেলো। তার আন্তরিক হাসি দেখে আমার কেমন যেন গা শিউরে উঠলো। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, আজ কোনরকম হাঙ্গামা-হুজ্জত না করেই বাসে উঠতে পারলাম। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়, একটা সিটও পেয়ে গেলাম। মতিঝিল থেকে মিরপুর, যেতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগবে। এই সময়ের মধ্যে আমি একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে দিতে পারবো। ঘুমটা খুব দরকার। গতরাতে ঘুমই হয় নি বলতে গেলে। ঘুমানোর আগের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা আমার খুব ভালো লাগে। আধো ঘুম, আধো জাগরণ। চোখ মেলতে পারি না, তবুও যেন কত কিছু দেখতে পাই! কত বিচিত্র শব্দ কানে আসে, আবার মিলিয়ে যায়। আমি দেখতে পাই পুকুরঘাটে কাপড় ধুচ্ছে একটি মেয়ে। একটু পরে সে নাইতে নামবে। একটি ছেলে একটু দূর থেকে গাছের ডালে বসে জাম খেতে খেতে সব দেখছে। হঠাৎ একটা বিশালাকার অজগর এসে মেয়েটিকে পেঁচিয়ে ধরলো। প্রবল সেই চাপ। মেয়েটি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে এই নাগপাশ থেকে বের হতে। তার শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। সে কী মনে করে যেন গাছে বসা ছেলেটির দিকে তাকালো। আকুতি ভরা চোখের সেই অনুরোধ ফেরানো সম্ভব হলো না ছেলেটির পক্ষে। প্রাণের মায়া ভুলে, হাতে একটি খুরপি নিয়েই সে দৌড়োলো সর্পবধের জন্যে। কিন্তু কাছাকাছি এসে গেলেই এক আচানক কাণ্ড ঘটে গেলো ! সাপ নেই, মেয়েটিও নেই! মেয়েটি ততক্ষণে একটা শাপলা ফুলে পরিনত হয়েছে। হাজা-মজা পুকুরটা যেন নতুন রূপে আবির্ভূত হলো এবার। আর ফুটতে লাগলো অজস্র শাপলা ফুল। এর মধ্যে মেয়েটি কোথায়? ছেলেটি জানে এত শত শাপলা ফুলের মধ্যে তার কাঙ্খিত ফুলটা সে ঠিকই খুঁজে নিতে পারবে। কন্ডাকটরের ভাড়া নেবার তাগাদায় ঘুম ভেঙে গেলেও আমার মেজাজ খারাপ হয় না। স্বপ্নের রেশটা রয়ে গেছে এখনও। মনে পড়ে। মনে পড়ে অপ্রয়োজনীয় ভেবে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দেয়া স্মৃতির ভগ্নাংশ। তারা আজ পূর্ণ সংখ্যা হয়ে আমার ভালোবাসার সমীকরণে ধ্রুবক হয়ে থাকতে চায়। মনে পড়ে, জিনাতকে আমি বলেছিলাম, "তোমার নামটা তেমন সুন্দর না। তোমাকে আমি নতুন একটা নাম দেবো।" কী নাম দেয়া যায়! এই ভেবে যখন আমার গলদঘর্ম অবস্থা, তখনই পুকুরে ফুটে থাকা থোকা থোকা শাপলা ফুলের দিকে নজর এলো। এরপর থেকে আমি ওকে শাপলা বলেই ডাকতাম। আজ অবচেতন মনের কুটিল ষড়যন্ত্রে স্বপ্ন পরবর্তী অসাম্যবস্থায় জিনাত বা শাপলা বারবার ফিরে আসছে।এখন অপেক্ষা করছি সেই ফোন কলের। জানি, সে আসবেই। আর শেষ ডিজিটটা ছয় এর পরিবর্তে সাত হবে। প্রায় সাথে সাথেই ফোন এলো। শেষের ডিজিটটা সূত্র মেনে সাত! লাকি সেভেন। খুব কি লাকি হবে? এবার কি সে আমার সাথে কথা বলবে? কাঁদাবে না তো? নাহ। সে কাঁদছে না। কোন কথাও বলছে না। নীরবতার নীড়ে দীর্ঘশ্বাসের প্রলয় যেন আর হানা না দেয় এ জন্যে আমি সচেষ্ট থাকবো। কথা দিই তাকে। হিরন্ময় নীরবতার মৌতাতে সুরভিত হয়ে যায় চারিপাশ। আমি ক্রমশ তার কাছে আসছি। হোক না সে কোন কান্নারত বিলাপকারী গ্রাম্য তরুণী, অথবা বাকহীন,মমতাময়ী, প্রেমপিপাসু যুবতী, আমি তাকে কাছে টেনে নিতে প্রস্তুত। -শাপলা! কথা বলো প্লিজ! আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না। আমি অনুতপ্ত আমার কর্মের জন্যে। তুমি শুধু আর একবার বলো, আমি...লাইনটা কেটে গেলো আবার!খুব এলোমেলো লাগছে। আমাকে নিয়ে সেই বেঢপ শার্ট পরিহিত লোকটা আর জিনাত মিলে কোন খেলা খেলছে কে জানে! ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত হোক বা আধিভৌতিক, এর থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আমি ব্যাচেলর হলেও ঘর, মেঝে, বারান্দা টিপটপ রাখি সবসময়। অথচ, এই দুইদিনের দুর্বিপাকে পড়ে কিছুই করা হচ্ছে না ঠিকমত। ঠিকমত খাওয়া নেই। বিছানার চাদর এলোমেলো। ঘরে ঝাঁট দেয়া নেই। এঁটো পড়ে আছে থালা-বাসন। শাপলা যদি আর একবার আমাকে সুযোগ দিতো! পাশের ঘর থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করি। শাপলা/জিনাতের ফোন। না, এবার কোন ক্রন্দন বা দীর্ঘশ্বাস নয়। ক্লান্ত কণ্ঠে একজন যুবতী বললো, "ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কইরো। স্বাইস্থই সম্পদ। বিছানা বালিস পরিষ্কার কইরো। রাখি"। শাপলা...আমার শাপলা! এতদিন পরে তাকে খুঁজে পেলাম অবশেষে! তড়িঘড়ি করে ফোন নাম্বারটা দেখি। হ্যাঁ! এইতো! শেষ ডিজিট আট। আমার মনে পড়ে যায়, শাপলার ফোন নাম্বার আর সেই পাগলাটে লোকটার ফোন নাম্বার একই ছিলো। আমাকে ৫-৬-৭-৮ এভাবে একেকটা স্তর পেরিয়ে তার প্রকৃত নাম্বারের কাছে যেতে হবে। শেষ ডিজিটে নয় বসিয়ে ডায়াল করতে থাকি। রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ ধরছে না। মাত্র চারবার রিং হলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে, অনন্তকাল ধরে তা বেজেই চলছে। ছয়বারের সময় তাকে পাওয়া গেলো।-হ্যালো! কেমন আছো তুমি রেজা? -শাপলা, তুমি ফিরে এসো আমার কাছে। আমার অনেক কষ্ট হয়, অনেক অনুশোচনা হয়। আমি আর নিতে পারছি না। আমাকে রক্ষা কর প্লিজ! -তোমার এই অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব না, আপাতত। পরীক্ষার আরেকটু বাকি আছে। -বলো, বলো! যত কঠিন পরীক্ষাই হোক না কেন, আমি উত্তীর্ণ হবোই। আমাকে হতেই হবে।মৃদু হাসলো শাপলা।-থাক, থাক বীরপুরুষ! ধীরে। অতি ধীরে। অত ব্যস্ত হইয়ো না। সময়ে সব জানতে পারবা। তুমি এখন ঘরদোর টিপটপ কর, আর অল্প কিছু হইলেও ভাত খাও। এখন রাখি, কেমন?ঘর গোছানো, আর রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরীক্ষার আর কী বাকি আছে জানার ব্যাপক কৌতুহল। কাজে মন বসছে না। একটা পিরিচ ভেঙে গেছে। ফিল্টারের পানি পড়ে ঘরের অবস্থা করুণ। গ্যাসের চুলো বন্ধ করতে ভুলে গেছি। এর মধ্যেই অতি আকাঙ্খিত ফোনটা এলো। সময় কি হয়ে এসেছে? বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। সেই একই নাম্বার। শুধু শেষ ডিজিটটা শূন্য। আমার চারিপাশ দুলতে থাকে। মনে হয় বাসাটা যেন একটা ক্ষুদ্র ক্যানোপি, প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছে। চোখ বন্ধ করে ভাবি, এসব কিছু না। এদিকে ফোনটা বেজেই চলেছে। বিস্ময়াভিভূত চোখে খেয়াল করলাম, এবার শেষ দুটো সংখ্যা শূন্য! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকি। দেখি, কল আসা অবস্থাতেই শূন্যগুলো দখল করে নিচ্ছে মূল নাম্বারকে। তিনটা, চারটা, পাঁচটা এভাবে এগারোটা ডিজিটের প্রতিটিই শূন্য হয়ে যায়। এর মানে কী? আমি ব্যর্থ? এত কষ্ট, এত দুর্ভোগ পোহানোর পরেও আমি ব্যর্থ? আমার ভীষণ হালকা লাগে। মনে হয় অপরিসীম শূন্যতা গ্রাস করছে আমাকে। এ এক অনির্বচনীয়, অপ্রকাশযোগ্য অনুভূতি। চারিদিকে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। ভেসে আসছে জিনাতের সুতীক্ষ্ণ হাসি। ভেসে আসছে ফোন নাম্বার বিলি করে বেড়ানো লোকটার ক্যানভাসারিং। চারিদিকে প্রলয় নৃত্য। সবকিছু কাঁপছে। বিছানা-বালিস থেকেশুরু করে ফ্যান, টিউবলাইট, চেয়ার, টেবিল, টেবিল ল্যাম্প, কম্পিউটার। আমি মাথা চেপে ধরে মেঝেতে গুঁজে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করি। তা কি সম্ভব? এই প্রচণ্ড দুলুনি, আর বিভৎস চিৎকারে নরক নেমে এসেছে আমার ঘরে। আমি পাগলের মত দিকবিদিক ছুটতে থাকি। আমি বুঝতে পারি, আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে শূন্য জন, আমাকে ভালোবাসে শূন্যজন, আমার চটকদার কবিতার পাঠক শূন্যজন, আমাকে নিয়ে ভাবে শূন্যজন। শূন্য অনুভূতিরা একসাথে হয়ে আমাকে অভিশাপ দিতে এসেছে। তারা আর আমার ভেতরে অবস্থান করতে রাজি না। বিদ্রোহ, ক্যাপ্টেন! থামাও! নোঙর ফেলো! কোনমতে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখা পাই সেই পাগলাটে লোকটার। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। এপাড়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। সাঁইসাঁই করে বেগে চলা গাড়িগুলোর ফাঁক গলে কোনভাবেই আসতে পারছে না। আমি তাকে এই পাশ থেকেই জিজ্ঞাসা করি,-এই যে! ও ভাই! শুনতে পাচ্ছেন আমাকে? আমি তো ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে গেছি! কেয়ামত নেমে এসেছে আমার ঘরে। অদ্ভুত নাম্বার থেকে কল আসছে। আপনি কি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?গালভরা হাসি হেসে লোকটা কী মনে করে যেন দৌড় দিয়ে রাস্তা পাড় হবার চেষ্টা করলো। ট্রাকটা হার্ড ব্রেক কষেও বাঁচাতে পারলো না লোকটাকে। এর পরে আর কখনও জিনাতের ফোন আসে নি। শুনেছি সে নাকি দুবাইয়ে তার স্বামীর সাথে মহাসুখে দিনানিপাত করছে। আর আমি? সেই বাস স্টপেজের যাত্রী ছাউনিতে এখনও বসে থাকি অকারণে। শূন্যমাত্রিক জীবনের অভিশাপ বুকে নিয়ে নিরন্তর অপেক্ষায় কাটে আমার জীবন। ফিসফিসিয়ে কারা যেন শোনায় শূন্যের আলাপন।.
২২।গল্পঃ অমীমাংসিতআয়োজন তোমাকে এখন হত্যা করা হবে। তোমার শেষ ইচ্ছা কি আমাদের জানতে দাও। যদি সম্ভব হয় আমরা তা পূরণ করব। নিকের খুব কাছ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো তার নিজের কাছেই কেমন যেন দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। মৃত্যু অবধারিত জেনে মানুষের শেষ ইচ্ছা একটাই হতে পারে। সেটা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা। সম্ভবত মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেই মানুষ বেঁচে থাকার তীব্র স্বাদ অনুভব করতে পারে। নিকের কাছেও মনে হচ্ছে বেঁচে থাকা যে এমন চমৎকার একটা ব্যাপার তা সে আগে কখনো এমন ভাবে অনুভব করতে পারেনি। সে খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তাকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হবে। নিক নিজের বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় ওদের উদ্দেশ্য করে বলল আমি বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। সে বিদ্রুপের হাসি শুনতে পেল। তুমি এখন অসহায়। কোন ভাবেই প্রতিরোধ কিংবা যুদ্ধ করার মত অবস্থাতে তুমি নেই। আমরা ইচ্ছা করলেই যেকোনো সময় তোমাকে মেরে ফেলতে পারি। তুমি কিভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে চাও? যুদ্ধ করে মরতে চাও? কিন্তু তুমিও খুব ভালো করেই জান সেটা করার সুযোগ দিলেও তোমার বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই। যুদ্ধ করে তোমাদের সাথে আমি পারবনা তা জানি। নিক খুব স্থির গলায় উত্তর দিল। আমি বেঁচে থাকার চেষ্টা হিসাবে তোমাদের সাথে আলোচনা করতে চাই। এটাকে তোমরা বিতর্কও বলতে পার। আমি তোমাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করব যে, আমাকে মেরে ফেলাটাই তোমাদের জন্য কোন সমাধান হতে পারেনা। বরং আমাকে বা আমার মত অনেককে হত্যা করে তোমরা নিজেরাই তোমাদের ধ্বংসের পথকে স্বাগতম জানাচ্ছ। যদিও তোমাকে হত্যা করা হবে এটা অবধারিত, তবে তোমাকে তোমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে দেওয়া হবে। আমাদের আধ্যাত্মিক নেতা তোমার সব কথা শুনেছেন। তিনি তোমার সাথে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছেন। নিকের চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। তার সামনে একজন মানুষ বসে আছেন। নিক বুঝেছে এই মানুষটিই সেই, যাকে ওরা তাদের আধ্যাত্মিক নেতা বলে অভিহিত করে থাকে। মানুষটির একধরনের আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে তা নিক বুঝতে পারে। কারন তাকে একপলক দেখেই নিকের মাঝেও একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
মোহ আমি জানি তোমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তুমি চুপ করে না থেকে আমার সাথে তোমার অনুভূতি শেয়ার করতে পার। মায়ার হাত ধরে কথাগুলো বলল অর্ক। মায়া আর অর্ক আজ দুবছর ধরে একসাথে থাকছে। প্রফেশন, প্যাশন, এবং চর্চার দিক থেকে তারা দুজনই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চরিত্র। মায়া খুব বিখ্যাত চিত্রকর। দেশের বাইরেও তার বেশ কয়েকটা চিত্রকর্মকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই মাস্টারপিস বলা যায়। মায়ার কাজ হচ্ছে স্যুরিয়েল জগত নিয়ে। অপরদিকে অর্ক এ দেশের একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। তার পিএইচডি থিসিস সারা বিশ্বের স্বনামধন্য গণিতবিদদের মধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অর্ক এখন খুবই গোপন একটা গবেষণার কাজে জরড়িত আছে। বলা হচ্ছে এই গবেষণা শেষে অনেক জটিল রহস্যের জট খুলে যাবে। মায়া এবং অর্ক আসলে তাদের এই বিপরীতধর্মী স্বভাবের কারনেই একে অপরের প্রেমে পড়েছিল। অবশ্য আরো একটি কারন আছে। নিকের সাথে বিচ্ছেদের পর থেকেই মায়া একধরনের শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই হয়তো মায়ার জীবনে অর্কের আগমন ঘটে। ওরা কি নিককে আসলেই মেরে ফেলবে? নিজের জানা উত্তরটাই যেন মায়া শুনতে চাচ্ছেনা। অর্ক কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। তারপর বলে, উত্তরটা আমরা দুজনই জানি। নিক অনেকদিন থেকেই তার যুক্তির জাল বিস্তার করে ওদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত করে আসছিল। বিশেষ করে নিকের শেষ থিসিসটা পুরো বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেকেই অবিশ্বাসী হয়ে যেতে শুরু করে। তারপর থেকেই আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীগুলোর প্রধান শত্রু হয়ে যায় নিক। অনেকদিন থেকেই তারা নিককে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছে। তাই তার আর ফীরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, যা আমি গোপন সুত্রে জানতে পেরেছি। তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা! তবে আমার মনে হয় তোমার জানার অধিকার আছে। সরকারও চাচ্ছেনা নিক বেঁচে থাকুক। কারন সরকারের সাথে আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীগুলোর একধরনের সম্পর্ক আছে। তারা একে অপরের প্রয়োজনে কাজ করে থাকে। নিকের গবেষণা সরকারের জন্যও অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই তারা এই ব্যাপারে নিরব থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। মায়ার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তার হঠাৎ করে খুব নিককে দেখতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন আগের সেই সোনালী সময়গুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মায়ার চিত্রকর্ম সম্পর্কে নিকের খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। তবে নিক তার সবটা দিয়েই মায়াকে ভালোবাসত। কিন্তু মায়ার একটা চিত্রকর্ম নিয়েই নিকের সাথে তার প্রথম তর্ক হয়। সেখানে মায়া এমন কিছু ব্যাপার তুলে ধরেছিল যা নিকের গবেষণার সাথে কন্ট্রাস্ট করছিল। নিক প্রথমে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল। তারপর বলেছিল তুমি যা সৃষ্টি করছ তা যতই সুন্দর হোকনা কেন, তা অযৌক্তিক। আর একটা মিথ্যাকে যেভাবেই উপস্থাপন করা হোক না কেন তা মিথ্যাই। মায়া বলেছিল তোমার সাথে আমার বিশ্বাসের মিল নেই বলে তুমি আমার কাজকে অপমান করতে পারনা। আমার কাজকে ভালো না বাসতে পারলে আমাকে ভালোবাসার অধিকারও তুমি রাখোনা। নিককে সে সময় খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু মায়ার রাগ এবং আবেগের কাছে নিকের প্রতি তার ভালোবাসা পরাজিত হয়। সে সেদিনই নিককে একা ফেলে চলে এসেছিল। তারপর আর কোনদিন নিকের সাথে দেখা করেনি। এখন নিককে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে, আসলেই সে নিককে অনেক ভালোবাসে। অর্ক এখনো মায়ার হাত ধরে আছে। সে যেন মায়ার সব অনুভূতি খুব স্পষ্ট ভাবেই পড়ে ফেলতে পারছে।
