Some Important Website

বাংলা প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট সমুহ

Tuesday, August 23, 2016

৩১।গল্প-অনেক সুন্দর মন মাতানো গল্প।(১১ থেকে ২০)

১১।গল্পঃ মেয়েটি কিংবা তার ভেতরের কেউ ....

চেয়ারে বসে ঘুমানোর অভ্যাস খুব একটা নেই তবুও চোখটা লেগে এসেছিল ক্লান্তিতে । হাসপাতালের কিছু সময় আগেও যেখানে হাসপাতালের কোলাহল ছিল এখন সেই কোলাহলটা শোনা যাচ্ছে না । আমার মত কয়েকজন অপেক্ষা করছে । তাদের কাছের কেউ মানুষ নিশ্চয়ই ভর্তি আছে । কেউ কেউ চেয়ারে বসেই নাক ডাকা শুরু করে দিয়েছে । আমি কিছু সময় মোবাইলে ব্রাউজিং করছিলাম । তারপর বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দিলাম । একটু ঘুমানো দরকার । কালকে আবার অফিসে যেতে হবে । 
চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম তখনই নার্সের ডাক শুনলাম ! 
-মিস্টার অপু হাসান !আমি চোখ মেলে তাকালাম । -জি ! -আপনার রোগী চোখ মেলেছে । আপনাকে দেখতে চাইছে । একটু স্বস্তি পেলাম । আইরিনের চোখ তাহলে খুলেছে । আমি বললাম আমি আসবো ?-হ্যা ! আমার পেছন পেছন আসুন ! 
এই বলে নার্স আর দেরি করলো না । পেছন ঘুরে হাটতে শুরু করে দিল । আমিও নার্সের পেছন পেছন হাটতে লাগলাম । কেবিনের ঢুকতেই আইরিনের দিকে চোখ পড়লো । ডাক্তার আছেন একজন । রিপোর্ট বোর্ডে কি যেন লিখছি । মাঝে মাঝে কিছু জানতে চাইছে আইরিনের কাছে । আমি ভেতরে ঢুকেও কোন কথা বললাম না । কেবল আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।এই কয়েক ঘন্টার ভেতরের মেয়েটার চেহারার অবস্থা কেমন হয়ে গেছে । এতো শক্ত একটা মেয়ে এতো জলদি ভেঙ্গে যাবে ভাবতে পারি নি । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো আইরিন বেশ কিছুটা সময় । ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল-আপনি এখন চলে যেতে পারেন । আপনার পেসেন্ট এখন আউট অব ডেনজার । তবে আমরা একটু অবজারভেশনে রাখবো একদিন । বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন উনি আমাদের । 
আসলেই আইরিন আমাদের একটু ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো । এভাবে কেউ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে আমরা ভাবতেই পারি নি । অন্তত আমাদের অফিসের কেউ তো ভাবতেই পারি নি । আমি এখন এই খাটে আধ শোয়া আইরিন আর আমাদের অফিসের ফরমাল পোষাকে আইরিনকে মিলানোর চেষ্টা করলাম । কিন্তু কেন জানি কিছুতেই মেলাতে পারলাম না । মেয়েটার ভেতরে এই কয়েক ঘন্টার ভেতরেই কেমন একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি । 
অফিসে যেখানে মেয়েটার সবার উপর কর্তৃত্ব ফলায় আর এখানে চেহারায় কেমন একটা অসহায়ের ভাব রয়েছে । ডাক্তার ওকে রেখে চলে গেল । নার্সও দেখলাম কিছু সময় পরে চলে গেল । আমি দাড়িয়ে রইলাম । আইরিন তখনও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । কিছু যেন বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না ।আমি বললাম-এখন কেমন লাগছে ?-ভাল । -আপনার কিছু লাগবে ?আইরিন মাথা নাড়লো । একটু যেন লজ্জা পাচ্ছে আমার সাথে কথা বলতে । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । দাড়িয়ে থাকবো নাকি চলে যাবো । অফিসে হলে এতো সময়ে আইরিন ঠিক ঠিক আমাকে একটা ঝাড়িয়ে দিয়ে বলত কি ব্যাপার দাড়িয়ে আছেন কেন ? যান নিজের ডেস্কে গিয়ে কাজ করুন । এই কাজটা আজকের ভেতরে শেষ করা চাই । 
কিন্তু এখানে আইরিন তেমন কিছুই বলবে না আমি জানি । আমার দিকে তাকিয়ে বলল-আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন । এতো সময় অপেক্ষা করেছেন এই জন্য অনেক ধন্যবাদ । 
আমার কাছে মনে কথাটা মোটেই আইরিনের মনের কথা না । যদিও আইরিন মুখে বলল যে আমি চলে যেতে পারি কিন্তু আমার কেন জানি মনে আইরিন চাচ্ছে আমি এখানে থাকি । অবশ্য মানুষের যখন শরীর খারাপ হয় তখন মানুষ কারো সঙ্গ কামনা করে বিশেষ করে কেউ তার দেখা শোনা করুক এটা চায় । যত শক্ত আর কঠিন মানুষই হোক না কেন সবার চাওয়াই এরকম হয়ে থাকে । আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম-চা খাবেন ?-চা !!-হুম । আমি খাবো ভাবছি এক কাপ । আর আজকে না হয় থাকিই এখানে । সমস্যা নেই । বসকে অসুস্থ রেখে বাসায় গেলে বস ঝাড়ি মারতে পারে । 
আমার কথা শুনে আইরিন হেসে ফেলল । তারপর বলল-থ্যাঙ্কিউ ।-কেন ?-এই যে আমার জন্য কষ্ট করছেন । আমি জানি অফিসে আমার খুব একটা পছন্দ করে না কেউ । আমি বললাম-ঠিক অপছন্দ না। ভয় পায় আপনাকে । আপনি যে টাইট দিয়ে রাখেন সবাইকে ! 
এই লাইনটা আমি অন্য সময় বলতে পারতাম কি না কে জানে তবে দেখলাম আইরিন আবারও হেসে উঠলো । আমি চা নিয়ে ফিরে এলাম । দুজন মিলে চা খেতে খেতে কথা বলতে লাগলাম । কিভাবে আজকে অফিসে সে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলো । আমিই তখনই ওনার অফিসে গিয়েছিলাম কাজে । দেখি আইরিন মেঝেতে পড়ে আছে । একটু আগে একাউন্সের জামিল সাহেব কে সেই ঝাড়ি দিয়েছে সেটা অফিসের সবাই শুনেছে । কই জামিল সাহেবের অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার কথা, তা না পড়ে আছে আইরিন নিজে । তারপর লোকজন ডেকে সবাই মিলে ধরাধরি করে অফিসের কাছেই একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে এলাম । প্রথমে বেশ কয়েকজন থাকলেও শেষে আমি রয়ে গেলাম । কেন রয়ে গেলাম আমি জানি না ।
আইরিন বলল-সবার মত আপনি ও চলে গেলেন না কেন ?-জানি না । কেন জানি ইচ্ছে হল না । মনে হল যদি কিছু দরকার পরে আপনার । আর কেউ ছিল না তো আপনার কাছের কেউ ।
আমার এই কথ শুনে আইরীনের মুখটা একটু যেন কালো হয়ে গেল । তারপর বলল-আমার কাছের কেউ নেই । কেউ আসবেও না আমাকে দেখতে ! আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । আর কথা ঠিক এগুলো না । আমি এবার বাইরে অপেক্ষা না করে আইরিনের ক্যাবিনে রাখা সোফার উপরেই বসে পড়লাম । ওকে বললাম একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে । আর যদি কোন দরকার পড়ে তাহলে যেন আমাকে ডাক দেয় । 
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আইরিন তখনও ঘুমিয়ে আছে । সাদা চাদরের মাঝে গুটুসুটি হয়ে শুয়ে আছে । এই মেয়ে কাল পর্যন্তও আমাদের বকাবকি করেছে কিংবা আমাদের অফিসে সবাই এই মেয়ের ভয় কিংবা জ্বালায় অস্থির হয়ে থাকে এটা আমার কোন ভাবেই এখন বিশ্বাস হল না । কোন কারন নেই তবুও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেক টা সময় । কখন যে আইরিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল সেটা টেরই পেলাম না । আইরিন নিজেও টের পেল যে আমি ওর দিকে এতো সময়ে তাকিয়ে রইলাম । নিজের কাছেই একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিলো । আমি বললাম-আমি অফিসের দিকে রওনা দেই । একটু বাসায় যাবো আগে । ঠিক আছে ।আইরিন বলল-আচ্ছা ।-আর ডাক্তার কিংবা আপনার যদি কোন কারনে দরকার হয় কোন কিছু না ভেবেই আমাকে ফোন দিবেন । আমাদের অফিসটা কাছেই । আসতে খুব একটা সময় লাগবে না । -আচ্ছা । 
যদিও আইরিন আচ্ছা বলল আমার সেই আগের অনুভুতিটা ফিরে এল । আইরিন চাচ্ছে না যে আমি ওকে রেখে অফিসে যাই । আমি দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে যেতেও ঠিক একই কথা মনে হল । মনের ভেতরে কেমন একটা খুঁচখুচে ভাব জমা হয়েই রইলো । বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে অফিসে হাজির হলাম । কেউ কেউ আইরিনের শরীরের খবর জানতে চাইলো । এর বেশি কিছু না । আমার কেন জানি কাজে মন বসলো না । 
আমাদের এই অফিস টা একটা শাখা অফিস । এটার হেড আইরিন নিজে । আজকে যদি অফিস না করে চলেও যাই তাহলে দেখার কেউ নেই । আমি ঘন্টা খানেক অফিসে বসে থেকে আবারও হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম । আসলেই কেমন জানি লাগছিলো । একটা মানুষকে হাসপাতালে একা একা রেখে চলে আসতে ভাল লাগছিলো না বিশেষ করে যেখানে তার দেখার কেউ নেই । যতই আমাদের কে সে ঝাড়ি মারুক বকা দিক, এতো দিন ধরে এক সাথে কাজ করছি । 
আমি যখন আবারও ওর কেবিনে প্রবেশ করলাম তখন আমাকে দেখে আইরিনের চোখটা অনেক টাই উজ্জল হয়ে এল । স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে আমাকে দেখে সে খুশি হয়েছে । আমি বললাম-অফিসে আজকে বস নেই তো তাই ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম ।আমার ঠাট্টা শুনে আইরিন কেমন বাচ্চাদের মত করে হেসে উঠলো । সত্যি বলতে এতো দিন ওর সাথে কাজ করছি ওভাবে এভাবে হাসতে দেখি নি । 