বিনির্মাণ মানুষের মৃত্যুর পরেই সব শেষ হয়ে যাবে, এমন ধারনা পোষণ করলে সমাজে অনেক ধরনের পরিবর্তনই হতে পারে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হবে তা হচ্ছে, আমাদের ক্ষমতাও তখন টিকে থাকবেনা। ডুমার তার কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলে। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, এই জীবনই তার একমাত্র জীবন এবং এই জীবনেই তার সব অধিকার তাকে আদায় করে নিতে হবে- তবে শোষিত শ্রেণী বিদ্রোহ করবে। তাদেরকে আর ভ্রান্ত বিশ্বাসের জালে আটকে রাখা যাবেনা। মানুষ তখন সব প্রথা ভেঙ্গে নিজের জীবনটাকেই পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে চাইবে। আমাদের ভাড়া করা কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বলেছে যে, তখন মানুষকে শাসন এবং শোষণ করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাই আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর হাতে নিককে হত্যা হতে দেওয়া। আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করে রেখে আসলে আমাদেরকেই আরো শক্তিশালী করে তুলছে। তাই তাদের আমরা খুব কৌশলে আমাদের প্রয়োজনে ব্যাবহার করছি। তবে যে জন্য আজ এই গুরুত্বপূর্ণ গোপন মিটিং এ আপনাদের ডেকেছি তা এখন আমি আপনাদের বলব। আধ্যাত্মিক নেতা বিভিন্ন সময় আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও আমরা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি যে, তার মনোভাবের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। সে এখন আমাদেরকে আধ্যাত্মিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাতের পরিকল্পনা করছে। তাই তাকেও সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের হাতে অন্য কোন উপায় নেই। তাকে সরিয়ে আমরা সেখানে আমাদের নিজস্ব লোক নিয়োগ করব। তবে তারা যখন নিককে হত্যা করবে তখন আমরা খুব দ্রতই তাদের উৎখাত করব। এতে করে এক আমরা এক ডিলেই আমাদের প্রধান দুই শত্রুকে সরিয়ে দিতে পারব। আপনারা জানেন যে, নিক এবং আধ্যাত্মিক নেতা দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ ধারন এবং প্রচার করে থাকে। তারা দুজনই প্রথমে আমাদের বন্ধু ছিল। কিন্তু নিকের সত্য আবিষ্কারের অবসেশন আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তার শেষ থিসিসটা মানুষকে প্রভাবিত করতে থাকে। সে যুক্তি দিয়ে প্রমান করে যে পরকাল বলে কিছু নেই। এই জীবনকেই তাই পূর্ণরুপে উপভোগ করতে হবে। অপরদিকে, আধ্যাত্মিক নেতা এর বিপরীত মতবাদ প্রচার করে আসছে। অর্থাৎ তাদের মতে পরকালই সব। তাদের প্রচার আমাদের জন্য খুব একটা সমস্যা ছিলনা। বরং মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখার তাদের এই আয়োজন আমাদেরই কাজে আসত। কিন্তু আমদের তাদের দুজনের মতবাদ নিয়েই কোন মাথা বেথা ছিলনা। কিন্তু এখন আমরা আমাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে দুজনকেই বাঁধা মনে করছি। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা নিককে আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর হাতে মরতে দেব। তারপর নিককে হত্যা করার অপরাধে আমরা আধ্যাত্মিক নেতাকে উৎখাত করব।
ডুমার কথা শেষ করে কারো কোন প্রশ্ন কিংবা সংশয় আছে কিনা জানতে চাইল। কিন্তু বরাবরের মতই কেউ কোন প্রশ্ন করল না।
শেষ প্রহরের খেলা আলোচনা শুরুর আগে তোমার কাছে একটা সত্য জানতে চাচ্ছি। যখন তোমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তোমার শেষ ইচ্ছে কি, তখন আমি ভেবেছিলাম তুমি মায়াকে শেষ বারের জন্য দেখতে চাইবে। তোমার কি আসলেই তেমন কিছু মনে হয়েছিল। নিকের চোখে চোখ রেখেই কথাগুলো বলল আধ্যাত্মিক নেতা। দেখতে ইচ্ছে করছিল। আর আমি জানি সেটা চাইলে আমার ইচ্ছাও পূরণ করা হতো। কারন মায়ার সাথে আপনার সম্পর্কের কথা আমি জানি। মায়ার ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডারের কথা শুধু তিনজন মানুষই জানে। আমি, অর্ক এবং আপনি। আপনি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। পি এইচ ডি করার সময় হঠাৎ করেই জাগতিক সবকিছু আপনার কাছে অর্থহীন মনে হয়। তখন থেকেই আপনি আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেন। এবং একসময় চরম্পন্থি হয়ে যান। আপনি মায়ার চিত্রকর্মের ফ্যান ছিলেন। বিশেষ করে তার সুরিয়েল চিত্রকর্মে আপনি আপনার আধ্যাত্মিক দর্শনের ছোঁয়া পেতেন। মায়াও বিভিন্ন ভাবে আপনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তার একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মে আপনার প্রভাব সুস্পষ্ট। যদিও সেটা সে জানেনা। সেই চিত্রকর্ম নিয়েই তার সাথে আমার বিরোধ হয়েছিল। সে একদিকে চাচ্ছে আপনি আমাকে হত্যা করুন। অপরদিকে তার আরেক সত্ত্বা চাচ্ছে আমি জীবিত অবস্থায় ফীরে যাই। কারন তার একটা সত্ত্বা আমাকে পাগলের মতই ভালোবাসে। চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিল নিক। আমার মনে হয়, আমাকে হত্যা করতে চাওয়ার পেছনে আপনার অন্য কোন কারন আছে। আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের অজুহাত দিয়ে আপনি যতজনকে হত্যা করেছেন তার পেছনের কারন হিসাবে একটা প্যাটার্ন আমি খুঁজে পেয়েছি। আপনার মধ্যে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটো ব্যাপারই চরম ভাবেই অবস্থান করে। কিন্তু বিশ্বাস আপনাকে শান্তি দেয়। আর অবিশ্বাস আপনাকে পাগল করে ফেলে। তাই আপনি আসলে আপনার বিশ্বাসী স্বত্বাটাকে চাপা দেওয়ার জন্যই আমাদের হত্যা করছেন। নিকের দিকে হাসি মুখেই তাকিয়ে আছেন আধ্যাত্মিক নেতা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে নিকের কথা শুনে সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। তুমি ঠিক বলেছ। বিশ্বাস মানেই শান্তি। অবিশ্বাস মানেই চরম অশান্তি। তাই আমি আমার অবিশ্বাসী অংশটাকে চিরতরে ধ্বংস করে পরম শান্তি অনুভব করতে চাই। তবে এতদিন সরকার আমাকে বন্ধু ভেবে এসেছে। এখন ভাবছে না। আমার ধারনা তোমাকে মেরে ফেললেই তারা আমাকেও মেরে ফেলবে। তারা তোমাকে কিংবা আমাকে কাউকেই বাঁচতে দিতে চাইছে না এখন। তবে তাদের সেই প্ল্যান আমি বাস্তবায়িত হতে দেবনা। আমি বরং তোমার সাথে একটা খেলা খেলতে চাই। তুমি বলেছ এই জীবনই একমাত্র সত্য। পরকাল বলে কিছু নেই। স্রষ্টা বলে কিছু নেই। তাই এই জীবনটাকেই উপভোগ করতে হবে। আমিও তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু একসময় বুঝলাম বিশ্বাস ছাড়া বেঁচে থাকা দুর্বিষহ। সকিছুর ব্যাখ্যা না খুঁজে বরং স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণই একমাত্র শান্তি আনতে পারে। কিন্তু তোমার একের পর এক থিসিস আমার মধ্যেও সংশয়ের জন্ম দেয়। তোমার অকাট্য যুক্তি, প্রমান আমাকে শান্তি দিচ্ছিলনা। তুমি আমার শান্তি কেঁড়ে নিয়েছ। আমিও তোমার শান্তি কেঁড়ে নেব। তোমাকে ছেঁড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তোমার বদলে মায়াকে হত্যা করা হবে। তুমি বাকি জীবন অনেক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকবে। অথবা তোমার হাতে রিভলবার তুলে দেওয়া হবে। তুমি নিজেই নিজের মাথায় গুলি করবে। এখন বল, কি চাও? জীবন না মৃত্যু?
পরিশেষে
ডুমার খুব অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শেষ মুহূর্তে কেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে? ডুমার বিভ্রান্ত হয়েই জানতে চায়। মায়া হাসি মুখেই বলে, যারা আমায় ভালোবাসে তারা জানে আমার ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার আছে। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না নাকি? সময়ের প্রয়োজনে আমাকে এক এক সময় একেক রকম চরিত্র হয়ে যেতে হয়। ছোটকাল থেকে আমাকে এ ধরনের ট্রেনিং খুব ভালো ভাবেই দেওয়া হয়েছে। তুমি জানো আমি যে গুপ্ত সংঘটনের হয়ে কাজ করি, পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন তাদের নিয়ন্ত্রনে। পৃথিবীতে কত্টুকো বিশ্বাসের চর্চা হবে কিংবা কত্টুকো অবিশ্বাসের চর্চা হবে- তা তারা তাদের প্রয়োজন মত ঠিক করে নেয়। নিক, অর্ক, কিংবা আধ্যাত্মিক নেতা কেউ জানত না যে তাদের সাথে সম্পর্কটা একটা পরিকল্পনার অংশ ছিল। আসলে নিক তার শেষ থিসিসে ঠিকই বলেছিল যে, এই পৃথিবীতে মানুষই সবকিছুর ডিজাইনার। মানুষই মানুষকে নিয়ে খেলে, আবার মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করে। আসলে আমরা জানতে পারি যে, নিক কগনেটিভ ম্যাপ নিয়ে গবেষণা করছে। যা আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই জানা প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আধ্যাত্মিক নেতাকে মেরে নিককে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হয়েছে। মায়া জানে নিক তাকে বাঁচাতে আরেকটু হলেই আত্মহত্যা করত। নিকের মত যুক্তিবাদী মানুষ নিজের গবেষণা অর্ধেক বাকী রেখেই মায়াকে ভালোবেসে মরতে বসেছিল। তার মধ্যে কি তখন আসলেই কোন যুক্তি কাজ করছিল? মায়াও শেষ মুহূর্তে অনেক বড় রিস্ক নেয়। সে তার অথোরিটিকে না জানিয়েই নিককে উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে জানে, যৌক্তিক কারন দেখিয়ে তাদের কনভিন্স করতে না পারলে, তাকেও হত্যা করা হত। ভালোবাসা আসলেই এক রহস্যময় অনুভতি যেখানে বিশ্বাস, অবিশ্বাস, যুক্তি সব তুচ্ছ হয়ে যায়। .
২৩।মনস্তাত্ত্বিক গল্পঃ কাউন্সেলিং
মাঝখানে অনেক দিন দেখিনি মৃদুলকে। আজ দেখলাম। ঝাঁকরা চুলগুলোতে পাক ধরেছে, কিন্তু চোখগুলো আগের মতোই উজ্জ্বল। যদিও কিছুটা নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে তাকে। মৃদুল অনেক দিন আসেনি যেহেতু, ধরে নিয়েছিলাম তার রোগ অনেকটা ভাল হয়ে গেছে। আজ আবার কি হলো কে জানে! কাউন্সেলিং করাতে আমার কাছে আসত সে একসময়। দীর্ঘদিন ধরে, প্রায় ১০ বছর ধরে তার কাউন্সেলিং করছি আমি। এমন নয় যে সে মানসিক ভাবে ভয়াবহ রকম অসুস্থ। তাকে বেশ সুস্থই বলা যায়। জীবনে হতাশা, দুঃখের ভার বেশি হলেই সে চলে আসত আমার কাছে। বেশ আধুনিক মন মানসিকতা তার। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো মানেই যে পাগল হওয়া নয় বিষয়টা সে ভালোই বোঝে। আমি মৃদুলকে শুয়ে পড়তে বললাম। সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে কথা সে বলতে শুরু করল। "অনেক দিন পর এলাম ড. জিব্রান, আসলে আজ ক'দিন বলে খুব বিধ্বস্ত লাগছে বলেই এসেছি।""খুব ভাল করেছেন। কেন নিজেকে আপনার বিধ্বস্ত লাগছে বলবেন?"মৃদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল-"আমার আর যুথীকে আগের মতো ভাল লাগছে না!"আমি বেশ চমকে গেলাম। ডাক্তারিসুলভ শান্ত স্বভাব ভুলে অস্থির হয়ে বলে ফেললাম, "সে কি! হঠাৎ কি হলো? গত ১০ বছর ধরে আপনার জীবনে এত ফ্রাস্টেশনের কথা শুনলাম, কখনো শুনিনি যুথীর সাথে আপনার সম্পর্কে কোথাও ফাঁটল রয়েছে। সব হতাশা, কষ্টের মধ্যেও যুথীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে কাজের উদ্যম ফিরে পেতেন আপনি, আজ যুথীকে আপনার ভালো লাগছে না?""বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। যুথী খুব ভাল মেয়ে। আমার প্রতি তার আচরণ আগের মতোই আছে। সে আগের মতোই সহমর্মী, স্নেহময়ী এবং আবেদনময়ীও। তবুও কি যে হলো...""কি হলো?""গতকাল সন্ধ্যায় একটা বিয়ের প্রোগ্রামে যাবার কথা ছিল আমাদের। যুথী বেশ সাজল। একটা সবুজ রঙা শারী পড়ল সে। সাথে হাতাকাটা ব্লাঊজ। অসম্ভবরকম সুন্দরী লাগছিল তাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমি তার প্রতি আকর্ষণবোধহীনতায় ভুগলাম। হঠাৎ করেই!""সেটা কেমন? একটু বুঝিয়ে বলুন তো!""আমার মনে হলো, যুথীকে আমার ভাল লাগছে না আগের মতো। যুথীর চেয়ে অনেক স্বল্পসুন্দরী কোন অচেনা মেয়েকেও ওর চেয়ে আকর্ষণীয় লাগল। কোন কারণ নেই, যেন দীর্ঘদিনের পুরনো অভ্যাসের প্রতি হঠাৎ করে অনীহা চলে এলো। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! যত সময় গড়াল, দিন গেল, বেড়ে চলল অনীহাটুকু ততোই।"আমি কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে বলে যেতে লাগল-"আপনি নৈতিক দৃষ্টি দিয়ে ঘটনাটা বিচার করছেন নাকি ডাক্তার সাহেব? যে মেয়েটা আমার কঠিন সময়ে পাশে থেকেছে, ভাল সময়ে এসে তার প্রতি আকর্ষণহীনতা অনুভব করছি। এটা তো এক ধরনের অন্যায়, অনৈতিক বিষয়। এমন কিছু ভাবছেন?"আমি গলার স্বর ডাক্তার সুলভ গম্ভীর এবং শান্ত করে বললাম-"ডাক্তাররা রোগীর চারিত্রিক মূল্যায়ন করে না মৃদুল। রোগীর মানসিক সুস্থতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।""যাক, বাঁচালেন। যা বলছিলাম, এমন নয় যে আমি যুথীর সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না। শুধু আগের সেই উচ্ছ্বাস-মোহ খুঁজে পাচ্ছি না।""দীর্ঘদিন একসাথে থাকলে এমন হওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক নয় মৃদুল। সম্পর্কও এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকে না। জীবন কোন সোজা গ্রাফ নয়, অনেক আঁকা বাঁকা, জটিল।""আপনি বুঝতে পারছেন না ডাক্তার। বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। এটা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসা কোন সম্পর্ক নয়। যেন হঠাৎ করে খেই হারিয়ে ফেলা।"আমি আমার ডাক্তারি জীবনে প্রথম বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। *** *** ***
অনেক রাত। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে আমার স্ত্রী এখনো ঘুমায়নি। একটা বই পড়ছে বেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টে। মৃদুলের কথাগুলো নিয়ে বেশ ভাবছি! বোঝার চেষ্টা করছি আমি আমার স্ত্রীকে এখনো সেই চোখে দেখি কি না, যেমনটা দেখেছিলাম প্রথমবার। কিংবা বিয়ের ১ বছর পর যেমন করে দেখেছিলাম, ৫ বছর পর যেমন করে দেখেছিলাম, প্রথম সন্তান হবার সময় যেমন করে দেখেছিলাম, এখনের দেখা আর সেই সব দেখার মধ্যে কি কি তফাৎ আছে।আমাকে এভাবে একাগ্র হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়ে রাখল সে, আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল-"এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি বই পড়ব কিভাবে বলো তো?""তা ঠিক। একটা কথা বলার ছিল তোমাকে।""কি কথা?""আমার এক পেশেন্টের কথা। লোকটা আমার কাছে ১০ বছর ধরে মাঝে মাঝে আসছে কাউন্সেলিং এর জন্য।""ও। কি সমস্যা তার?""নির্দিষ্ট কোন সমস্যা নেই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফ্রাস্টেশান নিয়ে আসত।""ও আচ্ছা।""তবে যখনই আসত, একটা মেয়ের কথা খুব বলত। তার স্ত্রী। তাকে খুব সাহস দিত, অনুপ্রেরণা দিত, ভালোবাসত।""বাহ। চমৎকার মেয়ে।""কিন্তু ব্যাপার কি জানো? আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, তার কোন স্ত্রী নেই।""মানে? সেটা কি রকম?""তার কথা শুনে বুঝতে পারতাম। স্ত্রী সংক্রান্ত আলোচনা ছিল অসংলগ্ন। কখনো বলে, তার স্ত্রী স্কুল টিচার, কখনো বলে গৃহিণী, কখনো বলে ব্যাংকার, আবার কখনো বলে তার স্ত্রী কখনো কোন চাকরী-বাকরী করেনি।""তার মানে কি? লোকটা একটা কাল্পনিক মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করে?""প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম, মেয়েটা কাল্পনিক নয়। মেয়েটাকে সে সত্যিই চিনত। তাদের একসাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে। সে জন্য সে নিজের স্ত্রীর অতীতের কথা ঠিকঠাক ভাবে বলতে পারত, শুধু তার সাথে সংসার শুরু করার পর থেকে সে যা বর্ণনা দিয়েছে, তা কাল্পনিক। সহজ সিদ্ধান্ত, সে মেয়েটাকে ভালোবাসত, কিন্তু তার সাথে বিয়ে হয়নি বলে মানসিক ধাক্কা পেয়েছে। সেখান থেকে হ্যালিউসিনেশন।""সর্বনাশ, কি অদ্ভুত।""হ্যা, বেশ অদ্ভুত। তবে একটা বিষয় কি জানো, আমি কখনো তার এই হ্যালোসিনেশনটাকে সারাতে চাইনি। আমি চেয়েছি সে হ্যালুসিনেশন করতে থাক।""সে কি! এমন একটা কাজ কেন করতে গেলে তুমি?""কারণ, যে মেয়েটার কথা বলত সে, তার স্ত্রী, আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমি মেয়েটাকে চিনি। সে মেয়েটা আর কেউ নয়, তুমি যুথী।""কি!""হ্যা। তোমার সাথে আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল। তোমার পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস-অনভ্যাস কিছুই জানতাম না। বিষয়গুলো আমি ধীরে ধীরে জানতে পারি সেই পেশেন্টের কাছ থেকে। সে জন্যই চাইনি সে হ্যালুসিনেশন করা বন্ধ করে দিক। ছেলেটাকে হয়তো তুমি চিনবে, মৃদুল।""মৃদুল?""হ্যা।"কি আশ্চর্য, আমি অদ্ভুত এক সংশয় দেখতে পেলাম যুথীর চোখে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলে বুঝতে পারলাম সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। দশ বছর কি এতই দীর্ঘ সময়? ২৪।গল্প: ব্যাচেলর্স!