বিকেলের দিকেই ডাক্তার আইরিনকে রিলিজ করে দিল । ওকে ওর বাসায় পৌছে দিয়ে যখন সব কিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে আসবো তখনই আইরিন আমাকে একটা অদ্ভুদ অনুরোধ করে বসলো । ওর শরীর তখন বেশ ভাল হয়ে গেছে । অনেকটাই স্টেবল । বিকেল থেকে ওর সাথে গল্প করছি কথা বলছি । এক সাথে দুজন টিভি দেখছিলাম সময় কাটানোর জন্য । রাতে যখন চলে আসবো তখনই আইরিন আমাকে অনুরোধটা করলো ! 
টিভির রুমেই বসে ছিলাম । সামনে চায়ের কাপ । আইরিন বলল-একটা অনুরোধ করি ?-হ্যা । বলুন -আপনার কাছে অন্য রকম মনে হতে পারে তবুও । 
আমি ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম । কাল থেকে আইরিনের ভেতরে সেই আগের কাঠিন্যের ছিটে ফোটাও নেই । কেমন একটা নরম স্বভাব দেখা যাচ্ছে যেটা ওর চরিত্রের সাথে যায় না । আমি বললাম-বলুন !-আজকে রাতে এখানে থেকে যাবেন, প্লিজ ! আসলে একা থাকতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই । 
আমি আসলেই একটু অবাক হয়ে গেলাম । এক অসুস্থ হওয়াটা মেয়েটাকে কিভাবে বদলে দিয়েছে । মাত্র এক দিনে । আমি বললাম-আচ্ছা ঠিক আছে । সমস্যা নেই । -কালকে ছুটির দিন । সমস্যা হবে না তাই খুব ! 
আমি হাসলাম । আমার কাছে একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না বলবো না তবে মনে হচ্ছিলো যে মেয়েটাকে এখন সঙ্গ দেওয়াই ভাল । যতই শরীর ভাল হয়ে যাক এভাবে একা একা রেখে যাওয়া কেমন দেখায় । অনেক রাত পর্যন্ত গল্প চলল আমাদের । আইরিন যে এতো কথা বলতে পারে আমার ধারনাই ছিল না । যে মেয়েটাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথা বলতে কোন দিন দেখি নি সেখানে মেয়েটার জন্য কথা বলা থামছেই না । 
আমি বললাম-আপনি আসলে যেমন টা প্রিটেন্ড করে থাকেন আসলে তেমন নন ।-কেমন ?-এই যে আজকে মনে হচ্ছে আসল আপনাকে দেখছি ! -উইক !শব্দটা বলেই আইরিনের মুখটা একটু যেন মলিন হল ।-নো নো আমি ঐ কথা বলি নি । আমি আসলে বলতে চেয়েছি যে.....-আমি জানতে চেয়েছি আপনি কি বলতে চেয়েছেন । কিন্তু বাইরে আমি যতই শক্ত থাকি না কেন কিংবা ভেতরে আমি যে কতটা দুর্বল সেটা আবার আমার কাল মনে পড়েছে । আমি .. আমি যেন সেই আবার ২০ বছর আগে ফিরে গেছিলাম । দুর্বল অস হার একা এক মেয়ে যাকে তার বাবা মার কেউ নিতে চায় নি । কেউ ....
আমি কোন শব্দ খুজে পেলাম না বলার মত । আইরিনর কাঁদতে শুরু করলো । আমি আরও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম । এই সময়ে আমার কি করা উচিৎ আমি আসলেই বুঝতে পারলাম না । আমার পাশেই বসে ছিল । আমি ওর হাতটা ধরে বললাম-তুমি মোটেই দুর্বল নও । ইণফ্যাক্ট ইউ আর দ্য স্ট্রং ওম্যান আই হ্যাভ এভার সিন । বাট সামটাইমস ইভেন দ্য স্ট্রং ওয়ান নিডস এ সফ্ট হাগ !
আইরিন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ভেজা চোখ নিয়ে । তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে লাগলো । আমি কেন জানি কোন অস্বস্তি বোধ করলাম এবার । বরং এতোক্ষন যে অস্বস্থি কাজ করছিলো সেটা কেটে গেল । আইরিনের জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে । আমি ওর মাথায় একটু হাত রাখলাম । আরও কিছু সময় পরে কাঁন্না থেমে এল । তবে আমাকে ছেড়ে দিল না । 
জড়িয়ে ধরেই আইরিন আমাকে বলল-তোমাকে এখানে থাকতে বলাতে অবাক হয়েছো তাই না ?-একটু ! তবে সমস্যা নেই । -আমার আচরন কেমন উল্টা পাল্টা লাগছে তোমার কাছে তাই না ?-হ্যা । তোমাকে যেভাবে চিনি সেরকম কিছু করছো না । 
কিছু সময় চুপ করে থেকে আইরিন আমাকে ছেড়ে আবারও পাশে বসলো । তারপর টিভির সাউন্ডটা আরও েকটু কমিয়ে দিয়ে বলল-আজকে কেন জানি কেবল পাগলামোই করতে ইচ্ছে করছে । আরেকটু পাগলামো করবো ?-কি !-তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুই, শুবো ?আমি হাসলাম । হাসিতেই অনুমতি পেয়ে আইরিন শোফার উপরেই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো । 
আমি নিজের অবস্থাটা একটু বিবেচনার কল্পনা করলাম । আসলেই কোন দিন ভাবি নি আমাদের বস কোন দিন এরকম টিপিক্যাল বাঙালী মেয়েদের মত আচরন করতে পারে । কোন দিন ধরনাতেও আসে নি আমার । হঠাৎ আইরিন বলল-গতকালকে তুমি যখন আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি । -কেন ? এটা অবিশ্বাসের কি হল ? একজন মানুষ আরেকজনের জন্য এমনটা করতে পারে না ?-পারে হয়তো । কিন্তু আমি কোন দিন এরকম টা পাই নি । কোন দিন না । মানুষকে দোষ লাভ নেই আমার নিজের বাবা মাই এমন টা করে নি কোন দিন ।
আমি চেহারায় প্রশ্ণ নিয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম । আইরিন অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-আমার জন্মটা ঠিক প্লান করে হয় নি । ইভেন তারা তখন বিয়েও করে নি । দুর্ঘটনা থেকেই আমি পেটে আসি । তারপর তারা বিয়ে করে । আরও ভাল করে বললে আমার কারনেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং আমাকে দুজনেই একটা ঝামেলা মনে করে । সংসার বেশিদিন টিকে নি । আমি যখন সবে মাত্র ক্লাস ওনানে উঠেছি তখন তারা দুজনে দুদিকে চলে যায় কিন্তু আমাকে কেউ নিতে প্রস্তুত ছিল না । 
এই লাইন গুলো বলে আইরিন চুপ করে রইলো । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি ও কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে । তারপর একটু সামলে বলল-আমি প্রথম প্রথম বুঝতেই পারতাম না আমাকে ছেড়ে তারা চলে গেছে । কোর্টের মাধ্যমে একটা দফারফা হয় যে তারা কেউ আমাকে রাখবে না কিন্তু আমার বেচে থাকার জন্য যা দরকার তা তারা দুজন মিলে বহন করবে, কোর্টের কারনে বাধ্য হয়েছিল আর কি । তারপর থেকে আমি বোডিং হাউজে মানুষ হতে থাকি । অনেক মানুষ ছিল কিন্তু আমি একা খুব বেশি একা ছিলাম সারা জীবন । একবার সামার ভ্যাকেশনে, সবাই বাসায় চলে গেছে কেবল আমি রয়েছি । আরও কিছু মানুষজন রয়েছে । আমার খুব শরীর খারাপ হল । কিন্তু দেখার কেউ নেই, কেউ একজনও নেই । সেদিন আমার এতো বেশি অসহায় নিজেকে মনে হয়েছিল । গতকালকেও ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল । কিন্তু নার্স যখন বলল আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে আমি ভাবতেই পারি নি । নিজের ভেতরে কি একটা তোলপাড় হচ্ছিলো । রাতে যখন তুমি কেবিনের সোফাতে শুয়ে ছিলে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম । সারাটা রাতই । আই ডোন্ট নো আমি কি দেখছিলাম কিন্তু আমি তোমার দিক থেকে চোখ সরাতে পারি নি । 
আইরিন আমার দিকে একভাবেই তাকিয়ে আছে । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । আইরিন বলল-আমার কেবল মনে হচ্ছিলো যে দেয়ার সাম বডি ওয়েটিং ফর মি । সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো যে দেখো এই ছেলেটা আমার জন্য বাসায় না গিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে । আমার জন্য । আমি ফেলনা কেউ না । আমি ....
আবারও আইরিনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো । আমি ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম-এভাবে ভেবো না নিজেকে । তুমি অবশ্যই ফেলনা কেউ না । তোমার নিজের মূল্য আছে । 
আইরিন বলল-আই নো । কিন্তু কিছু একটা পরিবর্তন আমার ভেতরে হয়েছে । আমি বুঝতে পারছি । আসলে যে ঘটনা কোন দিন ঘটে নি সেরকম কিছু হয়েছে তো । তাই পাগলামো করছি । কার পরশু ঠিক হয়ে যাবে ।-তার মানে কালকের পর থেকে আবার আমাদের সবাইকে দৌড়ের উপর রাখা শুরু করবে !আইরিন হেসে উঠলোতারপর আমার হঠাৎ করেই মাথাটা উপরে নিয়ে এসে আমার নাকের সাথে নিজের নাকটা স্পর্শ করলো মৃদ্যু ভাবে । তারপর আবারও নিজের মাথাটা আমার কোলের উপর উপরে নিয়ে গিয়ে বলল-আমাদের মস্পর্ক আর কোন দিনও আগের মত হবে না । আই মিন, ইউ নো হোয়াট আই মিন ! 
আমি কিছু না বলে কেবল হাসলাম । আসলেই আগের মত আমাদের সম্পর্ক আর রইবে না । না থাকুক । এতোদিন আমরা সবাই কেবল আইরিনের বাইরের কঠিন দিকটাই দেখে এসেছি । কিন্তু ভেতরেও যে এমন একটা দিক আছে সেটা হয়তো টেরই পেত না যদি না কালকের ঘটনা ঘটতো আর আমিও এখানে এভাবে বসে থাকতাম না ! 