ঢাকা শহর থেকে সময়ের দিক দিয়ে অনেক বাইরে, সোজা কথায় নবীনগরের একটু দুরে চারতলা ভবনের চারতলায় আমাদের মেস। পুরো বিল্ডিংটাই ব্যাচেলরদের জন্য! ইংরেজি অক্ষর L এর মত কাঠামো! সামনে ছোট একটা ফাকা জায়গা যার চারপাশে আম গাছ দিয়ে ঘেরা! অতিরিক্ত গরম হলে নিচে নেমে মেসমেট আর বড় ভাইয়েরা মিলে গাছগুলোর নিচে বসে আড্ডা দিই আর বেশি বাতাস হলে ছাদে গিয়ে পাটি বিছিয়ে ডন নিয়ে বসে পড়ি! সবাই ব্যাচেলর, অতএব বাধা ধরা নিয়ম নেই! ছোট বড় মিলে মোট ৬০টি ফ্লাট! নিঃসন্দেহে বিশাল বড় মেস! যিনি ব্যাচেলরদের কথা মনে করে এই মনোরম পরিবেশের বিল্ডিং বানিয়েছেন তার জন্য মনে মনে এবং প্রতি ওয়াক্তের নামাজে দোয়া করি! আমরা চারজন থাকতাম একরুমে! প্রত্যেকটা ফ্লাটে তিনটা রুম সাথে রান্নাঘর আর বাথরুম তো আছেই! ব্যাচেলরদের জন্য এই মেসটা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ আড্ডার চেয়ে কম না। আমার রুমমেটরা হল সোহেল, আসাদ, রাফি। আমার রুমমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। প্রথমে সোহেল, গ্রাম রংপুরে। বাবা একজন শিক্ষিত কৃষক। অনেকেই ভাবে কৃষক আবার শিক্ষিত হয় নাকি? অবশ্যই হয়, কৃষি সম্পর্কে উনি কোন কৃষিবিদের চেয়ে কম জানেন না! নিজেদের অঘাত জমি আছে! একই জমিতে তিনি এবং অন্যান্য নিম্নবিত্ত কৃষক একসাথে কাজ করেন! স্যালো মেশিনের কোনো টাকা তিনি নেন না। অমায়িক লোক একজন! মনে কোন অহংকার, হিংসা, ভেদাভেদ নেই! সোহেল সেই রকম। প্রথমে ভালো বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো কিন্তু আমাদের কথা চিন্তা করে এই মেসে থাকা শুরু করেছে! আমাদের মধ্যে সোহেল সবচেয়ে লম্বা! এবার পরিচয় করিয়ে দেই আসাদের সাথে। আসাদ ঢাকার স্থানীয়। বাসা কাচঁপুর ব্রিজের পাশে। মধ্যবিত্ত এবং বাস্তববাদী ছেলে। আবেগের কোন জায়গা তার মনে নেই। মায়াবী চেহারার ছেলেটা একদম সোজা সাপটা কথা বলে। ভাবার সময় নেই তার! রাফি হল মেসের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে! গ্রামের বাড়ি যশোর সদরে! চারিত্রিক গুনাবলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে কাজ করে সেটা হল রুপচর্চা! মেয়েরাও ওর কাছে হার মানবে! ক্লাসে যাক আর টিউশনিতে যাক অক্সি ফেস ওয়াস আর মেঞ্জ অ্যাক্টিভ ওর ব্যাগে থাকবেই! কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এপর্যন্ত কোনো মেয়েকে রাফি পটাতে পারে নি! এবার আমার পরিচয়, আমি তাহসিন। গ্রামের বাড়ি শেরপুর,বগুড়া। মা বাবার বড় ছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবার। হাসি কান্না, সুখ-দুঃখের এক জারণ বিজারণ বলয় দ্বারা বেষ্টিত পরিবার। আম্মুর কাছে ছেলে হিসাবে অতি ভদ্র আর শান্ত শিষ্ট আর আব্বুর কাছে প্রথম শ্রেণীর ফাঁকিবাজ! ফ্রেন্ডদের মধ্যে আমি একদমই ইউনিক! এটা আমার কথা না, আমার ফ্রেন্ডরা বলে। কারণ সিগারেট টানা, গাঁজা খাওয়া, টিজ করা ইত্যাদি আমাকে আজও ছুতে পারে নি!.মেসে প্রথমে আমার দিন কাটতো না। আর ক্লাসেও ভাল বন্ধু ছিল না! একপ্রকার একাকীত্বে আমার দিন কাটতে থাকে! রসকসহীন জীবন। তারপর পরিচয় হল আসাদের সাথে। আসাদ ছিল ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ ছেলে। স্যাররা তাকে খুব ভাল চোখে দেখতো। আসাদের সবচেয়ে ভাল গুণ হল সাহায্য করার জন্য সবার আগে দারিয়ে যেত। অপকার করে নি আজ পর্যন্ত। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল এই সাহায্য করা নিয়েই! পরীক্ষার তিনদিন বাকি ছিল! অথচ আমার বইটা পড়ার মত অবস্থায় ছিল না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়ে ভাজ খুলে বিভিন্ন স্থানে ছিড়ে গিয়েছিল! ছোট বেলা থেকেই প্রত্যেক শ্রেণীর ১ম বা ২য় সাময়িক পরীক্ষায় কমপক্ষে একটি সাবজেক্ট হলেও ফেল করেছি! তাই মনে মনে ভাবলাম হয়তো আমার রেকর্ডটা আমি ভাঙতে পারবো না! অনেকের কাছেই বই ধার চাইলাম কিন্তু কেউ দেয় নি। আর দিবেই বা কেন? অনেক লাইব্রেরীতে খোজ করলাম কিন্তু পাই নি। ঠিক তখনই আসাদ আমাকে একটা পুরানো বই ম্যানেজ করে দিল! নতুন বইয়ের চেয়ে পুরোনো বইগুলোই আমার পড়তে সুবিধা হয়। এতে অনেক ইম্পরট্যান্ট প্রশ্ন গুলো দাগানো থাকে! কিন্তু আমি তো বিদ্যাসাগর বা একে ফজলুল হক না যে একবার পড়লেই বই মুখস্থ হবে! এবারের টেনশন ছিল কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ব! আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি। শেষমেশ পাঁচটা প্রশ্ন ভালভাবে পরে গেলাম পরীক্ষা দিতে!পরীক্ষার প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে আমি হতাশ! মাত্র একটা কমন পরছে! একটা লিখে আমার কলম আর চলে না! স্যাররা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কলম চালানোর অভিনয় করি বা প্রশ্ন পড়ার অভিনয় করি! সকলের খাতায় কলম জেট বিমানের গতিতে চলছে আমার আমার কলম চালুই হচ্ছে না! "বাসায় পড়া লাগে, কলম চালানোর ভাব ধরলেই নাম্বার আসবে না!!!" বলেই স্যার আবার চলা শুরু করলেন! আসাদ আমার সামনেই ছিল কিন্তু স্যারদের কঠোর গার্ডের ফলে আমি টু শব্দও করতে পারি নি! পরীক্ষা চার ঘন্টার, তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। এই তিন ঘন্টার মধ্যে পাঁচজন স্যার এক সেকেন্ডের জন্য দরজার বাইরে যান নি! এদিকে আমার জানের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে! এরমধ্যে দুইজন স্যার এসে অন্য দুইজনকে রেস্ট নিতে বললেন। এরপর আরও দুইজন এসে দায়িত্ব পরিবর্তন করে নিলেন। এখন এটাই সুযোগ! আমি আসাদের উপর চড়াও হলাম। তিনটা বড় প্রশ্ন আর তেরটা ছোট প্রশ্ন লিখে নিলাম! কঠোর গার্ডের পর সহজ গার্ড হয়, আমি এই সুত্রে বিশ্বাসী। আর পরীক্ষার হলেও সেটাই হল। ব্যস, স্যাররা শেষের দিকে আর কড়া ডিউটি দেন নি! কোনো রকম পাশ করে গেলাম। তারপর থেকে আসাদের সাথে ভাল বন্ধুত্ব। আমি ওকে আমার মেসে আসতে বললাম। মেস দেখে ওর দারুণ পছন্দ হল! পরের মাসে আসাদ আমার সাথে শিফট হয়ে গেল! এখন কোন সমস্যা হয় না। দুই বন্ধু খুব ভালমতো মেসে রাজত্ব করে যাচ্ছি। ক্লাসে নতুন একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। নাম রাফি। আগেও কথা হয়েছে কিন্তু অতটা আন্তরিকতার সাথে বলা হয় নি। রাফি জানালো ওর থাকা খাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে। মেস মালিক যখন ইচ্ছা তখন ভাড়া বাড়ায়। বুয়া থাকে না আরও নানান ঝামেলা! আমরা ওকে আমাদের মেসে শিফট হওয়ার জন্য বললাম। আমরা তিনজন একসাথেই থাকা শুরু করলাম। হাসি, আড্ডা সবই চলছিল ভালভাবে।.রাতের খাবার খাওয়ার পর আসাদ বললো, "আচ্ছা হাউজফুল মানে আমরা একই ডিপের তিনজন আছি, খুঁজে শুজে আরেকজন জোগার করা যায় না?" আমরা ব্যাপারটা ভেবে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই! পরেরদিন ক্লাসে গিয়ে আমরা যে বন্ধুর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ তাকে গিয়ে বলি। ছেলেটা সোহেল। ব্যাস, আমরা চারজন হয়ে গেলাম! এরপর থেকে প্রত্যেক শুক্রবারে আমরা একসাথে ঘুরতে বের হতাম। এক শুক্রবারে রাফি আমাদের বললো, "চল নতুন কিছু উপভোগ করে আসি?" আমাদের মনে খুব কৌতুহল জন্মালো কি হতে পারে আজ! আমরা সবাই বাইরে দারিয়ে আছি কিন্তু রাফিকে দেখছি না! বুঝে নিলাম নবাব চেহারার উপর ঘষামাজা করায় ব্যস্ত আছেন! পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট তারপর বিষ মিনিট কিন্তু নবাবের আসার খবর নেই! সোহেল গিয়ে উত্তম মাধ্যম দিয়ে নিয়ে আসলো। আমরা রাস্তার পাশে দারিয়ে আছি। রাফির চোখ শুধু পিক-আপ খুঁজছিল। আমাদের বললো, "যেকোনো খালি পিক-আপ দেখলেই সিগনাল দিবি। চারজন একসাথে দিলে অবশ্যই থামবে!" এরপর একের পর এক পিক-আপ যাওয়া শুরু করলো কিন্তু কেউ থামলো না! রাফির অক্লান্ত সাহসী সংকেতে অবশেষে একটা পিক-আপ দারালো! রাফি বললো, "ঘাটে?"ড্রাইভার বললো, "হুম, ৮০টাকা এক পিস!""আরে মামা আমরা সবাই স্টুডেন্ট, আমাদের কাছ থেকে এত নিলে যামু কই? চারজন আছি পঞ্চাশ করে দিবানে! নিয়া যান।""উঠেন!"ব্যাস, আমরা হই হুল্লা করতে করতে পিক-আপে উঠলাম! সে এক অজানা আনন্দের সাগরে সাঁতার কেটে যাচ্ছিলাম আমরা! যে আনন্দের শেষ নেই! আমরা চারজন চার কোণায় দারিয়ে একের পর এক সেল্ফি তুলতে লাগলাম। ছোট্ট পিক-আপ খুব দ্রুত গতিতে ছুটছিল! এরচেয়ে দ্রুত ছুটছিল বাসগুলো! সেদিন আমাদের আনন্দের কোনো সীমানা ছিল না! সোহেল ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে প্রকৃতির ছবি তুলছিল। আসাদ চিৎকার দিয়ে বললো, "ওই ক্যামেরাম্যান, আমাগো ছবি তুলছ না ক্যারে? আমরা কি দেখতে খারাপ?" চলন্ত পিক-আপে বিভিন্ন রকম পোস নিয়ে ছবি উঠা শুরু করলাম আমরা!.ঘাটে পৌঁছে বাস ট্রাকের বিশাল লম্বা জ্যাম! রাফিকে কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো, "দোস্ত সেতু না থাকায় এখানে সকল যানবাহনকে ফেরিতে করে নদী পার হয়ে খুলনা বিভাগে যেতে হয়। বাস ট্রাক ফেরির সিরিয়ালে দারিয়ে আছে!" বাস্তবে আমি কখনও ফেরি দেখি নি! ইচ্ছা হল ফেরি দেখার আর ফেরিতে উঠার! রাফিকে ফেরিতে উঠার কথা বললাম। রাফি বললো, "বাসের সাথে সাথে যাবি, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি এই বাসের যাত্রী, আর টিকেট ভিতরে আছে। অযথা টাকার বলিদান করার দরকার নাই!" রাফি আমাদের তিনজনকে প্রথম তিনটা বাসের সাথে সাথে যেতে বললো।ফেরিতে উঠে রাফি আমাদের ছাদে যেতে বললো। ছাদে উঠে আমি অবাক! পদ্মা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য আর তার বুকে সূর্যের ঝলমলে কিরণ নদীর পানিকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলছে! রেলিং ধরে দারিয়ে দমকা বাতাস অনুভব করছি! আঁকা বাঁকা রাস্তার বাকের মত করে নদীর কিণার ঘেষে ফেরিগুলো পরপর চলতে শুরু করল! রাফি বললো, "শোন, ওপারে নেমে ইলিশ ভাজা খাবো। একদম ফর্মালিন ছাড়া। আমার পরিচিত হোটেলে!" ঘাটে নোঙর ফেলার কিছুক্ষণপর আমরা নেমে গেলাম। দুপুরের খাওয়া শেষে আবার মেসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আজকের দিনটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।ক্লান্ত শরীরে বাসের সিটে বসে চোখ বন্ধ করলাম। তারপর চোখ খুলে দেখি আসাদ ডাকছে, নামার সময় হয়ে গেছে!মেসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে চার বন্ধু ডন নিয়ে বসে পরলাম! রাত ২টা পর্যন্ত খেললাম। খেলায় এতটাই মগ্ন ছিলাম যে কখন রাত গভীর হয়েছে বুঝতে পারি নি। চোখে ঘুম দৌড়াদৌড়ি করছিল তাই বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি খরচ না করেই ঘুমিয়ে পরলাম।.দিনগুলি এভাবেই যাচ্ছিল। সবসময় আড্ডাবাজি, কার্ড খেলা, ঘুরতে যাওয়া এরমধ্যে জানতে পারলাম রাফি একটা মেয়েকে পটিয়েছে! দেখতে নাকি হেব্বি সুন্দরী! সারাদিন ফোনের উপর অত্যাচার চালায়! আমরা তিনজন যখন গ্রুপ স্টাডি করি রাফি তখন ফোন জান, বাবু, বেবি ইত্যাদি লুতুপুতু নিয়ে ব্যস্ত থাকে! সোহেল বললো, "চল প্রেমের তরকারিতে একটু গরম মসলা দিয়ে আসি!" আমরা সবাই রাফিকে ঘিরে বসলাম। রাফি কথা থামিয়ে, "কেউ কিছু বলবি?" আমরা সবাই নাবোধক উত্তর জানালাম। রাফি আবার কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। এমন সময় আসাদ চিৎকার করে রাফির ফোনের সামনে এসে বললো, "কিরে রাফি এইডা তোর কয় নম্বর মাল?" রাফি আসাদের দিকে অগ্নি চক্ষু নিয়ে তাকালো! তারপর সোহেল বললো, "বন্ধু তোর আগের গার্লফ্রেন্ড নাকি?" রাফি মোবাইল উপরে উঠয়ে নিচু স্বরে বললো, "হারামজাদারা, আজ তোরা এত ফাউ কথা বলছিস কেন? ব্রেক-আপ হয়ে যাবে তো! একটু শান্তিতে কথা বলতে দে বাপ!" আমরা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলাম। একটুপরে আমি আমার ফোনের রিংটোন বাজিয়ে রাফির কাছে নিয়ে জোরে জোরে বললাম, "দোস্ত তোর দুই নাম্বার গার্লফ্রেন্ড নিশি কল করছে, তাড়াতাড়ি রিসিভ কর নাইলে কাইটা যাইবো!" এরপর বাকিটা ইতিহাস! যতটুকু শোনা গেল তাতে মেয়েটা বললো, "তুই আমাকে আর কল করবি না। তুই থাক তোর দুই নম্বর তিন নম্বর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে, শয়তান, ইতর, বদমাইশ কুত্তা... টুট টুট টুট!!!" আমরা তিনজন হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছি আর এদিকে রাফি কোনভাবেই মেয়েটিকে বুঝাতে পারছে না যে সে নির্দোষ! আজ আর বাবু, বেবি, জান, আত্মা, পাখি কোন শব্দতেই আর মেয়েটির মন ভাঙাতে পারছে না! রাফির দিকে আমরা তাকাতে পারছি না। খুব কষ্ট পেয়েছে আমাদের এমন কর্মকাণ্ডে। আসাদ বললো, "যতই গালাগালি করস না কেন ওই মাইয়া তর সাথে একদম মানায় না। কত পোলাপানের লগে প্রেম করল ডেট করল ও। কাল যাইয়া দেখবি ওই মাইয়া অন্য পোলার লগে ঘুরঘুর করতেছে! বেট!" সেরাতে রাফি আমাদের সাথে আর কথা বলে নি! ছেলেটা রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরল!পরেরদিন আমরা ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য বের হলাম কিন্তু রাফি গেল না! অনেক জোরাজুরি করলাম কিন্তু কাজ হল না! বাধ্য হয়ে ও ছেড়েই ক্লাসে গেলাম আমরা। বিকাল বেলা আড্ডা দিয়ে মেসে ফিরে আমরা অবাক হয়ে গেলাম! চানাচুর, বিস্কুট, তন্দুল রুটি, গ্রিল, সেভেন আপ নিয়ে রাফি বসে আছে! আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করলাম। "সরি দোস্ত, মাফ করে দে, ওইরকম কথা বলা আমার উচিৎ হয় নি!" রাফির এমন কথার উত্তরে আসাদ বললো, "আরে ব্যাটা হইছে কি হেইডা ক...""কিছুক্ষণ আগে বাইরে গেছিলাম, তারপর দেখি লিজা অন্য আরেকটা ছেলের হাত ধরে ঘুরতেছে! আমাকে দেখে এমন চেহারা বানালো যেন আমি ওর শত বছরের শত্রু! সরি দোস্ত। তাই তোদের জন্য নিয়া আসলাম!"রাফির কথা শুনে আমরা আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি! মজা করে চার বন্ধু খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম! সেল্ফিও তোলা হচ্ছে চরমভাবে!.মাঝে মাঝে তিন চারদিন সময় নিয়ে আমরা যে যার মত নিজেদের বাড়ি চলে যেতাম। বাড়ি গেলেও মনটা ওই মেসের মধ্যেই থাকতো! আমি দুইদিনের জন্য একটা কাজে গ্রামে চলে যাই।বাসায় পৌঁছে দেখি আম্মু আব্বু আমার পছন্দের সকল খাবার রান্না করে টেবিলে রেখে দিয়েছে! আমাকে দেখে সেই ভালবাসা মাখানো কথাটা বললো আম্মু, "কিরে ওখানে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া হয় না নাকি? মুখ, গাল, চাপা এমন শুকনো আর ভাঙা ভাঙা লাগছে কেন?" "তোমার হাতের রান্না পাই না দেখেই তো চাপার এমন হাল!" আব্বু বললো! যাওয়ার সময় হলে আম্মু অনেক কিছু রান্না করে দিতে চাইতো কিন্তু সব নেয়া সম্ভব হত না। তাই আম্মুকে শুধু মাছ ভাজি আর মুরগি বা গরুর মাংস ভুনা করে দিতে বলতাম। আম্মু খুব সুন্দর করে রান্না করে হটপটে দিয়ে দিত! মেসে ফিরে যখন আম্মুর রান্না করা মাছ মাংস আসাদ, সোহেল, রাফির সামনে রাখতাম তখন কাড়াকাড়ি লেগে যেত! আমরা আঙুল চেটে খেয়ে নিতাম। কিছুই বাকি রাখতাম না। ঠিক এভাবেই যে যখন বাড়ি থেকে আসতো তখন বাড়ির রান্না করা কিছু না কিছু নিয়ে আসতো! আর অপেক্ষা করতে থাকতাম কবে আবার বাড়ির রান্না খাবো!.তিনদিন হল পানির খুব সংকটে আছি আমরা! মটর পুরে গিয়েছে সাথে আদিম কালের এক তালা লাগানো ছিল যাতে চাবি ঢুকাতে গিয়ে চাবি আটকে গেছে! মেসের অনেকেই যে যার মত বাড়ি চলে গিয়েছে শুধু আমরাই আছি! আর অন্যান্য সাত আটজন আছে। এখন বুয়ার অনেক দাপট হয়ে গেছে! উনি সাত আটজনের জন্য রাধবেন না! আরও পানির অভাব, তাই তার বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে! অথচ সত্তরের অধিক ব্যাচেলরদের জন্য তার রাঁধতে কষ্ট হয় না! কতদিন এভাবে চলবে কে জানে। এদিকে কাপড় চোপড় ধোয়াও হচ্ছে না। পরার জন্য তেমন কোন শার্ট প্যান্ট অবশিষ্ট নেই! কি করবো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম! ঘুম ভাঙলো বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ শুনে! জানলা খুলে তাকিয়ে দেখি আকাশ জুড়ে কালো মেঘ জমা হয়েছে! আসাদ, সোহেল আর রাফিকে ধরফর করে ডেকে উঠালাম। "বাকি বালতি গুলা নিয়া জলদি ছাদে আয়! বৃষ্টি হচ্ছে!" এই বলে দুইটা বালতি নিয়ে ছাদে চলে গেলাম! কিছুক্ষণপর বৃষ্টি শুরু হল। মেসের বাকি ব্যাচেলররা কেউ ছাদে বা কেউ নিচে গিয়ে পানি ধরতে লাগলো। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হল সাথে দমকা হাওয়া! আসাদ নিচে গিয়ে কয়েকটা আম কুড়িয়ে নিয়ে আসলো। সোহেল কয়েকটা শার্ট প্যান্ট আর টেবিলের রেক্সিন নিয়ে আমার পাশে দারিয়ে গেল!"কি রে তুই কাপড় চোপড় নিয়ে আসলি যে? আর এই বল সাবান দিয়ে কি করবি?"" ছাদে ক্রিকেট খেলবো তাই আনছি..." "মানে?"সোহেল বললো, "আল্লাহ এত সুন্দর একটা চান্স দিল জামা কাপড়গুলা ধোয়ার জন্য, আর এই চান্স তো পাগলেও মিস দিবে না! আর তোরা ড্রাম ভর্তি কর। তারপর যদি প্যান্ট শার্ট ধোয়া লাগে তাহলে ছাদে আসিস!" আসলেই সোহেলের মাথায় প্রচুর বুদ্ধি আছে। আমরা ড্রাম ভর্তি করে বৃষ্টির পানিতেই কাপড় ধোয়া শুরু করলাম। কিন্তু সাবান দিয়ে খুব বেশি পরিমাণে কাচতে হচ্ছে! আল্লাহর রহমতে কাপড় ধোয়াও হল আর আমরাও পবিত্র বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করে নিলাম! চার বন্ধু লাফালাফি করে ভিজলাম। মনে হচ্ছে সেই শৈশবকালে ফিরে গেলাম আমরা। আমাদের দেখাদেখি অন্যান্যরাও তাই করলো। এমন আনন্দ শুধু ব্যাচেলরদের দ্বারাই সম্ভব!.শুক্রবারজুম্মার দিন, নামাজ পড়ে এসে শুয়ে আছি। এদিকে ক্ষুধায় আমাদের পেট ছোট হয়ে আসছে! রাফি বললো, "দোস্ত, সামনের কমিউনিটি সেন্টারে এক বড়লোকের দুলালীর বিয়ে চলছে, চল পেটের কাজটাও মিটিয়ে আসি! ফাইভ স্টার খাওয়া দিয়ে আসি!" ব্যাস, সাথে সাথে আমরা আমাদের নতুন শার্ট প্যান্ট পরে ভদ্রলোক সেজে বেরিয়ে পরলাম। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গিয়ে আহাম্মক হয়ে গেলাম! বিয়ের কার্ড দেখে সবাইকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে! আসাদ বললো, "বড়লোকগুলা এমন কিপ্টামি করতে পারে জানা ছিল না!" রাফি বললো, "তাহসিন স্যার কিছু ভাবুন!" আমি ওদের অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি পার্কিং এর প্লেসটা দেখতে গেলাম। ফিরে এসে বললাম, "শোন, আমাদের যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বরযাত্রীদের সাথে আনন্দ করে ঢুকতে হবে!" "তুই কেমনে জানলি বর পক্ষ আসে নি?" আসাদকে বললাম, "ফয়িন্নি পার্কিং প্লেসটা দেখে আয় সেখানে কোন ফুলে সাজানো গাড়ি নাই!""এখন বরযাত্রী যখন আসবে তখনই আমাদের ভিড়ের মধ্যে হইচই করে ঢুকতে হবে। পারবি না সবাই?" সোহেল বললো সে একাজে খুব এক্সপার্ট! আমি আবারও বললাম, "দেখিস বেশি জোসে এসে যাস না! তাহলে কিন্তু সমস্যা!" আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম বরের গাড়ির জন্য। প্যা প্যা আর টি টিট করতে করতে সাত আটট্টা কার আর পাঁচটা এসি বাস আমাদের সামনে থামলো! যাক আর কোনো টেনশন নাই! এত লোকের ভিড়ে কোন ঝামেলা হবে না। এরপর আমরা চারজন সানগ্লাস লাগিয়ে শিনা টান করে ঢুকে পরলাম! একই টেবিলে বসলাম চারজন। পোলাও, খাসি, মুরগীর রোস্ট, গরু মাংস ভুনাসহ আরও তিন চারটা আইটেম নিয়ে আসলো ওয়েটাররা! আমরা চারজন হাত চুবিয়ে খাওয়া শুরু করলাম! কি দারুণ স্বাদ! বুয়ার হাতের ছাই খেয়ে খেয়ে এসবের টেস্ট ভুলেই গিয়েছিলাম! লাগামহীনভাবে খেতে থাকলাম আমরা! ওয়েটার ২৫০মিলির ক্লেমন দিয়ে গেল। আমাদের খাওয়া দেখে পাশের এক লোক জিজ্ঞেস করলো, "ভাইয়ারা, আপনারা কি বরপক্ষের লোক?" আমাদের খাওয়া তখন প্রায় শেষ, এমন সময় এরকম প্রশ্নের কি উত্তর দিব ভেবে না পেয়ে বললাম, "না ভাইয়া, আমরা এলাকার পক্ষ থেকে এসছি!!" এই বলে আর দেরি করি নি। খাওয়া ছেড়ে চারজন চারদিকে ছুটলাম! কোনরকম হাতটা ধুয়ে বের হলাম সেখান থেকে!রাস্তা দিয়ে হাটছি, আর তারসাথে আজকের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটু পরপর হাসছি! একসময় সবাই একসাথে অট্টহাসি দিয়ে উঠলাম! রাস্তার অন্যান্য লোকজন ভাবছে আমরা পাগল হয়েছি! কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাদের আসলেই বারবার পাগলের মত হাসাচ্ছে! রাফি আমাকে বললো, "কিরে? অমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিস কেন?" আমি বললাম পরে বুঝবি... আসাদ বললো, "ওই শালার জন্য ক্লেমনটাও টেস্ট করতে পারলাম না!" "না বন্ধু, ক্লাইমেটস এখনও শেষ হয় নি!" বলে প্যান্টের সামনের আর পিছনের পকেট থেকে ক্লেমনগুলো টেনে বের করলাম! এই দেখে আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পরলাম সবাই! রাফি হাসতে হাসতে বললো, "কেমন পসিবল রে?" আসাদ বললো, "তোর প্যান্টে আর কি কি ঢুকানো যায়?" "তোরা তো আরামেই আছিস কিন্তু আমার সামনে পিছে যে ঠাণ্ডা হইয়া গেছে তার কি করুম?" সেদিনের অ্যাডভেঞ্চার ওখানেই শেষ। মেসে ফিরে কুড়ানো আমগুলো কেটে সরিষা, শুকনা মরিচের মসলা দিয়ে মাখিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলাম।.কথায় আছে সব কিছুরই শুরু আছে আবার শেষও আছে। আমাদের ব্যাচেলর লাইফের শুরু হয়েছিল ভার্সিটি থেকে। ব্যাচেলর লাইফের প্রকৃত আনন্দটা শেষ হয়ে গিয়েছে! আজও ব্যাচেলর আছি। এখনও বিয়ে করি নি। আসাদ, সোহেল, রাফি এরা বিয়ে করেছে। সোহেলের সাথে আমার সবসময় যোগাযোগ থাকে। রংপুর বাড়ি ওর, ইচ্ছা করলেই শেরপুর থেকে যেতে পারি বা ওকেই আসার জন্য বলি। কিন্তু আগে যেমন ফ্রি ছিলাম বা যে স্বাধীনতা ছিল সেটা এখন আর নেই। সেই ছোট্ট ছেলেরা সেদিন বাবার সাথে স্কুলে গিয়ে মার সাথে ফিরে আসতো আজ তারা অনেক দায়িত্ববান হয়েছে! চাইলেই তারা এখন স্বাধীনমত কিছু করতে পারে না। অনেক কিছুই ভাবতে হয় তাদের। মা বাবা ভাবে সেদিন ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম আর আজ ছেলেটা চাকরি করে! কোনদিক দিয়ে সময়গুলো ফুঁড়িয়ে গেল কেউ ধরতে পারলো না! ব্যাচেলর লাইফের প্রত্যেকটা দিন আমাদের স্মৃতিতে গাথা থাকবে। জানা নেই কবে এই দিন আবার আসবে বা আদৌও আসবে কিনা! ওসব দিনগুলো স্কুল লাইফের স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়ানোর মত। এখন যে যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয় পরেছি! আসাদ এখন চট্টগ্রাম থাকে। পোর্টের আমদানি রপ্তানির হিসাব নিকাশে ব্যস্ত সে। বিয়ে করেছে কয়েকমাস আগে! কিন্তু আমি ওর বিয়েতে যেতে পারি নি! অফিসিয়াল কাজে সিলেট যেতে হয়েছিল। রাফি এখন লোক প্রশাসনে নিয়োজিত আছে। সোহেল আজ অনেক নামকরা প্রোগ্রামার! ওরা সবাই নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত! আগের মত সময় হয় কারই যে চুটিয়ে আড্ডা দেব!.আজ আমার বিয়ে। ও আমি কি করি সেটা এখনও জানানো হল না। বর্তমানে আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আর যাই হোক আজ আমার টাকার অভাব নেই! আমার দুইটা ইচ্ছা ছিল। প্রথম, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা আর দ্বিতীয়, আম্মু আব্বুকে হজ্বে বা ওমরাহ তে পাঠানো যা গত মাসে পূর্ণ হয়েছে। ক্লাস টেনে আমার ইংরেজি শিক্ষক আমাকে বলছিলেন, "আজ তোমাদের মধ্যে অনেকেই দেখবে খুব ভাল রেজাল্ট করে আবার খারাপ করে। রেজাল্টের কারণে অনেকের সাথে দ্বন্দ্ব হবে। তবে একটা সময় দেখবে যারা এখন খারাপ আছে, ভবিষ্যতে তারা কোন না কোনো ভাবে নিজেদের পথ নিজেরা খুজে বের করে সফল হবে, আবার দেখবে ব্যুয়েট থেকে ডিগ্রি নিয়েও তোমাকে স্যার স্যার বলে ডাকছে! জ্ঞানটাই আসল, প্রতিষ্ঠান নয়!" হুম স্যারের সে কথাটা আমার আজও মনে আছে। ঠিক বলছিলেন স্যার। স্যারদের সকল কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং প্রমাণ হয়। আমার বিয়েতে সকল প্রকারের লোকজনকে দাওয়াত করেছি এবং বিয়ের অনুষ্ঠানটা হচ্ছে সেই কমিউনিটি সেন্টারে যেখানে আমরা চারজন এলাকার পক্ষ থেকে খেয়ে গিয়েছিলাম। আসাদ, রাফি, সোহেলকে সপরিবারে দাওয়াত দিয়েছি এখন ওরা আমার পাশেই আছে। ওদের স্ত্রীরা আছে আমার হবু স্ত্রীর সাথে! একে একে সবাই খেয়ে বিদায় নিয়েছে। বর এবং কনে একসাথে এবং তাদের অভিভাবক ও কাছের মানুষরা সব এক টেবিলে বসে আছে! আসাদ, রাফি, সোহেল আমার মুখোমুখি বসে আছে। রাফি আর আসাদ বললো, "ভাইয়া, আপনি কোন পক্ষের লোক?" সোহেল বললো, "এই টেবিলের কথা মনে আছে?" আমি আর কি উত্তর দেব? আমার তো মনে আছে, আপনাদের মনে আছে তো?.[কিছু কথা: পরতে পরতে হয়তো বিরক্তিকর লাগছে তবুও গল্পটা ব্যাচেলরদের জন্য উৎসর্গ করলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ইস্ট অর ওয়েস্ট, ব্যাচেলর্স আর দা বেস্ট!]..লেখা: Dorponer Protibimbo.
২৫।✤ ✤ গল্পঃ অদৃত্তবিশ্বের যে কজন মেধাবী আছেন যারা বিশ্বকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন তাদেরকে একটি গুপ্ত সংস্থা নজরদারি করে। অনিবার্য কারণেই ডঃ স্টিফার্সন তাদের সাথে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ। ডক্টর স্টিফ হলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ, খনিজ ও ভারী শিল্প বিশেষজ্ঞ, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার, রোবটিক ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞান বিশ্লেষক।সিক্রেট টিমের নজরদারির আওতায় থেকেই নিজের জীবনের শেষ ইচ্ছাটুকু বাস্তবায়ন করতে আরো কয়েকজন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। সবে এক ঘন্টা আগে পুরো সিস্টেমটা ইন্সটল করা হয়েছে। হাজারো ঝক্কি ঝামেলা পোহিয়ে অবশেষে সফল প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে দেখছেন মিঃ স্টিফ। আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে একবছর আগের কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠলো তাঁর মনোজগতের পর্দায়। স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য ও শেষমেষ বিচ্ছেদের ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থেকেই তিনি সম্পন্ন করে ফেললেন।✤ শংকাডঃ স্টিফের মনে ব্যাপারটা গত কয়েক মাস ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রৌঢ়ত্ব শেষ হয়ে বার্ধক্যের সময় যেন খুব দ্রুতই চলে আসছে। আজকাল ভায়াগ্রা ছাড়া কারো সাথে আনন্দও করতে পারছেন না। পরশু মিসেস স্টিফ তাঁর লাবণ্যময় মুখে একগাল হাসি নিয়ে যখন ফিরে এসে জানালেন ডাক্তার রেডিম খুব চমৎকার কিছু সময় তাঁকে উপহার দিতে পেরেছে তখন ডক্টর স্টিফের অন্তরে কিছু হারানোর বেদনা জেগে ওঠেছিল স্ত্রীর অলক্ষ্যে। যেখানে ডাক্তার রেডিমের বয়স ষাটেরও বেশি যেখানে ডঃ স্টিফ সবে চুয়ান্ন শেষ করে পঞ্চান্নতে পা দিয়েছেন।ডক্টরের মনে হচ্ছে জীবনের প্রায় সবটুকু সময় চলে গেছে। এখনই কিছু একটা করা দরকার।✤ বিরোধঃডক্টর স্টিফকে আজকাল বেশ চুপচাপ দেখা যায় অথচ মিসেস স্টিফ কচি মেয়েদের মতোই গাড়ি নিয়ে ইচ্ছেমত উড়ে বেড়াচ্ছেন। কেন জানি ব্যাপারটা অতো পছন্দ করছেন না তিনি যদিও নিজেই এতে খানিকটা বিস্মিত। তিনি মিসেস স্টিফের ব্যাক্তিস্বাধীনতা হরণের মতো একটা মানসিক অবস্থায় চলে আসছেন। অবশ্য মিসেস জেরিন স্টিফার্সনের বয়স এখনো চল্লিশের কোটায় পৌঁছেনি। কিন্তু এটা মানুষের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব প্রদর্শন ও গাম্ভীর্য তুলে ধরার মহৎ সময় চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়।যাইহোক, ডঃ স্টিফার্সন কদিন আগে সহকর্মী ডঃ জেরার্ল্ডকে বলেছিলেন ভুমিকম্প পূর্ভাবাস ও গবেষণামূলক একটি প্রতিষ্টান তৈরি করতে চান। জীবনে তো আর কম অর্থসম্পদ সঞ্চয় হয়নি। সিক্রেট গ্রুপের কাছে নিরাপদভাবে ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ সম্পদ তার রাখা আছে। নিশ্চয়ই এটা কম কথা নয়। স্টিফ নিজেকে মানবইতিহাসে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখতে চান।মিসেস জেরিন স্টিফার্সন ব্যাপারটা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি। তিনি তৎকণাৎ নিজের পা থেকে হিল খুলে হুট হাট ডক্টরের কক্ষের দিকে তেড়ে গেলেন।তাঁদের পাঁচ সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে না হবে তা চিন্তা না করে কেন তিনি সব সম্পত্তি দিয়ে গবেষণাগার তৈরি করবেন সেটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন ডক্টরের কাছে।তুষারঝড়ের কবলে পড়লে একজন মানুষ যেভাবে নিথর হয়ে যায় ঠিক তেমনি ঠায় চেয়ারে বসে মিসেসের দিকে তাকালেন তিনি। হাত দিয়ে ইশারা করলেন শান্ত হয়ে বসো।জেরিন কি মনে করে বসে অগ্নি দৃষ্টিতে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রফেসর তাকে এক পেগ দিয়ে বললেন- এটা নাও এবং শান্ত হয়ে বলো কি হয়েছে আমি বিবেচনা করবো।মিসেস জেরিন তাঁর এ লাইফ পার্টনারকে সিরিয়াস অবস্থায় খুব কমই দেখেছেন। আজ সবচেয়ে সিরিয়াস মুডে অফিস করছেন ডক্টর। আর অফিসে এত উৎপীড়ন করাটা ঠিক হবে না।✤ খবরঃজেরিন টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকাতে তাকাতে লাফিয়ে ওঠেছেন ও চিৎকার করে জিম, কার্ল, হ্যারি ও তাদের বাবা স্টিফকে ডাকছেন। "ওঃ জেসাস!! এটা সত্য!! আমাদের জেসাস সত্যিই আছেন। ও মাই গাড!!"ডঃ স্টিফও যথারীতি সবার সাথে দৌড়ে দৌড়ে আসলেন। তবে তিনি টিভি স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়ে ছেলেদের ও স্ত্রীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে?- আরে তুমি এখনো দেখছো না? খবর?- কি! কিসের খবর?- দুরঃ টিভিতে দেখ। জেসাস আকাশে দেখা দেবেন। ঠিক সন্ধার সময় চাঁদ অস্ত যাবার ঠিক পরে।- ভাল ব্যাপার।সিরিয়াস হলে কি এত চমকপ্রদ বিষয়ও এড়িয়ে যেতে হয়? জেরিন ব্যাপারটায় চরমভাবে আহত হলেন কারণ নাস্তিক্য মতবাদ থেকে অর্থোডক্স খ্রিস্টবাদে ডক্টরকে ফেরানোর ভাল একটা উপায় ছিল এটা। অথচ লোকটা একদম ভ্রুক্ষেপই করলো না।✤ রাগু হুয়শাঃজাপানের ভু-বিজ্ঞানী রাগু হুয়শা'র সাথে নির্ধারিত গোপন বৈঠকে বসার ঠিক আগ মুহুর্তে মিসেস জেরিন ডক্টর স্টিফকে ফোন করে দশ মিনিটের জন্য দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে বললেন। তাঁর ওপর বেশ জোর/প্রভাব খাটানোর ব্যাপারটাও ঠিকঠাক ধরতে পারলেন মিঃ স্টিফ।- রাগু আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন কি? ঘরের ঝামেলা? হাঃ হাঃ হাঃ- আরে রাখেন। যত্তসব। এই সময় নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখব।- হাঃ হাঃ হাঃ বেশ মজার বটে! যাইহোক, কাজের কথায় আসা যাক। আপনি শব্দশোষক যন্ত্র চালু করেছেন তো?ডঃ স্টিফ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।✤ ঝগড়াঃডক্টর স্টিফ খুব মনোযোগ দিয়ে কাঠপেন্সিলের সাহায্যে কিছু একটা ডায়াগ্রাম তৈরি করছেন শক্তপোক্ত একটি সাদা কাগজে। তাঁর হাতে গাণিতিক নকশা/ফ্লোচার্ট খুব ভাল হয়।স্ত্রী জেরিন এসে কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। এরপর তাঁর দিকে রাজ্যের বিরক্তি ও অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি সত্যি সত্যি টাকাগুলো নষ্ট করে ফেলবে?- হ্যাঁ।- এটা তুমি ভুল করছ। তুমি তোমার বাচ্চাদের ও আমার সাথে অন্যায় করছো।- তোমাদের যত টাকা পয়সা দেওয়ার দরকার তা আমি দেব। তবে বাকিটা নিয়ে কোন কথা বলতে পারবে না।- হায় জেসাস!! এটা কি হচ্ছে!!ডক্টর স্টিফ আঁড়চোখে দেখলেন মিসেস জেরিনের উভয় চোখে অশ্রু জমা হয়েছে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই এটা গাল বেয়ে নিচে পড়তে যাচ্ছে।