১২।ওয়ার্ড কমিশনারের বোন এবং আমার সম্ভাব্য সফল প্রেমের গল্প

আমাদের এলাকার কমিশনার সাহেব মাঝে মাঝেই এলাকা পরিদর্শনে বের হয় । এটাকে ঠিক পরিদর্শন না বলে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া বললেই মনে হয় ভাল হয় । এই সময়ে তিনি এলাকার সব কিছু দেখা শুনা করে । কোনটা কোথায় থাকা উচিৎ নয় সেটা দেখে বেড়ান । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যেদিন তিনি পরিদর্শনে বের হন তার আগেই সবাই সব কিছু জেনে যায় । তারপর অস্থায়ী ভাবে সব কিছু ঠিক করে ফেলে । 
উদাহরন দিয়ে বলি । আমি যে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি সেই হোটেল মালিক নিজের হোটেল ছাড়াও রাস্তার মোটামুটি অর্ধেক জায়গা দখল করে চেয়ার টেবিল বসিয়েছে । আজকে খেতে গিয়ে দেখি রাস্তার উপর আর চেয়ার টেবিল কিছু নেই । বুঝলাম আজকে আবারও কমিশনার সাহেব আসবে । অবশ্য আমি আগে থেকেই খোজ পেয়েছিলাম । 
খাওয়া শেষ করতে না করতেই কমিশনটার রাজিম ভাইয়ের দেখা পেয়ে গেলাম । গোটা ৫০ জন লোক তার আশে পাশে ঘুরাফেরা করছে । তিনি সব কিছু দেখছেন । আমি কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বুকে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম ।


-ভাই একটা কথা ছিল !
আমার কথা শুনে আসে পাশের সবাই কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেল । যেখানে সবাই কমিশনারের কথায় হ্যা হ্যা করে যাচ্ছে সেখানে আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলাম । দেখলাম একজন চামচা মত ছোকড়া এগিয়ে এসে বলল-কি চাই ?-ভাইয়ার সাথে একটা সেলফি তুলতে চাই ?-কি ? কেন ? ভাইয়ের কি আর কোন কাজ নেই নাকি ?
আমি এবার আমাদের কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বললাম-ভাই প্লিজ ! আপনি হচ্ছেন আমাদের এলাকার হিরো । হিরো বলতে একেবারে আসল হিরো । আপনার সাথে সেলফি তুলে যখন ফেসবুকে পোস্ট দিবো তখন আমার ভ্যালু কত বেড়ে যাবে জানেন !! প্লিজ ! একটা মাত্র ছবি !
আমি দেখতে পেলাম কমিশনারের চোখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো । ওঠারই কথা । এমন প্রশংসা কেই বা পছন্দ করে না । সবাই তোষামদে গলে যেতে বাধ্য ! আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু মনে এতেই কাজ হয়ে যাবে ।কমিশনার বলল-আচ্ছা ঠিক ঠক আছে । একটা সেলফিই তো ! -জি ভাই !কমিশনারের সাথে একটা সেলফি তুলেই ফেললাম ।সেলফি তোলার পরে বললাম-আপনি সাথে সেলফি তুলতে পেরে আজকে আমি খুবই আনন্দিত ।-আচ্ছা ঠিক আছে । কোথায় থাকো তুমি ?-আলীম সাহেবের বাসায় । -আচ্ছা ! -ভাই যদিও জানি আমাকে দরকার নেই তবুও যদি কোন দিন আপনার কোন উপকারে আসতে পারি আমাকে নির্দ্বায় বলবেন । বলবেন কি হুকুম করবেন ! আপনার হুকুম শুনতে আমি সদা প্রস্তুত ! -আচ্ছা আচ্ছা ! তোমাদের মত ছেলেদেরই তো দরকার আমার দলে । মাঝে মাঝে এসে কাজ টাজ করে যেও !-অবশ্যই ! আপনি যখন বলবেন ! -তা কোথায় পড় তুমি ? আমি বললাম কোথায় পড়ি । নাম শুনে বেশ প্রসণ্ণ হলেন মনে হল । খুশিও হলেন । সবাই ই হয় এমন করে ।
আমাকে রেখে কমিশনার হাটা দিল তার দলবল নিয়ে । আমি দাড়িয়ে রইলাম । মনে মনে হাসলাম কেবল. আপাতত আমার কাজ এখানে শেষ । এখন কেবল অপেক্ষা করার পালা । 
আমার ডাক পড়লো আরও সপ্তাহ খানেক পড়ে । সেদিনের সেই ছোকড়াই আমাকে ডাকতে এল । আমি সুড়সুড় করে হাজির হয়ে গেলাম কমিশনারের অফিসে । আমার দিকে তাকিয়ে কমিশনার বলল-তুমি সেদিন বলেছিলেন না তুমি কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড় ?-জি ! -আমার একটা কাজ করে দিতে হবে ! -আপনি কেবল হুকুম করে ভাই । দিতে হবে কেন বলছেন । বলবেন এই কাজটা করে দে !কমিশনারের মুখে আবারও হাসি দেখা গেল । বলল -আমার ছোট বোনের পিসিতে কি একটা সমস্যা হয়েছে । কি নাকি করা লাগবে । একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার দরকার । তুমি কি পারবে ? আমি আবার এ ব্যাপারে কম বুঝি ! -আরে পারবো না মানে ? অবশ্যই পারবো । আর আমি না পরলে আমাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাবো । কোন সমস্যা নেই ।তারপর কমিশনার পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল-একে বাসায় নিয়ে যা । রুনুকে বলবি কি সমস্যা একে যেন বলে । 

সেই ছোকড়ার সাথে সাথেই কমিশনারের বাসায় এসে হাজির হলাম । দরজা খোলাই ছিল । ছেলেটা ছোট আপা বলে ডাকতেই কমিশনার ছোট বোন বের হয়ে এল । একে কে না চেনে । এলাকার সবাই এক নামে চেনে । একটু কথা বলার জন্য এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করে কিন্তু সাহসের অভাবে কিছু বলতে পারে না । আর যা ভাব নিয়ে চলে । অবশ্য ভাব নিয়ে চলা একে মানায়ও । একে তো ভাই কমিশনার তার উপরে কন্যা মাশাল্লা দেখতেও সেই !!আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-কি ?-আপনাের কম্পুটারের কি জানি সমস্যা ! এরে কইতে কইছে ভাই !-ইনি কেন ? মিস্ত্রি ?আমাকে দেখে কি মিস্ত্রির মত মনে হচ্ছে ? আমি একটু কেশে উঠলাম !ছোকরা বলল-এই ছেলে পারবে । আপনি একে বলেন । রুনু তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল-পারবেন আপনি ?-চেষ্টা করে দেখি ! না পারলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে । আর ভাই যখন পাঠিয়েছে । দেখতে তো হবেই । রুনু যেন কথা শুনে একটু বিরক্ত হল । তারপর পাশের ছোকড়ার দিকে তাকিয়ে বলল-আচ্ছা ঠিক আছে । ভাইয়াকে বল যে আজকে যেন একটু জলদি বাসায় আসে । কেমন ?এই কথার পরেও ছোকড়া দাড়িয়ে রইলো । রুনু বলল-কি ব্যাপার দাড়িয়ে আছো কেন ? -না মানে .....রুনু বলল-কোন ভয় নেই । ভাইয়া পাঠিয়েছে না একে । তাহলে ?
আসলে ছোকড়া আমাকে এখানে একা রেখে যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছে না । তবুও রুনু ধমক শুনে দরজার দিকে হাটা দিল । আমি রুনুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম । এই মেয়ে এমন ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে । পেছন থেকে এক মহিলা বের হয়ে এল ! রুনু বলল-মা, ভাইয়া একে পাঠিয়েছে পিসিটা ঠিক করার জন্য । তিনি মনে হয় কোন কাজে ব্যস্ত ছিলাম । আমার দিকে একটু তাকিয়ে বলল-তোর পিসির কাছে নিয়ে যা । রুনু কিছু বলল না । মহিলা আবার যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিকেই চলে গেলেন ।রুনুকে দেখলাম ঘরের অন্য দিকে হাটতে । আমি কি করবো ঠিক বুঝলাম না । আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রুনু বলল -এই যে মিস্ত্রী সাহেব । আসুন.আবার মিস্ত্রী ? আমি কি মিস্ত্রী ? এই মেয়ের খবর আছে কিন্তু !
আমি ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম । ওর পিসিটা ওর নিজের ঘরে । ওর ঘরের ঢুকতেই ওর হাত দুটো দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলাম । তারপর মুখটা খুব কাছে নিয়ে এসে বললাম -আমি মিস্ত্রী ? হুম ?রুনু আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে তারপর বলল-ছাড় ! মা চলে আসবে !-আসতে দাও ! দেখুক !-প্লিজ ! এমন করে না । ভাইয়া জানতে পারলে কি করবে জানো তো ! -হুম ! দেখলে না তোমার ভাইয়াই তো আমাকে এখানে পাঠালো তোমার সমস্যা সমাধানে ! তা ম্যাডামের সমস্যা সমাধান করবো না ? -যাও ! ফাজিল ! বলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে পিসি চালু করতে গেল ।
অনেক দিন আগে কথায় কথায় রুনুলে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম যে আমি ওদের বাসায় ঢুকবো । আমি জোর গলায় বলেছিলাম যে ওর নিজের ভাই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে । সেই জন্যই ওর ভাইয়ের সাথে সেলফি, তেল দেওয়া এই সব । আমি যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এটাই খানিকটা জানানো । তারপর রুনুকে দিয়ে তার ভাইকে জানানো যে তার পিসিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সেটা যেন তেন ভাবে ঠিক হবে না । একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার লাগবে !আমি নিশ্চিৎ জানতাম যে আমার কথা তার মনে পড়বেই । ঐদিন যেভাবে তেল মেরেছি না মনে পড়ে কি পারে !রুনু পিসি চালু করে বলল-দেখো কি সমস্যা ?-আগে আমার পুরুস্কার !-কিসের ?-মনে নেই ? বলেছিলাম আমি যদি আসতে পারি তাহলে কি দিতে হবে !-আচ্ছা বাবা দেবতো মানা তো করি নি ! আগে পিসিটা একটু দেখো । নয়তো ধরা পড়ে যেতে পারে !