✤ মাটির নিচেঃভুমিকম্পের পূর্ভাবাস নিয়ে কাজ করছেন ডক্টর স্টিফার্সন। তাঁর নেতৃত্বে আছেন আরো ১০-১২ জন সর্বোচ্চ মেধাবী ব্যক্তিত্ব।বিজ্ঞানী রাগু হুয়শা, ইঞ্জিঃ জাভেদ আলবামা, ইঞ্জিঃ আকাশ মালহোত্রা, ইঞ্জিঃ ইরিওনা লারিস্তুতভা ভুগর্ভে স্থাপিত ল্যাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন। পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্যাসিফিক প্লেটের ভেতরে থেকে সমুদ্রের নিচে ডিজিটাল নাম্বার ও সংকেত, লেখচিত্র পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। বিশালাকৃতির দেয়াল জুড়ে মাল্টিপল পার্টিশনেবল স্ক্রিনে তারা প্রতি সেকেন্ডের ভূ-কম্পন দেখছেন এবং যন্ত্রের পূর্বাভাসের পার্থক্য নির্ণয় করছেন।সর্বনিম্ন ৫ মিনিট থেকে শুরু করে ৫ বছরের একটি পূর্ভাবাস সারণি তৈরি করে তাঁরা যান্ত্রিক উন্নয়নে কাজ করছেন।আপাতত প্যাসিফিক প্লেটের সাথে ইউরেশিয়ান প্লেটের কম্প্রেশনাল/ডেস্ট্রাকটিভ আচরণ নিয়ে কাজ করছেন। এটা সফল হলে তাঁরা যন্ত্রটি পৃথিবীর অভ্যন্তরে মহাদেশীয় বিভিন্ন সীমান্তে সহায়ক কম্পন পরিমাপক যন্ত্র বসাবেন।✤ পরিক্ষাঃকমপক্ষে ছয় মাসের খাবার+পানি+পথ্য নিয়ে ভূ-পৃষ্টের ৩০ কিঃমিঃ নিচে পুরো ল্যাবে অবস্থান নিয়েছেন দুঃসাহসী ২০জন মানুষ। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একটি সবুজ পৃথিবী তৈরি করা হয়েছে সেখানে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ২০ জন মানুষের মধ্যে সবাই-ই অধার্মিক-বাস্তববাদী অথবা নাস্তিক।মতের মিল থাকায় তারা স্বাচ্ছন্দ্যে সব ধরণের সামাজিক/নৈতিক বাঁধা থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছেন ও জীবন যাপন করতে পারছেন। নিজের বিবেক কর্তৃক কোন বাধার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে না কাউকে।ইতিমধ্যে ৭.৫ মাত্রার ভুমিকম্প হজম করে ফেলেছে তাঁদের ল্যাব। এই ধরণের বড় বড় ভুমিকম্প মোকাবেলা করতে পেরেছেন তাঁরা মাটির নিচে।উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেওয়া ভবিষ্যৎবাণীর ৯৮% ই সঠিক হয়েছে। তবে সমস্যার কথা হলো উপাত্তের বাইরে দুই দুইটি ৭.৩ ও ৭.৪ মাত্রার ভুমিকম্প হয়ে গেছে। এটার কারনে আরো বেশি চিন্তা ও কৌশল যুক্ত করতে কাজ করে চলেছেন এই অভিযাত্রিক দল।ব্যালকুনিতে একটি চেয়ারে বসে বসে উপাত্তের বাইরে ঘটে যাওয়া দুটি ভুমিকম্প নিয়ে ভাবছিলেন ডঃ স্টিফ। অন্যরা নিজ নিজ কাজ করছেন কিংবা বিশ্রাম নিচ্ছেন।চোখ বুজে আসছিল আসছিল এমন সময় সম্বিত ফিরে পেলেন পেছনে কোনও একজনের উপস্থিতিতে। ডঃ স্টিফের গা শির শির করতে লাগল যেন ঠান্ডা লাগছে এমন।পেছন ফিরে দেখেন গ্রাম্য পরিচ্ছেদের কুশ্রী দর্শনের চেহারাবিশিষ্ট এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপরে অনেকটা গাধার শিংয়ের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া চামড়া খুবই বেশি বয়সী মনে হচ্ছে আর কপালে বড় বড় একাধিক ভাঁজ পড়ে আছে। লোকটার কোমড়ে একটি ঘন্টিও রাখা আছে দেখা যাচ্ছে। প্রায় নগ্ন এই লোকের ত্বকে চর্মরোগের কারণে গুটি গুটি কালো বড় বড় গোলক দেখা যাচ্ছে।স্টিফার্সন কয়েকমুহুর্ত স্থির থেকে ব্যাপারটার বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করতে থাকলেন। এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল-- ভয় কিংবা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি কিছু অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী। আপনাকে আমি চিনি এবং আপনার কাজে আমি বেশ খুশি হচ্ছি।- আপনি কে?- আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। তবে আমি আপনাকে সতর্ক করতে এসেছি। সামনে কোনও একটা বিপদ আছে আর সেখানে আপনার আদর্শের পরিক্ষা হবে। আপনি কতটুকু বাস্তববাদী ও বিজ্ঞানমুখী সেটার পরিক্ষা হবে।ডঃ স্টিফ চিন্তা করতে থাকলেন ব্যাপারটা কী হচ্ছে আসলে? নিজের মনোজগতের ভেতরেই নাকি আসলেই এটা ঘটছে। লোকটাকে আরো পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন তিনি।মতিভ্রম নাকি জিরো ডিগ্রির কর্তা সেটা বুঝার জন্য ডক্টর চোখের পাতা না ফেলে খুব সন্তপর্ণে এগুতে লাগলেন। এমন সময় মনে হলো দেয়ালে আঁকা কোনও ছবি।দেরি না করে দু চোখ কচলে দেখে নিলেন। নাহঃ কোন কিছুই না। হ্যালুসিনেশন নাকি??ব্যাপারটা তিনি ডাক্তার রবার্ট এর সাথে আলাপ করলেন। এটা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা না করে কাজে মনোযোগ দিতে বললেন ডাক্তার রবার্ট।হ্যালুসিনেশন মনে করেই নিজের কাজে মন দিতে থাকলেন ডক্টর। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে পুরোপুরি কাজের মধ্যে ডুবিয়ে নিলেন এ বৃদ্ধ-প্রৌঢ় গবেষক।মনিটরিং কক্ষে গুলিয়লিম্যান কাজ করছিলেন গ্রাফচার্ট নিয়ে। দূরবর্তী সিসমোগ্রাফ হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর ভবিষ্যৎবাণী পরিক্ষা করছেন। কখন যে পেছনে এসে ডক্টর স্টিফ দাঁড়িয়ে পড়েছেন সেটা উনি খেয়ালই করেন নি।হঠাৎ এনালাইজ ডাটা'র রেজাল্ট দেখে আঁৎকে ওঠলেন তিনি। ৮.৭ থেকে ৮.৯ মাত্রার আর্থকোয়াক!!!যদিও এটা ল্যাবের এলাকাতেই বেশি কিন্তু এই মাটির নিচে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত!! সর্বোচ্চ ৮.৫ সামাল দেয়ার মতো ক্ষমতা আছে ল্যাবের বহিঃনিরাপত্তা প্রাচীরে।এখন কি করা?ডক্টর স্টিফ পেছন থেকে বললেন- দাঁড়াও। ভবিষ্যৎবাণী সত্য নাও হতে পারে। বাঁচার জন্য সবাই লাইফ কেবিনে প্রবেশ করো। এখুনি।ডক্টর এনাউন্সারে ঘোষণা করে দিলেন- এখুনি প্রত্যেকে নিজ নিজ লাইফ কেবিনে ঢুকে পড়ে, তা নাহলে প্রাণনাশের সমূহ সম্ভাবনা আছে।✤ দূর্যোগসুবিশাল প্রসান্ত মহাসাগরে তুফানের তান্ডব চলছে। শোঁ শোঁ শব্দের বাতাস ক্রমশই ভয়ংকর সাঁ সাঁ শব্দে পরিণত হচ্ছে। আকাশের রং ভয়ংকর রকমের কালো রং ধারণ করেছে।সমুদ্রের পানি উত্তেজিত হয়ে যেন বড় বড় পাহাড়ের সমান আয়তনের ঢেউ তুলে আবার নিচে পতিত হচ্ছে, আবার উঠছে। কালো বর্ণের একটি সেফটি কেবিনকে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলা করছে পানির ঢেউয়েরা।ঢেউয়ের তালে তালে কেবিনটির অবস্থা যাচ্ছে তাই হলেও এর ভেতরে থাকা মানুষটি ভাবতেও পারছে না সে কোথায় আছে। স্থলে নাকি জলে নাকি অন্তরীক্ষে তার কিছুই বুঝতে পারছে না।তবে যতই জোরে তান্ডব চলুক, সে একেবারে নিথর হয়ে পড়ে আছে। সেফটি সুইচ অফ করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষন না নিশ্চিত হচ্ছে যে, তান্ডব থেমে গেছে।ডঃ স্টিফের যতক্ষণ হুশ ছিল ততক্ষণ প্রমোদ গুণছিলেন, কখন ভুমিকম্প থামবে। তবে খেয়াল রেখেছিলেন, তিনি ইশ্বরের দ্বারস্থ হন কি-না। সত্যি কথা বলতে কী, ডঃ স্টিফ ইশ্বরের নামও মুখে আনেন নি কারণ লজিক্যালি তিনি ইশ্বরের কোনও অস্তিত্ব পান নি। বরং এই দূর্যোগের মধ্য দিয়ে ডক্টরের দর্শন আরো পাকাপোক্ত হলো যে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণেই ইশ্বর সৃষ্ট হয়েছে মানুষের নিকট।এদিকে সেফটি কেবিনের ব্যাটারী ক্রমশই কমতে থাকল এবং একটা সময় এটি ডঃ স্টিফকে ওয়ার্নিং এওয়েক করতে বাধ্য হলো। সহসাই নিরাপদভাবে ডক্টর স্টিফ সজাগ হলেন এবং নিজেকে ভরসন্ধ্যায় কোনও এক সামুদ্রিক দ্বীপে আবিস্কার করলেন।ডঃ স্টিফ এটাকেও হ্যালুসিনেশন হিসেবে নিতে চাইলেন এবং নিজের দৈবজ্ঞান যাচাই করতে থাকলেন।নিজের শারিরিক পরিক্ষা শেষে ছোট কম্পিউটারে সেফটি লগ পড়ে নিশ্চিত হলেন যে, আসলেই তিনি দুর্যোগে পড়ে এই দ্বীপদেশে চলে এসেছেন।জীবনে কখনোই তিনি সার্ভাইভ করেন নি। কিন্তু ভাগ্যের দোষে আজ এই অচেনা জংগলে খাবার ও আবাসের জন্য তাঁকে এই বুড়ো বয়সে কাজ করতে হবে?অগত্যা কি আর করা। ডক্টর তার খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।✤ নাম না জানা দ্বীপে একাঃআমরা যতই বাস্তববাদী হই না কেন, অনিশ্চয়তার সমীকরণ থেকে পুরোপুরি নিজেকে অবমুক্ত করতে পারি না। আজ আপনি যে অবস্থায় আছেন, আগামিকাল ঠিক একই অবস্থানে থাকবেন অথবা আরো উন্নত হবেন সে নিশ্চয়তা কেউ আপনাকে দিতে পারবে না। আপনি হোয়াইট হাউসে থাকুন কিংবা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের কমপ্লেক্সে বসবাস করেন না কেন, একটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আপনি এখানেই থাকতে পারবেন কিংবা প্রতিকূল সময় পাবেন না সে ভরসা, সে গ্যারান্টি কেউই দিতে পারবে না।অথচ ডক্টর স্টিফ মনে করতেন যে, সময় বদলেছে। এখন মানুষ আর প্রকৃতির অধীন নয়, তাই ভাল সময়ের নিশ্চয়তা একান্তই ব্যক্তির ওপর বর্তায়। অন্য কোন শক্তির হাত থাকা সম্ভব না। বড়জোর প্রভাবিত হতে পারবে একটু আধটু।স্টিফার্সনের ভাবনা ও যুক্তিবিদ্যাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিল প্রকৃতি। আজ সেটা হারে হারে টের পাচ্ছেন তিনি। স্টিফ কখনোই প্রতিকূল পরিবেশে থাকবেন সেটা ভাবেন নি।উপরি পাওনা হলো এমন সময় তিনি এই নির্জন দ্বীপে পৌঁছেছেন যখন থাকার জন্য কোন জায়গা প্রস্তুত করতে করতেই রাত হয়ে যাবে।সন্ধ্যার যে অল্প আলো পাওয়া যায়, সেটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি কিছু লতাপাতা ও দড়িসদৃশ কিছু জৈব লতা যোগাড় করে ফেলতে অবশ্য পেরেছেন। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটি বড় গাছও পেয়ে গেলেন যেটা কোনপ্রকারে এক রাত কাটানো যাবে। তবে বৃষ্টি আসলে আর রক্ষা থাকবে না। তাই প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভর করে প্রথম রাতটুকু কাটিয়ে দিতে মনস্থির করলেন।এক রাত থাকার জায়গায় স্টিফ ৩-৪ রাত থাকলেন ঐ গাছের কান্ডে তবে এর মধ্যে একবার বৃষ্টিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জবুথবু বৃষ্টিতে রাতদুপুর অন্ধকারে তার যে করুণ দশা হয়েছিল সেটা একমাত্র ডক্টর স্টিফই জানেন।ত্বকে কি-রকম একটা স্যাঁতস্যাতে অনুভুতি, সাথে চুলকানি। ঘন্টা দুয়েক পরে অস্বস্তির রেশ কাটবে তো দূরের কথা শরীরে জ্বর এসে গেল। জ্বরের মধ্যে কি-সব বকবক করতে করতে দুর্বল কায়ার ঘুম এসে যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করল।ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস স্টিফার্সনের একেবারে নেই-ই বলা চলে। তবে আজ জ্বরের ঘোরে তিনি নিজের ছোটবেলা, ভাই, বোন, মা-বাবা, ঝগড়া, পাশের বাড়ির স্মিথ, কার্ল, পিডু-দের দেখলেন।গ্রামের সবুজ ক্ষেতের মধ্য দিয়ে তাদের ঘুড়ি ঘুড়ি খেলা, পাশের নদীতে ঝাঁপিয়ে গোসল করা, মা-বাবার বকুনি, স্কুলে স্যারের সাথে ফাজলামো..ডক্টর স্টিফ কতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কিংবা বেহুঁশ ছিলেন সেটা নিজে বলতে পারলেন না। তবে চোখ খুলে দেখেন সুবিশাল নীল-সাদা আকাশ, তার আঙিনা জুড়ে শুভ্র মেঘের পথচলা। এই অবস্থাতেই স্বপ্নে দেখা ছোটবেলার কথা মনের পর্দায় ভেসে ওঠলো তবে কয়েক মুহুর্তের বেশি তা স্থায়ী হলো না। চোখটা একটু অন্যদিকে নিতেই বিরাটকায় একটি পাখি যার একটি পা-ই মোটামুটি তার শরীরের সমান সেটার পাখায় নিজেকে আবিস্কার করতে হলো স্টিফার্সনকে। এত বিশাল পাখি কেবল গল্পে আর উপন্যাসেই থাকতে পারে, বাস্তবেও যে সম্মুখিন হতে হবে সে ব্যাপারটি জানা ছিল না।পাখির ভয়ানক ঠোঁটের দিকে দেখে তার বুকটা ধক করে উঠেছিল। তবে এর চোখে দৃষ্টি বড়ই মায়াময়! যেন পরম মমতা ঐ দুটি চোখে সংরক্ষণ করে কেউ রেখে দিয়েছে।এইরকম সার্ভাইবে পড়লে মনে হয় দিব্যজ্ঞান দিয়ে প্রথমে কয়েক মিনিট পাখির আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। স্টিফার্সনও তা করলেন অবচেতনভাব এবং খানিকক্ষণ পরে নিশ্চিত হয়ে নিলেন, এই বৃহদাকার পাখি তাকে মারতে নয়, বাঁচাতে চাইছে। পাখিটি তাকে চোখ মেলতে দেখে ডানা থেকে পায়ের পাতায় ফেলে দিল। স্টিফ বুঝতে পারলেন না, যদি তাঁকে বাঁচাতেই চাইবে তাহলে কেন এই অনাদর?যে গাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটির পাত্তা তো নেই-ই বরং পাখি তাকে কয়েক শো ফুট উঁচু ডালে বানানো বাসায় নিয়ে এসেছে।পাখিটি কুঁক কুঁক করে মৃদু ডেকে ওঠলো। স্টিফ এখনো পাখির আচরণ ব্যখ্যা করতে পারলেন না। এটা আসলে কি করতে চাইছে? আরেকটু দূরে আরেকটি পাখি বিশালকায় ডিম নিয়ে বসে আছে দেখা যাচ্ছে।পাখির চোখের দিকে তাকালে রাজ্যের মমতার উপস্থিতি অনুভব করা যায় কিন্তু কেন অদ্ভুত শব্দ করছে সেটা নিজে কোনভাবেই ঠাহর করতে পারলেন না।কি মনে করে পায়ের পাতায় বসে পড়লে পাখিটি সাঁই করে উড়ে চলল। এই সময় তিন বুঝতে পারলেও দেহের সাথে অভিকর্ষজ টানজনিত কারণে ভুতলের দিকে পড়ে গেলেন।এবারও ত্রাণকর্তার মতো পাখিটি চিঁ চিঁ করে চিৎকার দিয়ে ভু-পৃষ্টের শ-খানেক ফুট উঁচুতে থাকতেই ঠোঁট দিয়ে ধরতে সক্ষম হলো বেচারি।এরপর তাঁকে নিয়ে দ্বীপ বন জঙল পেরিয়ে উড়ে চললো সমুদ্রের উপর দিয়ে, নীল ঘন পানি আকাশের নীলে আরো লীলাভ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নীল রঙ দিয়ে একটি সীমানাহীন জায়গায় পানি রাখা আছে।স্টিফ ভাবছিলেন, পাখিটি তাঁকে মূল ভূ-পৃষ্টে নিয়ে যেতে হয়তোবা চাইছে, হয়তোবা মুল ভূ-খন্ডে ফিরিয়ে আমার প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করছে।বেশ কতক্ষণ উড়ার পরে স্টিফার্সনের ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। নাম না জানা অতিকায় পাখিটি তাঁকে আরেকটি বিশাল দ্বীপে নিয়ে এসেছে। এই দ্বীপেও কোন মানুষ নেই তবে এখানে হাজার হাজার গাছ গাছালি ও ফল-ফুলের জঙল। পাখিটি তাঁকে জঙলে ছেড়ে নিজের জন্য খাবার খেতে পাশের একটু উঁচু গাছে উঠে বসে একটা কাঠবিড়ালীকে ছিন্নভিন্ন করে গলাধকরণ করে ফেলল।স্টিফার্সন অভিভূত হলেও নিজের জন্য খাবার পরিক্ষা করে খেতে থাকলেন। দেহে এখনো বেশ জ্বর!
✤ একা একাঃস্টিফের বয়স অনেক বেশি মনে হচ্ছে এখন। দৈহিক শক্তি নিয়ে নিজের সংস্থান করতে অক্ষম মনে হচ্ছে। যে পাখিটি এখানে তাঁকে নামিয়ে দিয়েছিল সেও আর আসলো না, বাসায় তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে না। খাবার থাকলে কি হবে, সাপখোপের ভয়ে তাকে সারাক্ষণ শংকিত থাকতে হচ্ছে।প্রশান্ত মহাসাগর কি-না সেটাও এখনো নিশ্চিত না স্টিফার্সন। মাত্রই কয়েকদিন আগে তিনি ভূ-গর্ভে ল্যাবে কাজ করছিলেন আর আজ এ জনমানবহীন দ্বীপে কোন প্রকার খাদ্য, চিকিৎসা, নাগরিক অবকাঠামো সুবিধা ছাড়া এক কাপড়ে কাটাতে হচ্ছে।এটা স্বপ্ন বলে কাটিয়ে দিতে কতোবার চেষ্টা করেছেন তার গণনা বের করা মুশকিল। আধুনিক নগরজীবনে অভ্যস্থ থাকায় চরম পর্যায়ের অসুবিধা হচ্ছে মিঃ স্টিফার্সনের।এক মগ কফি ঘুম থেকে উঠে পান করা ছাড়া যে স্টিফের দিন শুরু হওয়া ছিল প্রায় অস্বাভাবিক ব্যাপার সেখানে দিনের পর দিন রাতের পর রাত চা-কফি এবং কোনও প্রকার ড্রিংকস ছাড়া জীবনটা চলে যাচ্ছে! চিন্তা করা যায়??একটা লাল রঙের ফল দেখা যাচ্ছে তবে বেশ উঁচুতে। স্টিফ ঐ ফলের লোভ সামলাতে পারছেন না। তিনি গাছ বাইতে শুরু করলেন। কিন্তু গাছটি পিচ্ছিল বলে খুব সাবধানে উঠতে হচ্ছে।স্টিফের সামান্য লোভ বিশালকায় বিপদ ডেকে নিয়ে আসল। তিনি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে ফেললেন। প্রথমে ভেবেছিলেন ব্যাথা কম। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখে তারাফুল দেখলেন এবং আঁৎকে ওঠে পড়ে গেলেন।হুঁশ চলে যায়নি বিধায় পায়ের ব্যাথাটা আরো বাড়ছে মনে হচ্ছে। স্টিফ মুখ দিয়ে যথেচ্ছা ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকলেন। কাকে গালি দিচ্ছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।তার কাতরানো শুনে দুটি খরগোশ পাশে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত সমবেদনা জানাতে এসেছে। স্টিফ তাদেরও গালিগালাজ করলেন তবে এরা কিছুই বুঝলো না।বেশ খানিক্ষণ পরে তারা চলেও গেল। এখন স্টিফ একা। একটু বসে পড়বেন সে উপায়ও নেই, দাঁড়ানো তো আরো বহু পরের কথা। শেষপর্যন্ত তিনি হতাশ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভর দুপুরের সুর্য মাথার ওপরে থাকায় প্রচন্ড গরমে দিগন্তের দিকে নিথরভাবে তাকিয়ে থাকলেন।
✤ বিপদ কাটে নাঃস্টিফার্সন একটা ব্যাপার কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে, এখানেই তার আয়ু শেষ তথা আজ/কালই তাঁকে মরে যেতে হবে। পায়ের ব্যাথা কমবার কোনও লক্ষণ নেই। কোন সাপ-জন্তু এসে তাকে আক্রমণ করতে পারে কিন্তু এই ব্যাথাতুর পা নিয়ে এত পথ যাওয়া অসম্ভব।অগত্যা স্টিফ আকাশের দিকে বিভিন্ন কোণে তাকাতে থাকলেন এবং চিন্তা করার কোনও উপায় খুঁজলেন। শেষমেষ জগৎ সংসার সূচনা নিয়ে নিজের জানা তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখতে থাকলেন।এভাবে ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে মধ্যরাত হয়ে গেল। স্টিফের পায়ের কোনও উন্নতি হলো না।চিন্তা ভাবনার এক পর্যায়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টা দিয়ে অনেক সমীকরণ মিলাতে চেষ্টা করলেন। অনেকটা সফলও হলেন বটে। তখন তিনি দুটি পথ খুঁজে পেলেন।১. এই ব্যাথা না কমলে তিনি এখান থেকে সরতে পারবেন না ও এখানেই তার মৃত্যু হবে। এখানে কেউই সাহায্য করার কথা না। জীবন এখানেই শেষ।২. ইশ্বর বলে কেউ থাকলে সাহায্য করতে পারবেন। ক্যালরিও যেহেতু কমে আসছে তাই উনার কাছে চেয়ে দেখতে পারি, কোনও সাহায্য আসে কি-না।স্টিফার্সন খানিকটা হতাশ কারণ, আকাশে যে জেসাস কে দেখানো হয়েছিল তা সিক্রেট সংস্থার একটি কার্যক্রম বৈ কিছু নয়। এমনকি তিনি নিজেও এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তারপরও এই ঘোর বিপদে ইশ্বরের শরণাপন্ন হলেন ডঃ স্টিফ।✤ প্রার্থনা“ওহে!যদি আপনার অস্তিত্ব থেকে থাকে, যদি আপনি এই সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা হন, যদি আপনি এই মানব জাতিকে সৃষ্টি করে থাকেন, যদি আপনি এই পৃথিবীতে অ্যাডাম ঐভ'কে পাঠিয়ে থাকেন, যদি সবকিছু আপনার হুকুমে চলে থাকে..তবে-আমাকে আপনি কোনও নিদর্শন দেখান। আমাকে সাহায্য করুন। আমাকে সুস্থ করুন। আমাকে আমার জেরিনের কাছে নিয়ে যান। পথ দেখান আমাকে। পথ দেখান!!!!!”মনোরম চাঁদজোছনার খোলা আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে গভীর রাতে এইভাবে চিৎকার ও কান্নাকাটি করতে থাকলেন স্টিফার্সন।২৬।সায়েন্স ফিকশন - স্প্লাটুজেনাস গ্রহের একজন কেন্টর – সেরিনা - পর্ব - ০১
সাল ৩৪৮৩স্প্লাটুজেনাস গ্রহে ভোটের আবহ চলছে । আর কয়েকদিন পরেই নির্বাচন । কে হবে হনুমিনাসদের রাজা । এই হনুমিনাস জাতি যুগ যুগ ধরে তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছে ভালোভাবেই । এদের প্রতিযোগিতা আজ শুধু সাপার্ট-দের সাথে । বলা হয়ে থাকে, ২৯০০ সাল পর্যন্ত এই হনুমিনাস জাতির পূর্বপুরুষ অর্থাৎ হোমো সাপিয়েন্স নামক জাতি সৌরজগতের পৃথিবী নামক ছোট্ট একটি গ্রহে বাস করতো । হোমো সাপিয়েন্সদের যেমন মানুষ বলা হতো, হনুমিনাসদের বলা হয় কেন্টর ।সাপার্ট-দের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি এই হোমো সাপিয়েন্সদের কাছ থেকেই । কেন্টররা হনুমিনাস জাতি হলেও সাপার্ট-রা কোন জাতি নয়, তাদের জন্ম হয়না । তাদেরকে সৃষ্টি করা হয় । মানুষদের কাছ থেকেই সর্বপ্রথম সাপার্ট-রা সৃষ্ট হয় । আর এখন তারা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করে । তাদের মৃত্যু নেই, ধ্বংস আছে । তাদের অবশ্য সৃষ্ট হওয়ার একটাই লক্ষ্য, কেন্টরদের সাথে লড়াই করা তথা যুদ্ধ করা । মানুষরা অবশ্য এই সাপার্ট-দের সৃষ্টির শুরুতে অর্থাৎ সাপার্ট-দের প্রথম দিকে নামকরণ করেছিল রিতুরিক নামে, যারা আদৌ প্রাণী ছিল না, তারা ছিল রবোটিক । কালের বিবর্তনে প্রোটোকল ভেঙ্গে অনেকবার বিবর্তনের মাধ্যমেই এই রিতুরিক জাতি থেকেই সাপার্ট-দের আত্মপ্রকাশ । অবশ্য এই প্রোটোকল ভাঙ্গার কারণেই মানুষরা তাদেরকে নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় । (প্রধান প্রোটোকলই ছিল রিতুরিক-রা কোন ক্রমেই কোন মানুষকে আক্রমণ করতে পারবে না) । এই সাপার্ট-রা কয়েক শতাব্দি ধরে তারা তাদেরই পূর্বপুরুষদের (রিতুরিকদের) সৃষ্টিকারী জাতির সাথে অস্তিত্ব লড়াইয়ের যুদ্ধে অবতীর্ণ । সাপার্ট-রা অবশ্য এই স্প্লাটুজেনাস গ্রহে থাকে না, তাদের বসবাস পার্শ্ববর্তী নক্ষত্র জেমহেইনাসের অন্তর্গত একটি গ্রহ রালটেইটিকে । আর স্প্লাটুজেনাস গ্রহটি সেনচারমেন নক্ষত্রের অন্তর্গত । হনুমিনাস ও সাপার্ট-দের মধ্যেকার যুদ্ধ বাধে মহাকাশের আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে ।সেনিরা তার ফ্ল্যাটের করিডরে দাড়িয়ে আছে বেশ অনেকক্ষণ ধরেই । আশপাশ দিয়ে ফ্লায়িং সসারগুলো সাই সাই করে উড়ে যাচ্ছে । সেনিরা এই গ্রহের সবচেয়ে নিচু বিল্ডিঙটাতে বসবাস করছে আজ প্রায় পঁচিশ বছর । সে এই বিল্ডিঙয়ের ১২৬ তলায় থাকে । সেনিরা এই ফ্ল্যাটে একাই থাকে । ওর দুইটা পারসোনাল রবোটিক হেল্পার আছে । জেনা ও ব্লাটনিস । যদিও রবোটিক ব্যাপারটিতে লিঙ্গ স্পেসেফিক থাকে না । তবে সেরিনা মনে করে জেনা মেয়ে আর ব্লাটনিস ছেলে । রবোটিক হেল্পার হিসেবে যেগুলো ব্যাবহার করা হয়, এগুলোও অনেকটা সাপার্টদের মত । তবে এদেরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করে কেন্টর-রাই । সাপার্টদের সাথে নিত্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া কেন্টর-রা যখন বুঝতে পারে, আসলেই রবোটিক কোন উপাদান তাদের দৈনন্দিন জীবন অনেক সহজ করতে পারে, তখন থেকেই এই রবোটিক হেল্পার তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় । এরপর কেন্টরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা একমত হয়েই সর্বপ্রথম রবোটিক হেল্পার তৈরি করে । সে বহুকাল আগের কথা । আর এখন তো স্প্লাটুজেনাস গ্রহে বসবাসকারী সকলেরই এই রবোটিক হেল্পার আছে । কারও কারও একের অনেক বেশি রবোটিক হেল্পারও আছে । অবশ্য এই রবোটিক হেল্পার গৃহস্থালি কাজে যেমন ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনি কর্মক্ষেত্রেও সমান হারে ব্যবহৃত হয় ।সেরিনা দনারাল হাউজের ফিফথ লেভেলের এক্সকিউটিভ হেডের পারসোনাল সেক্রেটারি । ফিফথ লেভেলের হেড জনাব লাইকিন সেজুয়াল এই পদে আছেন আজ প্রায় দশ বছর । সেরিনা অবশ্য বিশ বছর ধরে এখানে আছে । লাইকিন সেজুয়ালের আগে জনাবা ইরিনা জেন্টুলের অধীনে কাজ করতো সে । এরপর ইরিনা জেন্টুল প্রমোশন পেয়ে থার্ড লেভেলে চলে গেলেও সেরিনা ফিফথ লেভেলেই থেকে যায় ।দনারাল হাউজ স্প্লাটুজেনাস গ্রহের মেইন অপারেটিং বিল্ডিং । বিল্ডিঙটি মোট ৮৬০ তলা । এই বিল্ডিঙটিতে কাজ করার জন্য মোট বারোটি লেভেলে ভাগ করা হয়েছে । এর মধ্যে প্রথম ২২০ তলা পর্যন্ত বারোতম লেভেল, তার উপরের ১৫০ তলা পর্যন্ত এগারোতম লেভেল, এর উপরের ৯০ তলা পর্যন্ত দশতম লেভেল, এর উপরের ৮০ তলা পর্যন্ত নবমতম লেভেল, এর উপরের ৭০ তলা পর্যন্ত অষ্টমতম লেভেল, এর উপরের ৬০ তলা পর্যন্ত সপ্তমতম লেভেল, এর উপরের ৫০ তলা পর্যন্ত ষষ্ঠতম লেভেল, এর উপরের ৪০ তলা পর্যন্ত পঞ্চমতম লেভেল, এর উপরের ৩০ তলা পর্যন্ত চতুর্থতম লেভেল, এর উপরের ২০ তলা পর্যন্ত তৃতীয়তম লেভেল, এর উপরের ১৫ তলা পর্যন্ত দ্বিতীয়তম লেভেল, এর উপরের ১০ তলা প্রথমতম লেভেল । এর উপরের বাকী ২৫ তলা এই গ্রহের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এক্সকিউটিভ হনুমিনাসদের জন্য । সেখানেই তাদের কার্যালয় । সেই অনুযায়ী সেরিনা এই দনারাল হাউজের ৭২০ তলা থেকে ৭৬০ নং তলা পর্যন্তই কাজ করে ।সেরিনা আগে থেকেই ভেবে রেখেছে এবার সে ভোট দিতে যাবে না । এই ভোটের সিস্টেমটাই তার কাছে খুব জঘন্য লাগে । তার জন্মদাতা, পিশযিক কানাহন (যাকে সে ড্যাডি বলে ডাকতো), গতবার সেও এই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল কিন্তু বেলায়েক হিউয়ানের কাছে হেরে যায় । সেরিনার এই স্প্লাটুজেনাসে আপন বলতে একমাত্র ড্যাডি-ই ছিল । তার মাম্মি অনেক আগেই তার জন্মের সময় মৃত্যুবরণ করে । আর তার কোন ভাই-বোনও নেই । এরপর বেলায়েক হিউয়ান কেন্টর-দের রাজা হয় । পিশযিক কানাহনের ভোটে দাঁড়ানোর ব্যাপারটাকেই যেন বেলায়েক হিউয়ান অপমান হিসেবে নিয়ে নেয় এবং তাকে সাপার্ট-দের সাথে যুদ্ধে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে রালটেইটিক গ্রহে যেতে বাধ্য করা হয় । সেখানে পিশযিক কানাহনের মৃত্যু হয় । আসলে কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, এই ব্যাপারটিতে ধোঁয়াশা থেকে যায় । সেরিনার ড্যাডির একজন সহ-সৈনিক নাম না বলার শর্তে সেরিনাকে যুদ্ধের পরপর ফিরে এসে ফোন করে বলেছিল, তার ড্যাডিকে নাকি এমনিতেই মেরে ফেলার নির্দেশ ছিল, এমনকি যুদ্ধে মারা না গেলেও । সেই থেকে সেরিনা বেলায়েক হিউয়ানের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার অপেক্ষায় আছে । আর এরপর থেকে ভোটের কথা এক প্রকার শুনতেই পারে না সে ।কেন্টরদের রাজা হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে মোট তিনজন প্রার্থী । তারা হলেন বেলায়েক হিউয়ান, ফিউমোরাস জেনিনি ও রুইনি সেজার্ট । এদের মধ্যে বেলায়েক হিউয়ান হচ্ছেন সাবেক রাজা (যার কথাই একটু আগে বলা হলো) এবং বর্তমানে দনারাল হাউজের প্রথম লেভেলের হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন । সাবেক রাজা হওয়া সত্ত্বেও বেলায়েক হিউয়ান বেশ জনপ্রিয় । ফিউমোরাস জেনিনি তিনি এই স্প্লাটুজেনাস গ্রহের সিকিউরিটি হেড । অর্থাৎ গ্রহের সকল সামরিক বাহিনী তার নির্দেশেই পরিচালিত হয় । তার এইবার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । রুইনি সেজার্ট অবশ্য একমাত্র নারী প্রার্থী এবং এবারই তিনি প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছেন ।বেলায়েক হিউয়ান গতবার তিন বছরের জন্য পদে ছিলেন । তার নেওয়া মহাকাশ আপোষনীতির কারণে তিনি বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন । অর্থাৎ তিনি সাপার্ট-দের সাথে সন্ধি করেছিলেন । অবশ্য তার বেশ কয়েকটি যুক্তিও ছিল । সাপার্ট জাতির মৃত্যু নেই, শুধু ধ্বংস আছে । কিন্তু কেন্টর-দের সকলেরই মৃত্যু আছে । সাপার্ট-রা কেন্টরদের এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়েছে আগের বেশ কয়েকটি যুদ্ধে । এতে করে স্প্লাটুজেনাস গ্রহের বেশ কয়েকজন সাহসী সামরিক জেনারেল যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছে, যেটি আসলে কাম্য ছিল না । কিন্তু বেলায়েক হিউয়ান তার এই নীতি সাধারণের কাছে বুঝাতে সক্ষম হননি । ফলশ্রুতিতে এবার তার জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম ।ফিউমোরাস জেনিনি খুবই শক্ত ব্যক্তিত্বের একজন । তিনি স্প্লাটুজেনাস গ্রহের সিকিউরিটি প্রধানের দায়িত্বটি পেয়েছেন অনেক বছরে সাধনা করে । এই জন্য তাকে বেশ কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়েছে । কর্মজীবনের শুরুতে তিনি সেনচারমেনীয় প্যানেল (সেনচারমেন নক্ষত্র থেকে যে বিকিরণ আসে, তা এই প্যানেলের মাধ্যমে কার্যপ্রবাহের মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্প্লাটুজেনাস গ্রহে সকল ধরণের প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করা হয় । সেনচারমেন নক্ষত্রই এই স্প্লাটুজেনাস গ্রহের সকল শক্তির আধার) কারখানায় প্রথম কাজ নেন । সেখান থেকে তার রাজনীতিক ক্যারিয়ার শুরু । এরপর তিনি দনারাল হাউজের সপ্তম লেভেলের এক্সকিউটিভ হেড হন । তারও বেশ কয়েক বছর পর তিনি স্প্লাটুজেনাস গ্রহের প্রধান সামরিক বাহিনী টেকনো-এর হেড হন । (এই টেকনো বাহিনী-ই সাপার্টদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে) সেখান থেকে তিনি আজ এই অবস্থানে । তার সাপার্ট জাতির বিরুদ্ধে নেওয়া বেশ কয়েকটি সাহসী যুদ্ধনীতির কারণে তিনি কেন্টরদের প্রায় সকলের কাছে খুব প্রিয় একজন মুখ । তার সবচেয়ে ভালো যে দিক, সেটি হলো, তিনি খুব কমই আপোষ করেন । এই কারণেই এইবার তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি ।রুইনি সেজার্ট এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ ও অনেকটাই নতুন মুখ । তার বয়সও বেশি না, তরুণীই বলা চলে তাকে । রুইনি সেজার্টের প্রধান নীতি পরিবর্তন । পরিবর্তন সবকিছুর । যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি, ক্ষুদার পরিবর্তে খাদ্য, হিংস্রতার পরিবর্তে শিক্ষা ইত্যাদি । অনেকটাই নমনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি । আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও সত্য, তার নতুন রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এই নীতি কেন্টর-দের মধ্যে এক ধরণের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে । এই তিনজনের মধ্যে সেই একমাত্র পরিবর্তনের পক্ষে । সে বর্তমানে একজন সমাজ কর্মী । এতটুকু বয়সেই সে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ক্যালিয়াস ইউনিভার্সিটি, যেটি কিনা এই স্প্লাটুজেনাস সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে অতিথি হিসেবে পরিবর্তন নিয়ে বক্তব্য দিয়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে । তার পক্ষে কেন্টর-দের অধিকাংশ তারণ্যের সমর্থন রয়েছে । তবে এইবার তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা পারতপক্ষে কম অর্থাৎ খুব আশ্চর্যজনক কিছু না ঘটলে জেতার কোন সম্ভাবনা নেই, আর এই কথাটি রুইনি সেজার্ট নিজেও জানে । তাই তো সে বর্তমান এই নির্বাচনের বাইরে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপারগুলো নিয়েই বেশি ভাবছে ।এই কেন্টর ও পূর্বের মানুষদের মধ্যে বিবর্তনজনিত পরিবর্তন রয়েছে । স্প্লাটুজেনাস গ্রহটি পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে বেশ বড় কিন্তু পৃথিবীতে যেমন তিন ভাগ পানি, আর এক ভাগ স্থল ছিল, আর সেই স্থল অংশেই মানুষের বসবাস ছিল । তেমনি স্প্লাটুজেনাস গ্রহটিতে সেনচারমেনের সরাসরি রেডিয়েশনের প্রভাবে প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশ প্রায় উত্তপ্ত অবস্থায় আছে । সেখানে কারও বসবাস সম্ভব নয় । এই কেন্টরদের বুদ্ধিমত্তা লেভেল মানুষদের মত তত বেশি না হলেও, এরা উন্নতিতে মানুষের চেয়ে ঢের এগিয়ে । স্প্লাটুজেনাস গ্রহটি কোন মহাদেশ, দেশ অর্থাৎ সোজা কথায় অঞ্চলভেদে বিভক্ত নয় । এখানে তাই হয়, যা দনারাল হাউজের প্রতিটি লেভেলের হেড ও কেন্টরদের রাজা মিলে সিদ্ধান্ত নেয় । এই গ্রহে মোট পনেরোটির মত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এগুলোতে সব ধরণের বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যবহারিকের সাথে শিক্ষা দেওয়া হয় । অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তত্ত্বীয় বিষয়াবলীর থেকে ব্যবহারিক বিষয়াবলীর উপর জোর বেশি । তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধানদেরও দনারাল হাউজের প্রতিটি লেভেলের হেডের সমমর্যাদা দেওয়া হয়, যদিও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় চালানো ছাড়া অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয় না । তাছাড়া কেন্টর-রা প্রযুক্তিগতভাবে বেশ উন্নত । এই স্প্লাটুজেনাস গ্রহের অধিকাংশ কাজই প্রযুক্তিনির্ভর এবং সকল তথ্য দনারাল হাউজের প্রধান সুপার কম্পিউটার “ডেলনা” দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । এই ডেলনা-এর নিয়ন্ত্রন করার অধিকারও দেওয়া হয়েছে দনারাল হাউজের প্রতিটি লেভেলের হেড ও কেন্টরদের রাজাকে । এই তো গেলো, স্প্লাটুজেনাস গ্রহের বিস্তারিত ।(বাকিটা আগামী পর্বে).