দুই
রুনুকে আমি প্রথম দেখি যেদিন এই এলাকাতে প্রথম আসি সেদিনই । বাসার সামনে ভ্যানে মাল পত্র নিয়ে বসেছিলাম তখন দেখি রুনু সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । আমি তাকিয়ে দেখলাম তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলাম । এই আমাদের প্রথম দেখা । ঠিক তার পরের দিনে আবার দেখা । আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি । টিউশনীতে যাবো । কঠিন রোড উঠেছে । রুনুকে দেখলাম সামনে দিয়ে আসতে । আমার দিকে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল-সামনের মোড়ে গিয়ে একটা রিক্সা ডেকে দিন তো ! 
আমি অবাক হয়ে কিছু সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । তখনও ওর নাম ধাম ওর পরিচয় কিছুই জানি না । তাই একটু অবাক লাগলো । চিনি না জানি না এরকম একজনকে রিক্সা ডেকে দিতে বলা । তাও আবার অনুরোধের সুরে বললেও হয়, বলছে হুকুমের সুরে । আমি বললাম-আমি ওদিকে যাবো না । পেছনের দিকে যাবো মেয়েটি আমার দিকে এবার ভাল করে তাকালো । তারপর বলল-আপনি জানেন আমি কে ?-তুমি কে সেটা তো আমার জানার দরকার নেই । আছে ? নিজের রিক্সা দরকার নিজে ডেকে নাও । আর কথা না বলে পেছনের দিকে হাটা দিলাম । এখনও দুপুরের খাওয়া হয় নি । কালকেই পেছনের দিকের এই হোটেলের খোজটা পেয়েছি আমি । 
যদিও আমি একবারও পেছনের দিকে তাকাই নি তবে আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা আমার দিকে খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে রয়েছে । যদিও আমার তখনও কোন ধারনা নেই আমি কার সাথে কথা বলছি । রুনুর খোজ পেলাম আরও সপ্তাহ খানেক পরে । সাথেই আমার রুমমেট ছিল । দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম । তখনই রুনুকে দেখতে পেলাম । 
জিজ্ঞেস করতেই আমার রুমমেট সব হড়বড় করে বলে দিল । সত্যি বলতে কি একটু ভয় লাগলো নিজের কাছেই । ঐ দিন মেয়েটা যদি ওর কমিশনার ভাইকে সব বলে দেয় তাহলে আমার খবরই আছে । কে জানে বলে দিয়েছে কি না । আমি পরের কয়েকদিন একটু ভয়ে ভয়ে থাকলাম । কিন্তু একটা সময় ভয় কেটে গেল । মনে হল যে কিছু হবে না । মেয়েটা আমাকে চিনে আমিও মেয়েটাকে চিনি না । কিন্তু ভয় ভাঙ্গলো কয়েকদিন পরেই । আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরছিলাম । ধানমন্ডির আল ফ্যাসকোর সামনে দেখি রুনু দাড়িয়ে আছে । খানিকটা বিরক্ত মুখে । আমার কি মনে হল আমি রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম । তারপর রুনুর সামনে গিয়ে হাজির হলাম ।-আপনি এখানে ?
রুনু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময় । একবার মনে হল আমাকে মনে হয় ঠিক চিনতে পারছে না কিন্তু পরমুহুর্তেই রুনু বলল-আপনি আগের দিন আমাকে তুমি করে বলছিলেন !-ও তাই নাকি ! তাই বলেছি বুঝি !-জি ! -তো এখানে কি ! -কিছু না । আপনার এখানে কি !-না আমি দেখলাম আমাদের এলাকার এক সুন্দরী মেয়ে এখানে একা একা দাড়িয়ে আছে । মনে হয় আজকেও রিক্সা খুজে পাচ্ছে না । তাই সাহায্য করতে এলাম ।-ঐদিন তো সাহায্য করেন নি । আজকে কেন হঠাৎ ! আমি খানিকটা কাব্যবিক সুরেই বললাম-আমি অতীতকে ভুলে যেতে চাই । আসলে অতীতের ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোই সফলকাম হয় ।সাধারনত এই ধরনের কথায় মেয়েরা পটে না বরং বিরক্ত হয় । কিন্তু রুনুর মুখে হাসি ফুটতে দেখলাম । আমার দিকে তাকিয়ে বলল-একজনের আসার কথা !মনে মনে বললাম যাহ শালা । এই মেয়ের দেখি আগে থেকেই বয়ফ্রেন্ড আছে । তাহলে আর হল কি । রুনু বলল-না । আমার বয়ফ্রেন্ড না । মেয়ে বন্ধু ।-আমি বয়ফ্রেন্ডের কথা ভাবছিলাম তোমাকে কে বলল ?-আপনার চেহারা । -চেহারায় লেখা ছিল নাকি ?-ওরকমই মনে করতে পারেন । যাই হোক ও দেরি করছিল । একটু আগে ফোনে ঝাড়ি মেরেছি বলেছি আসতে হবে না ।-ভাল করেছো । ঝাড়ি মারাই উচিৎ । চল এখনও চল । 
এইবার আমিস ব থেকে সাহসিকতার কাজটা করলাম । আলফ্রাসকোর সিড়ির দিকে হাটা দিলাম রুনুর হাতটা ধরে । এমন একটা ভাব করলাম যে ওর হাত আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধরতে পারি । যখন সিড়ি দিয়ে উপড়ে উঠছিলাম তখনও ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখে খানিকটা বিশ্ময় কাজ করছে । কিন্তু সেটা হাসিতে পরিনত হত সময় লাগলো না । সিড়িতে উঠতে উঠতেই রুনু বলল-ভেরি ব্রেভ । এতো সাহস দেখানো কিন্তু ভাল নয় । -জানি । সাথে এও জানি যে মেয়েরা সাহসী ছেলেদের পছন্দ করে ।-কিন্তু মেয়ের ভাইয়েরা কিন্তু এরকম ছেলে পছন্দ করে না ।-না করুক । মেয়ে পছন্দ করলে মেয়ের ভাই বোন, বাবা মা সবাই এক সময় ঠিকই পছন্দ করে ফেলবে ! 
যদিও আমার কোন ধারনা ছিল না আমি কি করছি কিন্তু ঝোকের মাথায় ঠিক ঠিক জায়গায় কোপ পড়েছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । রুনুর সাথে আমার লুকোচুরি প্রেম শুরু হয়ে গেল । এলাকাতে আমরা এমন ভাবে থাকতাম যেন একে অন্যকে চিনিই না । ও মাঝে মাঝে আমার ক্যাম্পাসে আসতো আমিও যেতাম ! 

তিন 
কমিশনার রাজিম ভাইয়ের সাথে তারপর থেকেই বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল । মাঝে মাঝে ওনার এলাকার কাছে অনেক লোকজন দরকার হত । আমার ডাক পড়তে লাগলো । আমিও যেতে লাগলাম । এবং এক সময় আবিস্কার করলাম যে রাজিম ভাই আমাকে বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছে । বিভিন্ন কাজে আমি যেতাম । সব থেকে বেশি পছন্দ করতে শুরু করলো যেদিন আমি ওনার জন্য ভাষনের স্ক্রিপ্ট লিখে দিলাম । 
এলাকাতে একটা ফাংশনের আয়োজন করা হয়েছিল । বেশ নেতা এসে হাজির হবে । রাজিম ভাই চিন্তিত কি ভাষন দিবে সেটা নিয়ে । আমি স্ক্রিপ্ট লিখে দিলাম । রাজিম ভাই যখন স্পিচ দিল । হাত দিল যেন থামতেই চায় না । তারপর থেকে আমি আরও একটু পেয়ারের পাত্র হয়ে উঠলাম । এর মাঝে অবশ্য আরও কয়েকবারই আমি রাজিম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছি কম্পিউটার ঠিক করার জন্য । শবে-বরাতের দিন রাজিম নিজে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে হাজির হল । রাতের খাবার খেলাম একই টেবিলে বসে । রুনু আমার দিকে মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছিলো । মাঝে মাঝে পা দিয়ে খোচাও মারছিলো । আমি কিছু বলতেও পারছিলাম না কারন পাসে রাজিম ভাই বসে ছিল । 
সময় যেতে লাগলো । রুনুর সাথে প্রেমটাও জমে উঠেছে বেশ । তবে মনের ভেতরে একটা চিন্তা আর ভয় ঠিকই কাজ করছিলো । যদি রাজিম ভাই জেনে যায় তাহলে এই ভালবাসা কিসে পরিনত হবে আমি জানি না । তাই একটা সাহসী কাজ করেই ফেললাম । রুনু আমাকে প্রবল ভাবেই মানা করলো । কিন্তু আমি শুনলাম না । আমার মনে হল কাজটা করেই ফেলা দরকার । 
সোজা গিয়ে হাজির হলাম কামিশনারের অফিসে । আমার চেহারা দেখেই রাজিম ভাই কিছু একটা আচ করতে পারলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল-কি হয়েছে রে তোর ? এমন কেন লাগছে ?-ভাই আপনার সাথে একটা কথা বলতাম ।-বল ! -একটু একা বলা দরকার । ঘরের ভেতরে আরও যারা ছিল সবাইকে চলে যেতে বলল । ঘর ফাকা হলে গেলে রাজিম ভাই বলল-এবার বল কি হয়েছে । কোন সমস্যা ? কেউ কিছু বলেছে ?-না ভাই ! আমি আরেকবার চিন্তা করলাম বলবো কি না কিংবা বলা ঠিক হবে কি না । ফলাফল যেকোন দিকে যেতে পারে । আমি বললাম -ভাই আমি একটা খুব বড়ত অন্যায় করে ফেলেছি আপনার সাথে ।-কি করেছিস ?-জানি না ভাই কিভাবে করলাম । আপনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত দেখেন নিজের বাসায় নিয়ে আমাকে ভাত পর্যন্ত খাওয়ালেন আর আমি কি করে করলাম এই কাজ টা । আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে । আমি কিভাবে করলাম এই কাজটা ।
এটা যদিও একটু বাড়িয়ে বলছি । আসলে রাজিম ভাইকে ইমোশনালী ব্লাকমেইল করার জন্য বলা । রাজিম ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হল কিছুটা কাজ হয়েছেও । আমার দিকে তাকিয়ে বলল-আরে বলবি তো কি করেছিস ?-ভাই রুনু !এবার রাজিম ভাই একটু সোজা হয়ে বসলো । আমার কাছে মনে হল যা বলেছি এই পর্যন্তই থাক । আর বেশি কিছু বলার দরকার নেই । কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এতো দুর যখন চলে এসেছি তখন আর অপেক্ষা করে লাভনেই । বললাম-আপনার পরিবারের সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় । রুনুর সাথে আমার দেখা হয়েছে অনেক বার । কথাও হয়েছে । কিন্তু কদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করলো আমি রুনুর ব্যাপারে অন্য রকম ফিল করা শুরু করেছি । -কি বলছিস ?-জি ভাই । আমি মনে হয় রুনুর প্রেমে পরেছি । কিন্তু এই কথাটা মনে হওয়ার পর থেকেই নিজেকে বড় হীন আর ছোট মনে হচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে বিট্রে করেছি । তাই রুনুকে আমার মনের কথা জানানোর আগে আমি আপনাকে বললাম । আমি আপনাকে না জানিয়ে কিছু যদি করি তাহলে আপনাকে পেছন থেকে ছুরি মারা হবে যা আমি কোন দিন পারবো না । এখন আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো । যদি আমাকে শাস্তি দিতে চান তাও আমি মাথা পেতে নেব যদি এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে কালই চলে যাবো । আর কোন দিন আপনার সামনে আসবো না । 
শেষ কথা গুলো বলার সময় গলার স্বর এমন করলাম যে নিজের কন্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । রাজিম ভাই সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন । আমার দিকে তাকিয়ে বলল-রুনু জানে ?-না ভাই ওকে বলি নি । -কিছু বলার দরকার নেই । তোকে চিনি বলে কিছু বলছি না । কালকেই চলে যাবি এলাকা ছেড়ে । তোকে যেন এই এলাকায় আর না দেখি ।-আচ্ছা ! 
যখন অফিস থেকে বের হলাম তখন নিজের গালেই একটা চড় মারতে ইচ্ছে । রুনুর কথা শুনলেই মনে ভাল হত । তাহলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হত না । বেশি বুদ্ধি দেখাতে গিয়ে সব কিছু হারাতে হল । রুনু সব শুনেও খুব রাগারাগি করলো । 

সন্ধ্যার সময় আবার যখন আমার ডাক পড়লো তখন একট ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হল এবার আমার মাইর খাওয়ার সময় এসেছে । নিজেকে খানিকটা প্রস্তুত করেই নিলাম । কিন্তু রুনুকেও রুমের ভেতরে দেখে খানিকটা অবাক হলাম । আমাকে রাজিম ভাইয়ের অফিসে নয় বরং রুনুদের বাসায় আনা হয়েছে । আমি সোজা হয়ে বসে রইলাম । রুনুও বসে রইলো চুপ করে । রাজিম ভাই বলল-যা হয়েছে হয়েছে । ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখলাম । অনেক ভেবে দেখেছি ..... তুই ছেলে হিসাবে খারাপও না । ভাল জায়গায় পড়াশুনা করিস ! সব দিক দিয়ে ফিট ....
কি হয়েছে ঠিক বুঝলাম না । কি বলবো ঠিক বুঝতেও পারলাম না । কিছু বলা উচিৎ হবে না ভেবে চুপ করেই রইলাম । রাজিম ভাই বলল-আমি বড় ভাই হয়ে ব্যাপারটার অনুমুতি দিচ্ছি তবে খারাপ কিছু যেন কোন দিন না শুনি ! -কিসের.......বলতে গিয়ে থেমে গেলাম । রুনু আমাকে থামতে বলল চোখের ইশারায় ! 
রাজিম ভাই এর পর আরও কতকথা বলতে লাগলো । এখনকার ছেলে মেয়েরা কেমন । কি করে না করে । আমাদের কি করা উচিৎ নয় কিংবা কি করা উচিৎ তবে উনি বেশ খুশি হয়ে আমি এমন কিছু করি নি । 

তারপর আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেই উনি চলে গেলেন । আমি রুনুর দিকে তাকিয়ে বললাম -কি হল এসব ?-কি হবে । আরেকটু হলেই নৌকা ডুবতে বসেছিল । তবে এখন ঠিক আছে !-মানে কি । কিভাবে হল ? আমি ভেবেছিলাম আমার আজকে খবর আছে । -খবরই ছিল যদি আমি কিছু উল্টা পাল্টা বলতাম । 




পরিশিষ্টঃ 
আমারকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার বলার পরে আমি যখন রুনুকে সব বললাম তখন রুনু ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি বলবে । দুপুরে রাজিম ভাই যখন খেতে যায় তখন রুনুকে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওর সাথে কখনও কোন খারাপ ব্যবহার করেছি কি না কিংবা কিছু বলেছি কি না ! তারপর রুনুকে অবাক করে দিয়ে জানতে চায় আমাকে তার কেমন লাগে ! রুনু একটু ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলে যে আমাকে ওর বেশ ভাল লাগে তবে রাজিম ভাইয়ের জন্য যে কিছু বলে নি কোন দিন । সেও তার ভাইয়ের মান সম্মান নিয়ে ভাবে খুব ! ব্যাস এতেই পটে যায় । আমরা দুজনই আমাদের পছন্দের থেকে রাজিম ভাইকে বেশি মূল্যায়ন করেছি সে খুবই খুশি হয়ে ওঠে এবং কথা বলার অনুমুতি দেয় আরও ভাল করে বললে প্রেম করার অনুমুতি দেয় ! তবে অনেক শর্তও জুড়ে দেয় । 

তারপর ?আমরা দুজন সেই শর্ত গুলো মেনেছি কি না কিংবা আমাদের আসল সত্য রাজিম ভাই কোন দিন জানতে পেরেছে কিনা, সেটা অন্য কোন গল্প ।