২৭।অণুগল্পঃ সাইকোডেলিক স্বপ্ন১.অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছি। কিভাবে কি করবো, তাও আবার একা? ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে নিয়মাবলী সংগ্রহ করা হয়েছে, তারপরেও একটা দ্বিধা থেকে যায়।সবটুকু দ্বিধা ঠেলে উঠে পড়লাম, এগিয়ে গেলাম অন্ধকার ঘরটার দিকে। হাতড়ে লাইট জ্বালিয়ে দিতে কোন সমস্যা হলোনা। এরপরেই চোখে পড়লো bowl এর পানির মধ্যে থাকা থকথকে ছিন্নভিন্ন অংশগুলোর দিকে।অনেক কাজ বাকী আছে, আর দেরী করা ঠিক হবেনা। চোখ মুখ কুঁচকে হাত এগিয়ে দিলাম, মুরগীর মাংসগুলো পরিষ্কার করে রাঁধতে হবে।২.একনাগাড়ে ছুটে চলেছি। কতক্ষণ? সেটা বলতে পারবোনা, তবে আচমকা নিজের অস্তিত্বে তাকিয়ে দেখলাম দৌড়াচ্ছি। চারিদিকে অন্ধকার আর কুয়াশা।এখন মনে হলো থামা দরকার। গতি শ্লথ করে দিতেই বুঝলাম বনের মধ্যে ছুটছিলাম। ঘাড়ের মধ্যে কিযেন সুড়সুড় করতেই অভ্যাস বশত হাত দিলাম। জিনিসটা লেপ্টে গেলো, ইয়াক!চোখ পড়লো সামনেই একটা ঝোঁপ। এগিয়ে গেলাম, ঝোপ সরিয়ে পা চালিয়ে দিতেই ছলাত করে কাদা লেগে গেলো, কি ঝামেলা! হঠাত হুড়মুড় করে পড়ে যেতে লাগলাম।"হৈ হৈ ছ্যামড়া, উঠ। বিছানা ছাইড়া মেঝেতে কি করোস? ঘাড়ে তেলাপোকা ক্যা? পানির জগও ফালায় দিছস হারামী।"২৮।অনুবাদ গল্পঃ এভেলিন
জানালার ধারে বসে সে দেখছিল এভিনিওতে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা। তাঁর মাথাটা ঝুঁকে ছিল জানালার পর্দা গুলোর দিকে আর তাঁর নাসারন্ধ্রে লেগে ছিল ধূলিমলিন কাপড়ের গন্ধ। সে ছিল ক্লান্ত।কয়েকটা লোক অতিক্রম করে গেল। সর্বশেষ কুঠি থেকে বের হওয়া লোকটাও রওয়ানা দিল বাড়ির দিকে; শান বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে চলা লোকটার পায়ের খটখট আওয়াজ ভেসে আসছিল তাঁর কানে, পরক্ষণেই লোকটা লাল বাড়ি গুলোর সামনের কয়লা কাঠের রাস্তা ধরে কচকচ শব্দে এগুতে লাগলো। এক সময় সেখানটায় একটা মাঠ ছিল যেখানে তাঁরা প্রতি সন্ধ্যায় অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে খেলা করত। তারপর বেলফাস্ট থেকে এক লোক এসে কিনে নিলো পুরো মাঠটা, বাড়ি বানালো তাঁর উপর— এই বাড়ি গুলো তাঁদের ছোট্ট বাদামি বাড়ি গুলোর মত নয় বরং চকচকে ছাদ ওয়ালা ইটের ইমারত। সে আর তাঁর ভাইবোন আর ডেবিন, ওয়াটার, ডান পরিবারের বাচ্চারা মিলে খেলা করত সেই মাঠে, সাথে আরও থাকত ছোট্ট বিকলাঙ্গ কয়েগ। আরনেষ্ট কখনো খেলত না, সে ছিল একটু বেশিই বয়:প্রাপ্ত। তাঁর বাবা প্রায়ই তাঁদেরকে একটা কালো লাঠি হাতে তাবড়ে বেড়াত, ছোট্ট কয়েগ সবসময়ই নজর রাখতো আর তাঁর বাবাকে আসতে দেখলেই আওয়াজ দিত। তবু মনে হত তখনি তাঁরা বরং বেশ সুখি ছিল। তাঁর বাবার স্বভাব তেমন খারাপ ছিল না; তাছাড়া তখন তাঁর মাও বেঁচে ছিলেন। সে কতকাল আগের কথা; সে আর তাঁর ভাইবোনেরা ইতিমধ্যেই বড় হয়ে উঠেছিল যখন তাঁদের মা মারা যান। টিজি ডানও মরে গিয়েছিল তখন, আর ওয়াটার পরিবারটা ফিরে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। সবকিছুই বদলে যায়। এখন সেও অন্যদের মত চলে যেতে বসেছে, ছেড়ে যাচ্ছে নিজের ঘর।ঘর! সে রুমটায় ঘুরে ঘুরে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সবগুলো পরিচিত আসবাব আর জিনিসপত্র, যাদেরকে সপ্তাহে অন্তত একবার ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করত সে বছরের পর বছর আর ভাবত কোথা থেকে যে এত ধূলি ময়লা গুলো আসে। হয়তো আর কোনদিনই সে আর এই পরিচিত জিনসপত্র গুলো দেখতে পাবে না। অথচ কখনও সে স্বপ্নেও ভাবেনি তাঁদের সাথে তাঁর বিচ্ছেদের কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর এতগুলো বছরেও সে কোনদিন জানতে পারেনি ভাঙ্গা হারমোনিয়ামের উপরের দিকে দেয়ালটায় ঝুলে থাকা হলদে ছবির ঐ পাদ্রিটার নাম কি। পাদ্রি লোকটা ছিল তাঁর বাবার স্কুল-বন্ধু। যখনি তাঁর বাবা কোন অতিথিকে ছবিটা দেখাতো, তখন ছবিটা তাঁর হাতে দিতে দিতে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলতঃ“সে এখন মেলবোর্ণে আছে।“সে চলে যেতে সম্মত হয়েছে, রাজি হয়েছে ছেড়ে যেতে নিজের ঘর। কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটার দুই দিকটাই সে সমভার করার চেষ্টা করলো। তাঁর এই ঘরে আশ্রয় ছিল, খাদ্য ছিল; ছিল তাঁরা যাদেরকে সে চিনে এসেছে সারাটি জীবন। অবশ্য তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হত, ঘরে আর ব্যাবসা দু’ জায়গাতেই। দোকানের ঐ লোকেরা কি বলবে তাঁকে নিয়ে, যখন জানতে পারবে সে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে? বলবে মেয়েটা আসলে বোকা, হয়তো; তাঁর থাকার জায়গাটা এখন বিজ্ঞাপনে ভরে যাবে। মিস গাবান খুব খুশি হবে। মহিলাটার সবসময়ই একটা ঝাঁঝ ছিল তাঁর উপর, বিশেষ করে যখন লোকজন শুনতে পেত।“মিস হিল, তুমি দেখতে পাচ্ছ না মহিলারা অপেক্ষা করছে?”“একটু প্রাণবন্ত থাকো, মিস হিল, প্লিজ।“দোকান থেকে বিদায় নিতে সে খুব একটা জল ঝরাবে না চোখে।কিন্তু তাঁর অজানা দূরের দেশের বাড়িতে কোন কিছুই তো এমন থাকবে না। তখন সে হবে বিবাহিত, বিবাহিত এভেলিন। মানুষজন তাঁকে সম্মান দেখাবে। তাঁর সাথে এমন কোন আচরণ করা হবে না, যা তাঁর মায়ের সাথে করেছিল মানুষ। এমনকি এখনো, যদিও সে এখন উনিশের উপরে, মাঝে মাঝে তাঁর বাবার হিংস্রতায় নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়। সে জানত তাঁর বাবার এই হিংস্রতাই তাঁর সকল শিহরণের মূল কারণ। যখন তাঁরা বেড়ে উঠছিল তাঁর বাবা কখনই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতো না, সর্বদা হ্যারি আর আরনেষ্টকে মাথায় তুলে রাখতো, কারণ সে ছিল একটা মেয়ে কিন্তু পরবর্তীতে লোকটা তাঁকে হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করল এবং তাঁর মরা মায়ের দোহাই দিয়ে বলতে লাগলো সে তাঁকে কি করত যদি তাঁর মা বেঁচে থাকতো। আর তাঁকে রক্ষা করার মত কেহই ছিল না। আরনেষ্ট ছিল মৃত, আর হ্যারি, যে কিনা গির্জায় সাজগোজের ব্যাবসা করত, সবসময়েই গ্রামের কোন এক কোনায় পড়ে থাকত। তাছাড়া, শনিবারের রাত গুলোতে টাকার জন্যে একগেয়ে তুচ্ছ তুমুল ঝগড়া গুলো তাঁকে অবর্ণনীয় ভাবে ক্লান্ত করে তুলেছিল। সে সর্বদাই তাঁর পারিশ্রমিকের পুরোটা দিয়ে দিত — সাত শিলিং — আর হ্যারি সবসময় যতটুকু পারে পাঠাত কিন্তু সমস্যাটা বাঁধত তাঁর বাবার কাছ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে। তাঁর বাবা বলেছিল সে নাকি সব টাকা উড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে, তাই তাঁর মাথা এতটা খারাপ হয়নি যে তাঁর কষ্টার্জিত টাকা মেয়েকে দিবে রাস্তায় উড়িয়ে নষ্ট করার জন্যে। আরও এমন অনেক কিছু বলত, যেহেতু শনিবারের রাত গুলোতে সে সাধারণত খারাপের চরমে পৌঁছে যেত। সবশেষে সে টাকাটা মেয়ের হাতে দিত আর জিজ্ঞেস করত রবিবারের ডিনার কেনার তাঁর কোন ইচ্ছা আছে কিনা। তারপর এভেলিন যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে যেত কেনাকাটা করতে, শক্ত হাতে কালো চামড়ার পার্সটা নিয়ে ভিড় ঠেলে নিজের রাস্তা বের করে সে এগুতে থাকত এবং সকল শর্ত বিধির চাপের মধ্যেই দেরি করে ফিরে আসতো বাড়িতে। বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে তাঁকে করতে হত কঠোর পরিশ্রম, দেখতে হত তাঁর কাছে থাকা বাচ্চা দুটো ঠিকমত স্কুলে যাচ্ছে কিনা, নিয়মিত চারটে খেতে পাচ্ছে কিনা। এটা ছিল কঠোর পরিশ্রম — একটা কঠিন জীবন — কিন্তু এখন সে ছেড়ে যেতে বসেছে এই সব কিছুই। তাঁর কাছে এই জীবনটা পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হল না।সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। ফ্র্যাঙ্ক ছিল দয়ালু, পুরুষালী আর খোলা মনের মানুষ। সে ফ্র্যাঙ্কের হাত ধরে রাতের নৌকায় চড়ে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে বুয়েনস আইরসে যেখানে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে একটা ঘর, যে ঘরে সে হবে ফ্র্যাঙ্কের বিবাহিতা স্ত্রী। কত পরিষ্কার ভাবে এখনো মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের দিনটার কথা; ফ্র্যাঙ্ক প্রধান সড়কটার পাশে একটা কুঠিতে লজিং থাকত, যেখানে সে মাঝে মাঝে যেত। মনে হচ্ছিল যেন এই তো সপ্তাহ খানেক আগের কথা। ফ্র্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে ছিল প্রবেশদ্বারটায়, তাঁর সুচালো ক্যাপটা ছিল মাথার পেছন দিকটায় ঠেলে দেয়া, চুলগুলো তাঁর তামাটে চেহারাটার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তারপর চেনা জানা হল একে অপরের সাথে। ফ্র্যাঙ্ক প্রতি সন্ধ্যায় দোকানের বাইরে তাঁর সাথে দেখা করত এবং তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিত। সে তাঁকে দ্যা বোহেমিয়ান গার্ল দেখতে নিয়ে যেত আর এভেলিন উল্লসিত বোধ করত যেহেতু সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে থিয়েটারের অস্বাভাবিক অংশটায় বসত। ফ্র্যাঙ্ক ছিল ভয়ঙ্কর গান পাগলা এবং সে একটু আধটু গাইতও। মানুষ জানত যে তাঁরা একে অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং, যখন ফ্র্যাঙ্ক বালিকা মেয়ের গানটা গাইত যাকে নাবিক ভালোবাসে, সে একটা সুখময় দ্বিধান্বিত অনুভবে ডুবে যেত। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে মজা করে পপেন্স নামে ডাকতো। প্রথমত একজন সঙ্গী পাওয়াটা তাঁর কাছে একটা উত্তেজনার বিষয় ছিল এবং তারপর তাঁকে তাঁর ভালো লাগতে শুরু করল। ফ্র্যাঙ্কের জীবনে দূর দেশের অনেক গল্প ছিল। এলান লাইনের কানাডাগামী জাহাজে সে প্রথম মাসিক এক পাউন্ড বেতনে ডেক বয় হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। সে কত জাহাজে কত রকমের কাজ করেছে এই সব কিছু নিয়ে এভেলিনের সাথে গল্প করত। সে মাগেলান সাগরে পাড়ি জমিয়েছে এবং সে পেটাগনিয়ানদের ভয়ঙ্কর সব গল্প শোনাত তাঁকে। বুয়েনস আইরসে এসে সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল, বলল সে, এবং সে তাঁর পুরনো দেশে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র ছুটি কাটানোর জন্যে। অবশ্য, এভেলিনের বাবা তাঁদের সম্পর্কের কথাটা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিল এবং ফ্র্যাঙ্কের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে দিয়েছিল।“এই ধরনের নাবিক ছেলেদের আমার চেনা আছে।“ সে বলল।একদিন সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিল এবং তারপর থেকে এভেলিনকে লুকিয়ে দেখা করতে হত ফ্র্যাঙ্কের সাথে।এভিনিওতে সন্ধ্যাটা গাঢ় হয়ে আসছিল। তাঁর কোলের উপর রাখা দুটি চিঠির শুভ্রতাও ধীরে অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। একটা চিঠি হ্যারিকে লেখা; আরেকটা তাঁর বাবাকে। আরনেষ্টই তাঁর প্রিয় ছিল কিন্তু হ্যারিকেও সে পছন্দ করত। সে খেয়াল করল, সম্প্রতি তাঁর বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছে; লোকটা তাঁকে মিস করবে। মাঝে মাঝে তাঁর বাবা খুব সুন্দর ব্যবহার করত। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন সে দিনের বেলায় ঘুমুতে গিয়েছিল, তখন তাঁর বাবা পাশে বসে ভূতের গল্প পড়ে শুনিয়েছিল, আর আগুনের পাশে বসে তাঁর জন্যে টোস্ট বানিয়েছিল। অন্য একদিন, যখন তাঁদের মা বেঁচে ছিলেন, সবাই মিলে তাঁরা পিকনিকে গিয়েছিল হাউথের পাহাড়ে। এখনো মনে পড়ে, তাঁর বাবা বাচ্চাদের হাসানোর জন্যে মায়ের মস্তকাবরণটা পড়িয়ে দিচ্ছিল।তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছিল কিন্তু সে জানালার পাশে বসেই রইল, জানালার পর্দা গুলোয় মাথাটা ঠেকিয়ে, তাঁর নিঃশ্বাসে মিশে ছিল ধূলিমলিন কাপড়ের গন্ধটা। এভিনিওর নিচে দূরে কোথাও থেকে তাঁর কানে ভেসে আসছিল স্ট্রিট অর্গানের সুর। সে অদ্ভুত বাতাসটাকে চিনত যেটা প্রতি রাতে এসে তাঁকে মনে করিয়ে দেয় মাকে দেয়া তাঁর প্রতিজ্ঞা গুলোর কথা, যেখানে সে মাকে বলেছিল ঘরটাকে সে আগলে রাখবে যতদিন সম্ভব। তাঁর মনে পড়ল মায়ের অসুস্থতার শেষ দিনটার কথা; সে আবারো হলের অপর পাশের সেই অন্ধকার বদ্ধ ঘরটায় ছিল এবং শুনতে পাচ্ছিল ইতালির বাতাসে একটা বিষণ্ণ সুর। অরগান-প্লেয়ারটাকে ছ-পেনির পয়সা ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল। তাঁর মনে পড়ল, তাঁর বাবা সদর্পে সিক-রুমে ঢুকে বলছিলঃ“হারামজাদা ইতালিয়ান! আসছে এখানে!”যেহেতু সে ডুবে গিয়েছিল ধ্যানে, তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের করুন জীবন চিত্রটা, যার আবেশ খুব দ্রুত তাঁর পুরো সত্ত্বাটাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল — গতানুগতিক সাধারণ জীবন তাঁর সবকিছুই ত্যাগ করে দেয় শেষ পাগলামিতে। সে কেঁপে উঠলো আবারো তাঁর মায়ের গলার আওয়াজ শুনে, তাঁর আবিরাম একগুঁয়ে অর্থহীন আওড়ানো বুলি শুনেঃ“দেরেভুয়ান সেরাউন! দেরেভুয়ান সেরাউন!”সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল একটা আতঙ্কের তাড়নায়। পালাও! তাঁকে যে পালাতে হবে! ফ্র্যাঙ্ক থাকলে এখন তাঁকে রক্ষা করত। ফ্র্যাঙ্ক তাঁর জীবনটা ফিরিয়ে দিত, হয়তো একটু ভালবাসাও দিত। কিন্তু সে তো বাঁচতে চেয়েছে। তাঁকে কেন অসুখি হতে হবে? তাঁরও তো সুখে একটু অধিকার রয়েছে। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে এখন বুকে টেনে নিত, আগলে রাখতো তাঁর দু’ বাহুতে। সে তাঁকে বাঁচাত।নর্থ ওয়ালের স্টেশনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক তাঁর হাতটা ধরেছিল এবং সে জানত ফ্র্যাঙ্ক তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলছে, প্যাসেজ সম্পর্কে কিছু একটা বার বার বলেই যাচ্ছে। বাদামী ব্যাগেজ ওয়ালা সৈনিকে ভরে গিয়েছিল পুরো স্টেশনটা। ইঞ্জিনশালার প্রশস্ত দরজা গুলো দিয়ে সে কালো নৌকাটা এক পলক দেখল, নৌকাটা শুয়ে আছে ঘাটের দেয়ালটার পাশে তাঁর আলোক উজ্জ্বল জানালা গুলো নিয়ে। সে কোন উত্তর দিল না। সে অনুভব করল তাঁর গালটা বিবর্ণ শীতল হয়ে উঠছিল, এবং প্রবল মানসিক চাপে সে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করল তাঁকে পথ দেখাতে, সে চাইল ঈশ্বর যেন বলে দেয় তাঁর কি করা উচিত। নৌকাটা একটা দীর্ঘ শোকাবহ হুইশেলের আওয়াজ ছুড়ে দিল কুয়াশায়। যদি সে যেতো, তাহলে আগামীকাল সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সাগরে ভেসে ভুয়েনস আইরসের দিকে এগুত। তাঁদের প্যাসেজ ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। এত কিছুর পরেও কি সে এখন ফিরে যেতে পারবে? তাঁর এই প্রবল সঙ্কট পুরো শরীরে একটা ঘৃণার জাগরণ সৃষ্টি করল এবং তাঁর ঠোঁট গুলো কাঁপতে লাগলো নীরব আকুল প্রার্থনায়।তাঁর হৃদপিণ্ডে একটা বেল ঝনঝন করে উঠলো। সে টের পেল ফ্র্যাঙ্ক তাঁর হাতটা চেপে ধরেছেঃ“আসো!”পৃথিবীর সবকটি সাগর যেন গড়াগড়ি খেল তাঁর হৃদপিণ্ডের আশে পাশে। ফ্র্যাঙ্ক তাঁকে সেই সাগর গুলোয় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলঃ সে তাঁকে ডুবিয়ে মারবে। সে দু’ হাতে শক্ত করে চেপে ধরল লোহার রেলিঙটা। “আসো!”না! না! না! এটা ছিল অসম্ভব। তাঁর হাত দুটো উম্মত্ত থাবায় আঁকড়ে ধরল লোহাটাকে। সমুদ্র গুলোর বুকে সে একটা চিৎকারের আওয়াজ ছুড়ে দিল যন্ত্রণায় আর ক্ষোভে।“এভেলিন! এভি!”ফ্র্যাঙ্ক দৌড়ে ব্যারিয়ার পাড় হয়ে গেল এবং তাঁকে ডেকে বলল অনুসরণ করতে। সে চিৎকার করছিল নৌকা না থামাতে কিন্তু তবুও সে এভেলিনকে ডাকছিল। এভেলিন তাঁর শুভ্র মুখটাকে তাঁর দিকে তাক করে রাখল, অসাড়, একটা অসহায় প্রাণীর মত। তাঁর চোখে ফ্র্যাঙ্কের জন্যে কোন ভালোবাসা ছিল না, ছিল না কোন বিদায়ের অথবা পরিচয়ের চিহ্ন।.