১৩।ছোটগল্প - শব্দ

আশেপাশের চৌদ্দ গজে কেউ থাকার কথা না ! নির্জন গলিতে শুধু রাস্তার কুকুরগুলো আরামকরে শহুরে জোছনা খাচ্ছে। আমি কান খাড়া করি। শব্দ ! আবার, ওই তো ! ওই যে শব্দটা !!একটা গোঙ্গানির শব্দ কি ?
মানুষের ?কুকুরগুলোর ?
‘কুত্তার বাচ্চা কুত্তা !’ দেড় কেজি ওজনের একটা গালি দিয়ে তেড়ে যাই সামনের দিকে।‘চিনস আমারে ? হান্দায়া দিমু এক্কেবারে’। আমার হাতে কিছু নেই, আমি আতিপাতি করে খুঁজতে থাকি একটা কিছু। একটা ইটের টুকরো হলেও চলবে। চোখগুলো গেলে দিলে শান্তি লাগতো। ইশ, যদি কয়েকটাকে বেঁধে ইচ্ছে মতো সকাল পর্যন্ত পেটাতে পারতাম!‘গেছে গা তো, চাইয়া রইসস কোনদিকে ?’, আমার ভিতরটা বলে উঠে। চোখগুলো আরেকটু বড় বড় করতেই দেখি শেষ নেড়িটাও দৌড়ে কানা গলির ওপাশে গিয়ে গজরাচ্ছে।
শহর চুপ। গলি চুপ। ল্যাম্পপোস্ট চুপ। নেড়িগুলো চুপ। আমিও তো চুপ, কিন্তু গোঙ্গানির শব্দটা তো থামে না।‘কোন মাতারি রে ?’ থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ‘ বইয়া বইয়া কান্দস কেন ?’গোঙ্গানি থামে। হঠাৎ খসখস শব্দ হয়। কাগজে কাগজ ঘষার শব্দ। বেশ কিছুক্ষন, থেমে থেমে। উৎস ধরে আমি এগুতে থাকি। একটা ডাস্টবিন। পেছনে জমাট নর্দমা। তীব্র গন্ধটা নাকে আসতেই মনে হলো এই মুহূর্তে মগজটা কে যেন ফালি ফালি করে দিল।
‘বাঁচাও! বাঁচাও !!’ একটা গলা শোনা যায়।-‘কে ভাই ?’ গলাটা বাড়িয়ে দেই।-‘আমি, আমি। খুব অন্ধকারে আছি, বাঁচাও।’ বাচ্চা বাচ্চা গলাটা বলে উঠে।-‘আরে বেক্কল, আকাশে চান্দ উঠসে দেখসো না ? আন্ধার কই ?’ মেজাজটা আবার গরম হয়ে যায়। ‘কয় পেগ গিলসত হারামী ?’- ‘এখানে অনেক অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। আমাকে আলোর কাছে নিয়ে যাবে?’ ওপাশ থেকে ভেসে আসে কথাগুলো।- ‘দেখ ভাই, আমিও এই মাত্র গিল্লা আইসি।’ খেক খেক করে হেসে ফেলি। ‘ সইরা বয়, ডাস্টবিনে কি করস? বাইর হইয়া আয়।’- শ্বাস নেওয়া যায় না ! দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর দুর্গন্ধটা!- আরে বলদ ড্রেনের সামনে বইয়া আর কিয়ের গন্ধ পাইবি ?- ‘ফুলের গন্ধ নাকি অনেক আমুদে, আমার গায়ে একটু মাখিয়ে দিবে?’ অন্ধকার থেকে এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে কণ্ঠটা।
আমার আর সহ্যসীমা কুলায় না। ডাস্টবিনের পাশে কি ভেবে যেন এতক্ষন বসে ছিলাম। এক লাফে সামনে যাই। ভিতর থেকে শুয়োরটাকে বাইরে বের করে আনা উচিত বোধহয়।
এমন সময় হঠাৎ মাথার উপর যেন অনেকগুলো আলো এসে পড়ে। চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই দেখি ঠিক পেছন থেকে টর্চ জ্বালিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন।
-‘বড়বাড়ির মদখোরটা না ?’ মাথার পেছনে টর্চের গোড়ার সপাৎ একটা বাড়ি পড়ে। তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করে উঠার সামর্থ্যটা হারিয়ে ফেলি। ‘এইখানে কি করে এতক্ষন?’ কন্ঠটা ফিসফিসিয়ে কাকে যেন জিজ্ঞেস করে।- ডাস্টবিনের পাশে বসে ছিল ওস্তাদ। এতক্ষনে দ্বিতীয়জনের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।- কি করে দেখি। প্রথমজনের টর্চের আলো আমার মাথার পেছন থেকে সোজা সামনে নোংরা আবর্জনার স্তূপের উপর গিয়ে পড়ে।
একটা নবজাতক।মৃতদেহের ছোট্ট হাতটা একটু আগেই বোধহয় কুকুরগুলো চাবিয়েছে।
মাথার পেছনের ব্যাথাটা এতক্ষনে কমে গেছে অনেকখানি। এবার গলাটা ছিঁড়ে আমার ভীষণ চিৎকারটা বেড়িয়ে যেতে থাকে……..
পেছনে ছুঁয়ে যায় জোছনা খাওয়া পোড়া শহরটাকে !

১৪।গল্পঃ সুপক্ব রাত্রির গন্ধ

রোকেয়া বুজি মারা গেলেন এক শুক্রবারের মরা-রোদ-জড়ানো বিকেলে। 
সুজন নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে মাঠে চলে গিয়েছিল, আব্বার নজর এড়িয়ে। আব্বা এমনিতেও খেপে আছেন ওর ওপরে, বাইরে যেতে দেখলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন- "এই ধামড়ারে ক্যান পালি আমি? সামনে টেস্ট পরীক্ষা, গাধাটার লেখা নাই পড়া নাই, সারাদিন মাঠেঘাটে দাউদাউ করে ঘুরে বেড়াবো আর ভাত গিলবো! সব বাদ দিয়া হাটে কামলা দিলেও কামে লাগত, তাতে তো কথা নাই নবাব সাবের!" 
তাই হুমহাম গিলে চুপিসারে মাঠে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ও। পোলাপান বেশি আসে নি, সুজনকে দিয়ে আটজন। তাও জমেছিল, জুতা জড়ো করে গোলপোস্ট বানিয়ে খেলা শুরু করেছিল ওরা। চার নম্বর ডিয়ার ফুটবলে মনের সুখে লাত্থানো যায়, তার মধ্যে আবার ফুল পাম্প দিয়ে এনেছে; ছোঁয়া লাগলেই দৌড় দেয় বল। দুটো গোল দিয়েছিল সুজন (মতান্তরে তিনটা, কিন্তু বিপক্ষ টীম বলেছে জুতার ওপর দিয়ে বল গেলে গোল হয় না, তাই বাতিল); কিন্তু খেয়েছে পাঁচটা, শোধাতে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি একটু বেশিই হয়ে গেছে। তখন বোঝা যায় নি, আসলে আমলেই নেয় নি ও, এখন পায়ে চিনচিনে ব্যথা করছে মৃদু। 
এদিকে আজান দিয়েছে মাগরিবের, ঘোষণা করছে যে খেলার সময় শেষ; ক্ষুদে পাখি ছোট পাখি, নীড়ে ফেরো, নীড়ে ফেরো। দেরি না করে সুজন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ফিরে আসে।
ওকে খবরটা দিলেন আম্মা। উনি কেবল বুজির বাড়ি থেকে শেষবারের মতো দেখে এসেছেন, খুঁটিনাটি বললেন চার ছেলে আর তাঁদের বউগুলো কি ভীষণ কান্নাকাটি করছে বুজির জন্যে। দেখলে বুক পুড়ে যায়। বাসার সবার মুখ কিছুটা বিষণ্ণ খবরটা পেয়ে। সুজনের নিজেরও মন খারাপ হলো। রোকেয়া বুজি খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ছোটদের দেখলেই কোলে নিতেন, আদর করতেন, সুজনের মতো ধামড়া পোলাপানেরও মাথা হাতিয়ে দিতেন। চার ছেলে আছে বুজির, তাদের সাথে থাকতেন। কি মিশুক ছিলেন! শুধু রাতটা বোধহয় বাড়িতে ঘুমোতেন, আর বাকি সকাল থেকে সন্ধ্যা এর বাড়ি থেকে ওর বাড়ি ঠুকঠুক ঠুকঠুক, ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিতেন। এত বয়স হয়ে গেছে, তবু। মাঝে মাঝে কূটনামি করতেন, একটু আধটু, কিন্তু সেটা কে না করে! আসল কথা, এই মানুষটা গ্রামের অর্ধেকের বিয়ের ঘটকালি করেছেন, আর কেটেছেন বাকি অর্ধেকের নাড়ি। নির্বিচারে স্নেহের ছায়া-প্রদায়ী বিশাল একজন মহীরুহ। তাই তাঁর মৃত্যুতে পুরো রূপপুর গ্রাম যেন ঝিম ধরে থাকে অনেকটা সময়।
কিছুক্ষণ পরে মসজিদে মুহুর্মুহু মাইকিং শুরু হল- প্রিয় গ্রামবাসী, শোকসংবাদ। শোওক সংবাদ। অত্র এলাকাবাসি, সৈয়দা রোকেয়া বেগম, আজ বাদ আসর, ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। ইন্নানিল্লাহি, ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাহার জানাজা, আজ বাদ এশা, মসজিদ প্রাঙ্গণে সম্পন্ন হইবে। সকলকে যোগ দিতে আহ্বান জানান যাইতেছে। প্রিয় গ্রামবাসী, শোক...
এশার ওয়াক্ত আসে। গ্রামের পুরুষেরা সবাই মাথায় টুপি এঁটে ঠিকঠাক নামাযে উপস্থিত, আল্লার ভয়ে নাকি জানাজায় উপস্থিতি দিতে- তা অবশ্য বলা কঠিন। সুজনও নিজেকে আবিষ্কার করে সেখানে। প্রায় নিঃশব্দে, দ্রুত ঘটতে থাকে পরের ঘটনাগুলি। জানাজার নামাযে হাজিরা দিয়ে চার পুত্রের কাঁধে চড়ে বুজি গোরস্থানে গেলেন, তাকে সাবধানে শুইয়ে দেওয়া হল কবরে, ছ'ফিট মাটির নিচে চাপা দিয়ে গণ-মোনাজাত ধরা হল। ইমাম সাব আশ্বস্ত করলেন যে শুক্রবারে মরেছেন বলে অবশ্যি অবশ্যি বুজি ভেস্তে যাবেন, এবং বুজির মতো যারা সৎপথে চলেছেন সারাজীবন, তাদের মৃত্যু দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। 
সুজন একবার আশেপাশের মানুষের মুখে তাকাল। তারা অবশ্য ইমাম সাবের কথায় নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হল না, বরঞ্চ প্রত্যেকের চোখে বিষাদ, অস্বস্তি আর একটুখানি ভীতির প্রলেপ খুব গাঢ় করে মাখা। 
সেদিন রাত্রে ভাল ঘুম হল না সুজনের। 


২.

ইদ্রিস কাকার বাড়ি গোরস্থানের পাশে। একা মানুষ, কাকি মারা গেছেন দশ বছর আগে। নিজেই রেঁধেবেড়ে খান, নামায পড়েন আর আল্লাহ আল্লাহ করেন। কারো সাতেপাঁচে নেই। মসজিদ কমিটি তাকে গোরস্থানের তদারকি করার দায়িত্ব দিয়েছে। রাতে এমনিতেও কাকার ঘুম আসে না, লাঠি হাতে বের হয়ে মাঝে মধ্যে গোরস্থান টহল দেন। আসলে এই পদে কাজ তেমন নেই। লাশ চুরি করার মতো গর্হিত কাজ হয় না রূপপুরে। বর্ষায় দুএকটা কবর ডেবে যায়, মাটি দিতে হয় আবার। মাঝেমধ্যে শিয়াল কুকুর এসে কবর খোঁড়ে, তিনি ওগুলোকে ভাগিয়ে দেন লাঠি দেখিয়ে। 
সুতরাং বুজি মারা যাবার এক সপ্তা পর, টহল দিয়ে গিয়ে যখন তিনি দেখলেন দুটো শিয়াল বুজির কবর খুঁড়ছে, খুব একটা উদ্বিগ্ন হলেন না কাকা। লাঠি বাগিয়ে এগুলেন। জবরদস্ত দু ঘা খেয়ে শিয়ালদ্বয় ভেগে গেল, তিনি লাইট মেরে উবু হয়ে দেখতে লাগলেন কত গভীরভাবে খুঁড়েছে গর্ত। তখনি কবরের ভেতর থেকে কেউ বলল, 'হুশ হুশ, যা ভাগ শিয়ালের গুষ্টি। রাতবিরাতে জ্বালাইস না।'
ইদ্রিস কাকা একবার ভাবলেন, বোধহয় ভুল শুনেছেন কানে। তিনি আরেকটু এগিয়ে লাঠির মাথা নামিয়ে দিলেন গর্তে। এবার কণ্ঠটা বিরক্তি মাখা গলায় বলল, 'ওরেরে, লাঠি দিয়া গুতায় ক্যারা? কপালে আয়া লাগছে।' 
কাকা তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেলেন। কণ্ঠটা নড়াচড়া টের পেল, 'উপরে ক্যারা? ইদ্রিস? মিয়াভাই তুমি?'
কাকা ভারিগলায় জিজ্ঞেস করলেন, ''হ। কথা কয় ক্যাডা?''-'আমি রোকেয়া।'"বুজি?"-'হ রে পাগল। আমি, সৈয়দা রোকেয়া বেগম, তোমাগো বুজি।'"তুমি না মইরা গেছ?" -'নাহ। মরি নাই। ভুলে কবর দিয়া দিছে।' "ও।" -'শিয়াল আইছিল দ্যাখছো মিয়াভাই?' "হ। ভাগায়া দিছি।" -'ভাল করছো। এহন মাটি সরায়া আমারে উঠাও।' 
কাকা দ্বিধায় পড়ে গেলেন। তাঁর দেখামতে, আজ পর্যন্ত কোন কবরের বাসিন্দা এত নির্বিকার কণ্ঠে উপরে উঠে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে নি। উঠানো কি ঠিক হবে? কাজটা জায়েয না নাজায়েয কে জানে! নাকি তিনি আবার কোন ঝামেলায় পড়ে যাবেন? এই বুড়ো বয়সে ঝুঁকি নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
-'মিয়াভাই?'"অ্যাঁ?" -'উঠাও আমারে।'''তোমারে তো কবর দিছে ম্যালাদিন, এতদিন রা করো নাই ক্যান?''-'আমি হুঁশ পাই নাই মিয়াভাই। কব্বরের নিচে কি দিনক্ষণ বোঝন যায়, কও? অনেকদিন গেছে নাকি? কিছুই বুঝি নাই। তোমার সাড়া পাইয়া এখন ডাক দিলাম।' "বুজি, মরা মানুষরে কবর দেওয়ার পরে তো উঠানোর নিয়ম নাই। পুলিশের অনুমতি লাগে মনে হয়।"-'আমি তো মরি নাই। কথা কইতাছি না তোমার সাথে?'"হ...কিন্তু আমি কি করমু কও? তুমি নয় শুইয়া থাকো, সকালে আমি মসজিদে সবটির সাথে যুক্তি কইরা আমুনি?"-'আইচ্ছা। তাড়াতাড়ি আইসো। আমার পাশের কবরে এক ব্যাটা আছে, শালায় কানের কাছে খালি দিনরাত ওয়াজ করে, জ্বালায়া মারলো। একটু যদি শান্তি পাই!' "ওয়াজ করলে তো ভাল, তেলাওয়াত শুনলে সওয়াব হয় বুজি!"-'কুরআন তেলাওয়াত করলে তো ভালই আছিল, এ তো তা করে না, খালি উপদেশ দেয়- অন্যায়ের প্রতিবাদ করো, পৃথিবী শস্যক্ষেত্র মাত্র হেন তেন। আমি কই, কব্বরে শুইয়া কি প্রতিবাদ করমু রে ব্যাটা! তাও চুপ করে না। তুমি তাড়াতাড়ি আইসো মিয়াভাই।' 
এই বলে মাটির নিচের বুজি চুপ হয়ে যান। ঘুমান হয়তো। কিংবা ওয়াজ শোনেন। মাটির ওপরের ইদ্রিস কাকা লাঠির ওপরে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিতে হাঁটতে শুরু করলেন, তাঁর মুখব্যাপী গভীর চিন্তার ছাপ। 
সকালে মসজিদে দারুণ তর্কবিতর্ক শুরু হয়। সব মুসল্লি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল, গ্রামের একমাত্র মার্বেলের মেঝেটাতে ঘুষি মেরে চেঁচাতে লাগল যে অবশ্যি ওটা বুজি নন, শয়তান বা বদ জীন এসে কবরে জায়গা করে নিয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। বাকিরা কেন বুঝতে পারছে না এই সাধারণ জিনিসটা? যুগে যুগে কত অদ্ভুত খেল দেখিয়ে মোমিনদের ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করেছে শয়তান, এটা তাঁর নতুন আরেকটা কূট-কৌশল। আরেকটা ফন্দি মাত্র। অন্যদল, তাঁরা গণনায় বেশি কিন্তু গলায় খাটো; প্রতিবাদ করে বলল, হয়তো সত্যি বুজি বেঁচে আছেন, শয়তানের চালাকি তো নাও হতে পারে, বাকিরা নিশ্চিত হচ্ছে কি করে; সেক্ষেত্রে অতিসত্বর তাঁকে উঠানো উচিত। 
শেষটায় ইমাম সাব দীর্ঘসময় সিহাহ-সিত্তাহ ঘেঁটে চূড়ান্ত মতামত দিলেন- গোরস্থান হচ্ছে পবিত্র জায়গা; সেখানে বদ জীন বা শয়তান কারুর ইখতিয়ার নেই। সুতরাং কবরের ভেতরে কণ্ঠটা খুব সম্ভব বুজি স্বয়ং। কিন্তু তাঁকে আদৌ উঠানো হবে কি না, বা কি করা হবে- সিদ্ধান্তটা গ্রামের মানুষের নয়, তাঁর সন্তানদের হাতে। তারাই ঠিক করুক কি করবে। 
এতক্ষণ বুজির চার ছেলে চুপচাপ সব শুনছিল। বিষয়টা প্রথমে শোনার পর থেকেই তারা অস্বস্তি বোধ করছে, এবারে সিদ্ধান্তটা সরাসরি তাদের ঘাড়ে এসে পড়ায় অপ্রস্তুত মুখে বড় ছেলে বলে, ''আসলে, মার তো বয়স হইছিল, মইরা গেছিল, এখন উঠাইলে জিনিসটা কেমন হয় কন? আল্লার দুনিয়ার নিয়ম বইলা তো একটা কথা আছে, সেইটা ভাঙি কেমনে? আর আমরা চারজন তো সম্পত্তি ভাগ কইরা আলাদা হওয়ার চিন্তা করতাছি। এখন এমনে হইলে, মা তাইলে কার কাছে থাকব?''
ইমাম সাব বলেন, ''তাইলে উঠাবা না?''
বড় জন আবার কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে, ''না, উঠামু, মানে সম্পত্তির ঝামেলা মিটায়া তারপরে যদি...মানে মা তো কবরে রইছেই, কোনখানে আর যাইতাছে না তো। চিন্তাভাবনা কইরা, ঝামেলা মিটায়া তারপর উঠাই। হাদিসে আছে- তাড়াহুড়া কইরা সিদ্ধান্ত নিতে নাই। তোরা কি কস?'' প্রশ্নের উত্তরে বাকি ভাইয়েরাও মিশ্রসুরে সম্মতি দেয় তাঁর কথায়। 
কিন্তু মসজিদের আরেক কোণা থেকে ইদ্রিস কাকা বাগড়া দেন, ''তাইলে এইসব কথা তোমার মায়েরে যায়া কও গিয়া। বুজি নইলে আমারে প্রতি রাইতেই কবর থিকা উঠানের জন্যে কইব, আমি বুড়া বয়সে এতসব সহ্য করতে পারুম না বাবারা।'' 
সুতরাং নিরুপায় চার পুত্র নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলে কবরের দিকে হাঁটা দেয়, তাঁদেরকে পেছন পেছন অনুসরণ করে উৎসাহী গ্রামবাসী। 
বুজি ছেলেদের প্রথম ডাকেই উৎসাহী কণ্ঠে সাড়া দেন, পুনরায় পাশের কবরের বাসিন্দাকে নিয়ে অভিযোগ জানান এমন গলায়, যেন ছোট্ট অভিমানী মেয়ে বাপের কাছে বিচার দিচ্ছে, তারপর তাঁকে উঠানোর কথা বলেন। 
'বাজান, আমারে বাইত্তে নিয়া যা। বুকের উপর মাটির ওজন এত্ত বেশি, দম আটকায়া আসে। কাফনের কাপড় শরীরে চুলকায়, আর কি আন্ধার! আমার আর ভাল লাগে না।'
ছোট ছেলে বলে, ''মা, জমির ঝামেলাটা আমরা মিটায়া নেই, তারপরেই আপনেরে নিয়া যামু। আর জানেন না তো, দেশের অবস্থা এখন কি খারাপ, চোর-চোট্টা-ডাকাতি-খুন-খারাপি বাইড়া গেছে, কবরের চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর নাই। আপনে কবরেই থাকেন, আমরা উপযুক্ত সময়ে আপনারে উঠামু। আর ভয় পায়েন না, প্রতি শুক্রবারে কবর জিয়ারত করতে তো আসতাছিই।''
বুজি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্য করে নাম ধরে ধরে জিজ্ঞেস করেন, 'তোরাও কি তাই চাস? আমারে উঠাবি না?'
বাকি তিনজন সমস্বরে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে। জমির ঝামেলা চলছে। দেশে নিরাপত্তা নেই। উপযুক্ত সময়ে তারা মা-কে বাড়িতে নিয়ে যাবে।