২৯।অনুগল্পঃ হঠাৎ দুর্ঘটনা
মীম যে আমার বন্ধু ছিল এটা আমি কোন দিন বলবো না । আমরা একই ক্লাসে পড়তাম । একই সাথে ক্লাস করতাম তবুও আমাদের মাঝে সব মিলিয়ে কতবার কথা হয়েছে সেটা সম্ভবত একটু হিসাব করলেই বলে দেওয়া যাবে । চার বছর এক সাথে অনার্স করার পর মীম এমবিএ করতে অন্য ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল । আমি মাস্টার্স শেষ করে বের বের হয়ে এই কোম্পানীতে ঢুকলাম । তখনই আমার মীমের সাথে আবারও দেখা হল । দুজন আমরা একই সাথে ট্রেইনি হিসাবে যোগদান করেছি । তারপর থেকেই মীমের সাথে আমার কথা বার্তা শুরু । অফিস এবং অফিসের বাইরে । পুরো অফিস ভর্তি নতুন মানুষ । কাউকে চিনি না । পরিচিত বলতে কেবল মীম । মীমের বেলাতেও কথাটা সত্য ছিল । তাই আস্তে আস্তে মীমের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো । ওর সাথে আমার অনেক কথা হত । সময় গুলো ভালই কাটতো । মীম ঢাকাতে একাই থাকতো । চাকরীর কয়েকদিন পরেই ও নতুন বাসা নিলো অফিসের কাছেই । আগে হোস্টেলে থাকতো চাকরির পর নিজের বাসা । সারা দিন দৌড়াদৌড়ি করে বাসা ঠিক-ঠাক করে দিলাম । চেনার পরিচয় বলতে এখন আমিই আছি । ওর বাবা মা মাগুরা থাকতো । আমারও সাহায্য করতে খারাপ লাগতো না । আসলে আমার নিজেরও খুব একটা চেনা পরিচয় কেউ নেই আরও ভাল করে বলতে গেলে আমি ইচ্ছে করেই চেনা পরিচিত মানুষ গুলো থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম । ইভার বিয়ের হয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার বাসায় আর কোন দিন যাই নি । বাবাকে হাজার বার বলার পরও যখন বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ইভাদের বাসায় গেল না, তখন বাসার প্রতি একটা অন্য রকম অভিমান জমলো । ওর বিয়ের পর আর বাসাতে যাই ই নি কোন দিন । পড়া লেখা করা অবস্থাতেই নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলাম । তারপর কারো সাথেই ঠিক ঠাক মত পরিচয় নেই । বাকী জীবন একা একা থাকা অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলেছি এবং নিজের সাথে বোঝা পোড়াটা সেরে নিয়েছিলাম অনেক আগেই ।কিন্তু মাঝে মাঝে মন যে কারো সঙ্গ চাইতো না সেটা আমি বলবো না । অবশ্য সেই মনকে গলা টিপে ধরতে আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি । তবুও মানব মন বলে কথা । মাঝে মাঝে খুব বেশি হাপিয়ে উঠতাম । তাই আমার জীবনে মীমের আগমন ।মীমের সাথে মেশার আরেকটা কারন ছিল যে মীমের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিল । আমার আসলে এই দিকে যাওয়ার আর ইচ্ছে ছিল না । মীমের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক থাকায় মীম নিজেও আমার দিকে ঝুকে পড়বে না এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম । তাই ভাবলাম খানিক টা সময় যদি ওর সাথে কাটে কাটুক । সব কিছু ভালই চলছিলো । মাঝে মাঝে দুপুর বেলা মীমের বাসায় গিয়ে হাজির হতাম । কোন কোন দিন ওর মায়ের সাথে দেখা হয়ে যেত । মাঝে মাঝে ও মা কিংবা বাবা এখানে এসে থাকতো ওর সাথে । আন্টিও আমাকে ভালই জানতেন । তবে বেশির ভাগ সময় ও ফ্ল্যাটে একাই থাকতো । আমরা দুপুরের খাবারটা ওর ওখানে খেয়ে কিছু সময় গল্প করে আবারও অফিসের দিকে রওনা দিতাম । আমার আসলে কোন কিছু মনে হত না । অনেকেরই এরকম টা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এরকম একা একটা মেয়ের বাসায় যাওয়া কি ঠিক ! কিন্তু আমার কথা হল আমি যদি ঠিক থাকি তাহলে কে কি বলল তাতে কি যায় আসে । আর এই ব্যস্ত শহরে কে কার দিকে এতো খেয়াল দিয়ে বসে আছে । কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো একদিন । ফেসবুকের ফিল্টার্ড মেসেজ চেক করতে গিয়ে দেখলাম এক লোক আমাকে সেই ভাষা গালাগালাজ করেছে । তার ভেতরে একটা লাইন এমন আছে যে আমি নাকি অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিই । আমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না । ফেসবুকে কিছু ছবি আপলোড দেওয়া আর মাঝে মাঝে কিছু দুয়েক লাইনের স্টাটাস ছাড়া আমি তেমন কিছুই কোন দিন করি নি । বাস্তবে জীবনে আরও না । তাহলে আমাকে এই কথা বলার মানে কি ! একবার মনে হল ইভার স্বামী হবে হয় তো । কিন্তু এই লোক আমাকে কিভাবে চিনবে আর ইভার বিয়ের পর থেকে তো আমি ওর সাথে তো আর কোন কোন প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টাও করি নি । তাহলে ?আমি কি রিপ্লাই দেব সেটা চিন্তা করতে লাগলাম । নাকি ব্লক করে দেব ?কিন্তু কৌতুহল হল । একটা মানুষ, যাকে আমি চিনি না জানি না আমাকে কেন খামোখা গাল গালাজ করবে ?প্রোফাইলে গেলাম লোকটার । একজন মিউচুয়্যাল ফ্রেন্ড । অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই মিউচু্য়্যাল ফ্রেন্ডটা আর কেউ না, মীম । এবাউট ইনফোতে দেখলাম লোকটা থাকে আমেরিকাতে । আমার মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না যে এই লোকটা কে । যদিও মীম কেবল আমাকে বলেছিলো একটা ছেলের সাথে তার পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তবে কোন দিন লোকটার ব্যাপারে আর কিছু বলে নি । এমন কি লোকটার নামও আমাকে বলে নি । আমিও এই বিষয়ে জানতে চাই নি । আমি লোকটার মেসেজের উত্তর দেওয়ার আগে মীমকে ফোন দিলাম । ও সব শুনে কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল-তুমি কি এখন আমার বাসায় আসতে পারবে ?ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৯টার মত বাজে । আগামীকাল ছুটির দিন । তাই খুব একটা সমস্যার হওয়ার কথা না । আমি আর কোন কিছু না ভেবে মীমের বাসার দিকে রওনা দিলাম । যখন পৌছালাম তখন প্রায় ১০ টা বেজে গেছে । আমার মাথাতে কিছু ঢুকছে না তবে মীমকে কেমন যেন শান্ত মনে হল । টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া ছিল । মীম বলল খেতে খেতে কথা বলি ! আমি খাওয়া শুরু করলাম । খাবারের মাঝে এক সময়ে মীম বলল-আসলে শামীমকে আমি এমন কিছু বলেছি যে ও তোমাকে দোষী মনে করছে !শামীম হচ্ছে সেই লোকটার নাম যে আমাকে ফেসবুকে গালী দিয়েছে । আমি খাবার মুখে নিতে নিতে বললাম -কি এমন বলেছো ?-আসলে আমি ওকে কোন দিন বিয়ে করতে চাই নি । অনেকটা বাবা জোর করেই শামীমের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো অনেক আগে থেকে । আমি কোন দিন আমেরিকা যেতে চাই না । আমি এখানে থেকে নিজে কিছু করতে চাই ।-তা তো বুঝলাম কিন্তু এর ভেতরে আমি এলাম কোথা থেকে ?-আসলে .....।মীম পাতের ভাত নিয়ে কিছু সময় নাড়াচাড়া করছিলো । ও যে কাজটা করেছে সেটা বলতে দ্বিধা বোধ করছে । আমি বললাম-বল -আমি বলেছি যে তোমার সাথে আমার কিছু চলছে !-মানে ? কি চলছে ?-মানে ......এই কথাটা বলে মীম আমার দিকে তাকালো । তারপর মাথা নিচু করে বলল-মানে তোমার সাথে প্রেম চলছে । তুমি আমাকে প্রোপোজ করেছো আর আমি মানাও করতে পারি নি । আর সেই সাথে আমার বাসায় তুমি নিয়মিত আসো ! শেষ কথাটা শুনে আমার গলায় ভাত আটকে গেল । সামনের গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কোন মতে ভাতটা বুক দিয়ে নিচে নামালাম । শেষ লাইন টা দিয়ে মীম আসলে কি বুঝিয়েছে আমার সেটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না, অন্য কারো বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না । মীম নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক ভাবে । মীম কিছু সময় পরে আবার বলল-তোমার সাথে আমার অনেক ছবি তোলা আছে । সেগুলো কিছু পাঠিয়েছি ।আমি কি বলবো ঠিক বুঝলাম না । মীম মাথা নিচু করেই রইলো । আমি আবারও খাওয়াই মন দিলাম । খেতে খেতেই মনে হল মীম নিজের একটা ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য আমার নাম ব্যবহার করেছে । আমার অবশ্য কি বা যায় আসে । সব কিছু পরিস্কার হল । শামীম সাহেব কেন আমাকে গালী দিয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম । আমি বললাম -তো এখন কি অবস্থা ? শামীম সাহেব কি বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে ?মীম আমার দিকে তাকিয়ে বলল-তুমি রাগ কর নি ?-নাহ ! একটু কনফিউজ ছিলাম । এখন ওকে । সমস্যা নেই । বিয়ে কি ভেঙ্গে গেছে ?-হুম ! -খুশি তুমি ?-খুব ! মীম হেসে উঠলো । আমিও হাসলাম । ঐদিন মীমের বাসা থেকে বের হতে হতে ১২টার মত বেজে গেল । আমি ভেবেছিলাম ঝামেলা মনে হয় এখানেই শেষ । কিন্তু আমি কি ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি সেটা আমি নিজেও জানতাম না তখনও । শুক্রবারে আর মীমের সাথে আমার দেখা হল না । কোন কথাও হল না। শনিবার সকালে মীমের ফোনেই আবার ঘুম ভাঙ্গলো । সকাল বললে ভুল হবে । দুপুরের দিকে । আমি ছুটির দিনে লম্বা ঘুম দেই । মীম বলল ওর বাসায় যেন এখনই আসি । আমার মনে হল দুপুরেরও মনে হয় ওর বাসায় দাওয়াত দিতেই ও ফোন দিয়েছে । ফ্রেশ হয়ে রওনা দিলাম । যখন মীমের বাসায় এসে হাজির হলাম তখন একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম । মীমের বসার ঘরে মীমের বাবা বসে আছে । এবং সেই সাথে আমার বাবা বসে আছে । আমার বাবা এখানে কেন ?আমার মাথার ভেতরে কিছু ঢুকছে না । আমার বাবার তো এখানে আসার কথা না কোন ভাবেই । তাহলে এখানে কেন ?আমাকে দেখে বাবা এগিয়ে এল । আমাকে খানিকটা জড়িয়ে ধরে বলল-তুমি যে নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো এটাতেই আমি খুশি । মীমকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে । -মানে ?আমি কোন উত্তর না পেয়ে কেবল বোকার মত তাকিয়ে রইলাম মীমের বাবা আর আমার বাবার দিকে । আমি কোন কথা না বলে বাড়ির ভেতরের দিকে হাটা দিলাম । ভেতরের ঘরে মীমের মা সাথে আমার নিজের মাও ছিল । মা আমাকে ধরে কত রকম কথা বলতে লাগলাম তবে আমার কানে কিছু ঢুকছে না । আমার চোখ খুজছে মীম কে । একটু পরেই আমি মীমকে দেখলাম ঘরে ঢুকতে । ওকে দেখতে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না । আমি সবাই কে ছাড়িয়ে মীমকে নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম । বললাম-কি হচ্ছে এসব ?-আসলে আমি ভাবি নি এটা এমন দিকে যাবে ।-কেমন দিকে ?-শামীম আর ওর পরিবার নিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার সময় বাবাকে তোমার কথা বলেছে । আরও অনেক কথা ! আমি মীমের দিকে তাকিয়ে আছি । অনেক কথা বলেছে বলতে মীম কি বোঝাতে চেয়েছে বুঝতে পারলাম । মীম বলল-আসলে কোন মেয়ের বাবাই এসব সহ্য করবে না । -তারপর ?-বাবা এসে তোমার কথা জানতে চাইলো । তারপর ..........তারপর কি হল আমি বুঝতে পারলাম । আর সেই সাথে মীম যে কোন কথা বলে নি সেটাও বুঝতে পারচি । ওর অবশ্য আমার ব্যাপারে সত্য কথা বলার কোন উপায় ছিল না । বললে হয়তো ওর বাবা বিশ্বাস করতো না । আর বিশ্বাস করলে তো আবার নতুন ঝামেলা শুরু হয়ে যেত । কিন্তু আমার বাবা মা এখানে কিভাবে এল ! আমি বললাম -কিন্তু আমার বাবা মা এখানে কেন ?মীম বলল-আসলে একদিন তোমার মোবাইল থেকে আমি কয়েকদিন আগে তোমার মায়ের নাম্বার টা নিয়ে ছিলাম । মনে আছে ?-আছে !মীম আমার ফ্যামিলির সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানতো । ওর ইচ্ছে ছিল যেন আমার সাথে আমার ফ্যামিলির সম্পর্কটা আবার ঠিক হোক । তাই নাম্বার টা নিয়েছিল আমার মায়ের সাথে কথা বলার জন্য । -বাবা তোমার সাথে যোগাযোগ করার আগে তোমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন । তারপর আজকে সকালে তোমার বাবা এখানে হাজির । দুজন মিলে কি কথা বলেছে আমি জানি না । তবে দুজনেই এই সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন যে আমাদের বিয়ে হওয়া উচিৎ ! আমি কি বলবো আসলেই খুজে পেলাম না । মীমের দিকে তাকিয়ে মনে হল ও এই বিয়ে নিয়ে খুব খুশি ! আমি বললাম-তুমি কিছু বললে না ? বললেন না সত্য টা ?-মাথা খারাপ ? তাহলে বাবা আমাকে আবারও ঐ শামীমের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে !-তাই বলে তুমি আমাকে ডুবাবে ?মীম মুচকি হেসে বলল-ঐ আমেরিকার থেকে তুমি অনেক ভাল । বড় কথা তোমার সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং টা অনেক ভাল । তোমার সাথে বিয়ে হলে আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে না । আমরা একই সাথে জব করতে পারবো । আর তুমি বল আমার সাথে তোমার সময় ভাল যায় না ?-যায় কিন্তু তার মানে ......-আগে যেমন গিয়েছে সামনেও যাবে । বুঝছো ? এখন যা হচ্ছে হতে দাও তো মীম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই মীমের মা এসে বলল কাজী নাকি চলে এসেছে । এখনই ওকে তৈরি হতে হবে । আমি আমার মাকে হাসি মুখে এগিয়ে আসতে দেখলাম । মায়ের হাসি মুখ অনেক দিন পরে আবার দেখতে পেলাম । মা তো ধরেই নিয়েছিলো আমি হয়তো আর কোন দিন বিয়েই করবো না কিন্তু এই হঠাৎ করেই এভাবে আমার সাথে মীমের এরকম সম্পর্কের কথা শুনে ওনারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছে নিঃসন্দেহে । একবার মনে হল সবার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেই । মীমের সাথে আমার কি হয়েছে কিংবা ওর সাথে আমার কেমন রিলেশন এটা সবাইকে জানিয়ে দেই কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, থাকুক । কি দরকার ! যা হচ্ছে খারাপ তো না ! জীবনে কত দুর্ঘটনাই তো ঘটে !৩০।ছোটগল্পঃ শারদাংবেল✍ শারদাংবেলশারদাংবেল এমন একটি একটি গ্রামদেশ যেখানে অধিকাংশ মানুষের বয়স বিশের কম আর শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ম্যানগ্রোভ বনের ধারে এই গ্রামের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো ৪০ বছর ধরে এখানে সুর্য ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আধফালি চাঁদকে আলোর জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছে।যেহেতু চাঁদ গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থান নিয়ে থাকে তাই চাঁদের আলোর সুষমভাবে জোছনা দিতে পারে না। পুর্বদিকটা বেশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলোর জন্য কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালায়।শারদাংবেলে এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয় যারা আজ পর্যন্ত ঝকঝকে সূর্যের আলো দেখতে পেরেছে। তাঁরা শুনেছে কেবল চাঁদের ওপরও নাকি আরো আরো অনেক কিছু আছে।এ গ্রামদেশের প্রধান ফটকে দুটি বৃহৎ সংবিধান লেখা আছে। সব নাগরিককে এটা পড়তে দেয়া হয়। একটি সংবিধানে বলা হয়েছে কি কি করা যাবে। আরেকটি সংবিধানে লেখা আছে কি কি করা যাবে না।একটি নিয়ম খুব কড়াভাবে মানা হয়, সেটি হলো- এই দেশে যে কেউ আসতে পারবে। কিন্তু যেতে হলে দেশরাজের অনুমতি নিতেই হবে। তা নাহলে আজীবন কারারুদ্ধ।✍ হানাবিঃএই দেশে বালকের সংখ্যা অর্ধশতাংশেরও বেশি। এরা নীলদিঘী'র পাড়ে হানাবি ফুটায় যাতে অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখা যায়। কিছু কিছু হানাবি আছে যেগুলো দীর্ঘসময় ধরে আকাশে থাকে। দেশের অনেকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদের ওপরের অস্তিত্ব জানার চেষ্টা করে।এখানে হানাবি ফুটানো নিয়ে বিস্তারিত বলা নেই। তবে হানাবি ফুটানোর অধিকার যে কারোর আছে এমনটি বলা আছে। আশংকার কথা হলো কয়েকটি বালক হানাবি ফুটাতে গিয়ে মরে গেছে।✍ দেশরাজদেশের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। শংকিত হয়ে পায়চারি করছেন দেশরাজ। তাঁর কপালে স্বল্পকালীন ভাজ পড়ে গেছে। সভাসদরা এটা পড়তে পারছেন। কারা যেন আতশবাজ বালকদের ঝোঁপ থেকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করছে।অনেক সভাসদ বলাবলি করছেন- দেশরাজ ছাড়া এ সংকটের সমাধান সহজ নয়। উনার হাতেই দেশের আয় উন্নতি নির্ভরশীল। উনিই পারেন জাতিকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে। বালকদের হত্যা ঠেকাতে দেশরাজ অতূলনীয়। দেশত্রাতা'র ভুমিকার চেয়ে দেশরাজের ভূমিকাই এখানে কার্যকর।কেউ কেউ ফিসফিস করছেন, দেশরাজের কপালের ভাঁজ ইচ্ছাকৃত।✍ নীলদিঘীঃপূর্বদিকের আঁধারাচ্ছন্ন নীলদিধী'র পাড়ে বসে দশ বারোজন বালক হানাবি খেলছে। কাউকে কাউকে হানাবি খেলতে সাহায্য করছে গ্রামের মানুষ। তাঁরা দু-একজনকে সাধ্যানুযায়ী টাকা দিচ্ছে। কাউকে কাউকে আপাদমস্তক সাদা পোশাকে ঢাকা কোনও মেয়ে এসে সাহায্য করছে, কাউকে পুরো কালো নেকাবওয়ালা নারী এসে সাহায্য করছে। দিঘী'র জল তাদের আতশবাজি'র খেলায় বর্ণিল হয়ে গেছে।কিন্তু একটি বালককে কেউ-ই সাহায্য করছে না। সে সতর্ক হয়ে চোখ বড় বড় করে চারদিক দেখছে আর ভয় পাচ্ছে। ঝোঁপের আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে অনেক খেলোয়াড়কে লাশ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।✍ ভয় পাওয়া বালকঃবালকটি দিঘী থেকে ঘরে ঘরে বলতে লাগল, আপনাদের পাঠানো ছেলেদের হত্যা করা হচ্ছে। আপনারা এদের খেলা থেকে বিরত করুন। অন্ধকার, কৃত্রিম অন্ধকারে ভরে দেওয়া হয়েছে আমাদের শারদাংবেল। আপনারা উপরের কালো পর্দা সরান। দয়া করুন। আমার কথা শুনুন।বালকটির কাজে ৯৯ ভাগ মানুষই এটাকে এড়িয়ে গেল/বিরোধিতা করল। অপারগ হয়ে সে চিৎকার করে বললো- উপরে আলো আছে, আপনারা যবনিকা সরান। আপনারা চেষ্টা করলেই হবে।✍ রাষ্ট্রদ্রোহীতাঃভয় পাওয়া বালকটির অপপ্রচারণার খবর দেশত্রাতা'র কানে গেল। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু বালকটি যেতে রাজি হয় নি। এর একটু পরে দেশরাজও ঐ বালকটিকে ডেকে পাঠালেন রাজফটকে। কিন্তু দেশরাজের নির্দেশও সে অমান্য করলো। সে যায়নি।সভাসদরা শোরগোল শুরু করে দিলেন। এটা মস্ত বড় বেয়াদবী। রাষ্ট্রদোহীতা। এটা চরম অপরাধ!!✍ আলোক-স্নানঃশারদাংবেলবাসী বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেল আজকের আকাশে। এক মুহুর্তের জন্য তাঁদের দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় আলো এসেছিল। প্রকট আলো। সবাই নিজেদের নতুনভাবে আবিস্কার করেছিল। এক মুহুর্তের জন্য জাতি'র প্রতিটি সদস্য আলোর অবগাহনে নিজেদের স্নান করেছিল। আলোকীয় স্নানে কেউ কেউ নিজেদের পবিত্র করতে পেরেছে।✍ পরিবর্তনঃভয় পাওয়া বালকের লাশ অশুভ গাছের নীচে পাওয়া গেছে। আলোকমালা আনতে ছেলেটি আকাশে উঠে পর্দা ফাক করে দিয়েছিল। এই অপরাধে তাকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন দেশরাজ। কিন্তু দেশরাজ বালকটিকে হত্যা করার পরপরই দেশত্রাতা নিজ হাতে রাজ'কে খুন করলেন। আর যবনিকাপাতও রোধ করতে সক্ষম হলেন।চিহ্ণিত আতশবাজরা চলে গেলেও অন্য আতশবাজ বালকদের এখন আরো আরো হত্যা করা হচ্ছে। এখন ঝোঁপ থেকে নয়, একেবারে সামনে এসে।লাল লাল রক্তে রক্তে ভরে গিয়েছে শারদাংবেল। কয়েকদিনে জনগণের বেশিরভাগই অভ্যস্ত হয়ে গেলেও কেউ কেউ চোখ খুললে কিংবা বাতাসের নিঃশ্বাসে কেবলি রক্তের হিমোগ্লোবিনের গন্ধ পান। তাজা তাজা হিমোগ্লোবিনের গন্ধ।
0 comments :
Post a Comment