কবরের নিচ থেকে এবার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ছেলেরা শশব্যস্ত হয়ে সান্ত্বনা দেয়, বারবার ডাকে, কিন্তু কোন সাড়া মেলে না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। একজন আশাভঙ্গ জীবিত কিংবা মৃত বৃদ্ধা মাটির নিচে একাকি শুয়ে কাঁদছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁদের হাঁটুতে ব্যথা শুরু হয়, অস্বস্তি বাড়ে; তারপর মা আর কথা বলবেন না বুঝতে পেরে তারা শুকনো মুখে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। গ্রামবাসীর গুঞ্জন থামে, ভিড় ছত্রখান হয়ে যায়। ততক্ষণে কান্নার শব্দও থেমে গেছে, আর দশটা কবরের সাথে বুজির কবরের কোন পার্থক্য নেই তখন। ঘণ্টাদুয়েক পরে গোরস্থান আগের মতই স্বাভাবিক জনশূন্য নীরবতায় ডুবে যায়। শুধু সুজন তখনো একা দাঁড়িয়ে।
সুজন কি ভাবছিল, বা কাজটা কেন করল নিজেও তা বলতে পারবে না, কিন্তু ও কবরের কাছে গিয়ে একবার ডাকে, ''বুজি?''
কোন সাড়া নেই। 
''বুজি আমি সুজন। মাহতাব উকিলের পোলা।'' 
এবার বুজি কথা বলেন, তাঁর গলা তখনো ভাঙ্গা, 'সুজন? নানা তুমি কি করো গোরস্থানে? কত সাপ খোপ থাকে এইখানে, যাও। বাইত্তে যাওগা।'
সুজন কথা থামায় না, ''আপনে ভয় পায়েন না বুজি। আমি প্রত্যেকদিন আমু, আপনার সাথে কথা কমুনি। আপনে কাইন্দেন না।''
বুজি যে প্রচন্ড খুশি হয়েছেন তা তাঁর কণ্ঠ শুনেই বোঝা যায়, অনেক কষ্টে কান্না সংবরণ করে তিনি বলেন, 'ও আমার সোনা রে! আইসো নানা, তুমি কথা কইয়ো এই বুড়ির সাথে, আমার সোনা চান মানিক। এহন যাও। আমার পুলাপানডিরে কইয়ো কবরের চাইরপাশে তুষ দিতে। তাইলে আর শিয়াল আইব না। যাও নানা। এইসব জায়গায় বেশিক্ষণ একা থাকতে নাই।'
তারপর সময়ের স্বাভাবিক ছন্দে কেটে যায় বেশ কয়েকটি মাস। বুজি ছেলেদের সাথে এখনো কথা বলেন না, মৌনব্রত ভাঙেন নি; কিন্তু গ্রামের অন্যান্য মানুষ গোরস্থানে এলে টুকটাক আলাপ করেন। মাঝে মধ্যে দুই একজন অপরিচিত মানুষ কবর জিয়ারতে দাঁড়ালে হঠাৎ কিশোরীর চাপল্য নিয়ে তাদেরকে চমকে দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসেন। ছেলেরা প্রতি শুক্রবার আসে, মায়ের কবর জিয়ারত করে, এবং আশ্বাস দেয় যে সুযোগ পেলেই তারা মাকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। এবং এভাবে বাকি গ্রামবাসীর কাছে পুরো ব্যাপারটা ধীরে ধীরে নাটকীয়তা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সব গ্রামেই তো দুই একটা অস্বাভাবিক জিনিস থাকে, তাই না? পাশের গ্রাম দেলদুনিতে এক পাগল আছে- এমনিতে সরল স্বাভাবিক, কিন্তু পুরোটা শীতের সময় জুড়ে পুকুরে গলা অব্দি ডুবিয়ে বসে থাকে আর বাউল গান গায়। উত্তরপাড়া গ্রামে আছে বিপ্লব কবি- যে জীবনে একটা মাত্র কবিতা লিখেছে, কিন্তু আজ অবধি তা শেষ করতে পারে নি। একটা লাইন লিখতে পারলে সে সেই খুশিতে পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে, তারপর বাড়ি গিয়ে পুরো কবিতা আবার পড়ে, দ্যাখে এখন আর পছন্দ হচ্ছে না, আবার কেটে দেয় সেই লাইন। দক্ষিণে করাতিয়া গ্রামে আছে একটা দুই মাথাওলা বাছুর। তেমনি রূপপুর গ্রামে আছেন বুজি- যিনি কবরের ভেতরে থেকে কথা বলেন। এ আর এমন কি? 
বুজির সঙ্গ নিয়মিত দেয় একমাত্র সুজন। ও নিজের কথা রেখেছে। প্রতিদিন বিকেলে খেলতে যাবার এক ঘণ্টা আগে ও গোরস্থানে আসে। বুজির কবরের কাছে একটা ছোট্ট ছালামতোন রেখে দিয়েছে, সেটায় বসে বুজির সাথে গল্প করে। প্রথম প্রথম বুজি গ্রামের সবার খবর নিতেন বুভুক্ষুর মতো। 
শরীফদের লিচুগাছে কেন পোকা ধরেছে, আলমদের সদ্য প্রসূত বকনা বাছুরের বাঁচার সম্ভাবনা কেমন,লিজার ছোট মেয়েটার এই অসময়ে হাম উঠল কেন,
এসব ব্যাপারে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না। সুজনের সাথে তুমুল আগ্রহ নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন, ঘন্টাখানেক পর ও যখন বলতো, বুজি তাইলে খেলতে যাই? তখন বুজি যদিও বলতেন, নানা যাও, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে আরো কথা বলার ইচ্ছে ফুটে উঠত পরিষ্কার। তখন সুজন বাধ্য হয়ে আরও কিছুক্ষণ বসে কথা বলে যেত। কিন্তু, ইদানীং ও লক্ষ্য করছে, বুজি এসব নিয়ে কেমন যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ও গতকাল আলমের বড় বোনের বিয়ের খবর বলছিল বুজিকে, একটু পরে সুজন বুঝতে পারল ও একাই বকবক করছে, বুজি তাল মিলিয়ে শুধু হুঁ হুঁ করে যাচ্ছেন। আর একটু পর উনি নিজেই ওকে থামিয়ে দিলেন। বললেন ওর খেলার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বরং মাঠে চলে যাক সুজন।
পরের দিন বুজি ওকে সরাসরি বললেন, 'নানা, গেরামের কথা বাদ দেও। দেশের খবর কও শুনি। খুন খারাপি কি কমছে? আমি বেরাইতে পারমু?'সুজন বলল, ''আপনার বের হওয়ার খুব ইচ্ছা করে, তাই না বুজি?''বুজি বললেন, 'হ, কিন্তু আগের মতন ইচ্ছা করে না। কবরেই তো ভাল আছি। আন্ধারে চোখ সয়া গেছে, মাটির চাপে চাপে আমার বিষ ব্যাদনা অনেক কইমা গেছে, বাতের ব্যথা নাই।'-''আর আপনার পাশের কবরের লোকটা? সে এখনো ওয়াজ শুনায়?'''শুনায়, কিন্তু আগের মতো জোরে জোরে কয় না। বিড়বিড় করে। ব্যাটায় আমার পাশের কবরে নাকি তাও এখন কইতে পারুম না। মনে হয় আস্তে আস্তে দূরে সইরা যাইতাছে। কি জিনিস আল্লা মালুম! আমার আগের মতো কষ্ট নাই নানা। কিন্তু নাতি নাতকুরগুলারে দেখতে ইচ্ছা করে, তাই উঠবার চাই। অরা কয় দেশের অবস্থা নাকি ভাল না, আমারে উঠাবো না তাই। তুমি আমারে দেশের খবর শুনায়ো।'
সুজন তারপর থেকে প্রতিদিন ওর সাথে খবরের কাগজ নিয়ে আসা শুরু করল। আব্বা প্রথমে ভুরূ কুঁচকেছিলেন, কিন্তু ওর ব্যাখ্যা শুনে পরে আর কিছু বলেন নি। আম্মা শুনে খুশিই হয়েছেন। ও বসে বসে পড়ে, বুজি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। রাজনীতি, খেলা, বিনোদন এগুলো বুজির পছন্দ না, কারণ 'আমি বুড়ি মানুষ, এইগুলা কি বুঝি!' তিনি এক অদ্ভুত মোহ নিয়ে শোনেন খুন-হত্যা-ধর্ষণ-মারামারি-দুর্ঘটনার খবর। মাঝেমধ্যে মন্তব্য করেন। 
বাস দুর্ঘটনা, নিহত ২৫, ড্রাইভার পলাতক ('ড্রাইভারডারে মাইর দেওনের কাম। দেইখা চালাইতে পারে না?')গৃহবধূর আত্মহত্যা, স্বামী গ্রেপ্তার('ইসস, মাইয়াটা না জানি কি কষ্ট পাইছিল!')দুই লেখককে কুপিয়ে হত্যা, তদন্ত চলছে('অরা মানুষ না কি?!')
কিন্তু এই উৎসাহও বেশিদিন টিকল না। বুজি যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন বাইরের জগত থেকে, সুজনকে এখন দুতিনবার কথার পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তারপর বুজি উত্তর দেন। আগে নাতি-নাতনীদের সম্পর্কে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতেন, এখন তাও করেন না। সুজন চিন্তিত হয়ে পড়ল। বুজির অনাগ্রহ দেখে ও খবরের কাগজ আনা বন্ধ করে দিল। অন্য কোন বিষয়ে বুজির আগ্রহ জাগাবার চেষ্টা করলো কয়েকদিন। কিন্তু প্রায় এক-পক্ষীয় কথোপকথন আর কতদিন চালানো যায়! এখন দুজনের মাঝে কথাবার্তা হয় এভাবে- সুজন দশটা শব্দ বলে, বুজি একটা শব্দ বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করেন, তাও পরিষ্কার বোঝা যায় না। 
পরেরদিন শুক্রবার। সেদিনও সুজন কবরের কাছে দাঁড়াল, বরাবরের মতোই বুজিকে ডাকল, 'বুজি আমি আইছি', কিন্তু সাড়া দিল না কেউ। ও কথাটা পুনরাবৃত্তি করল বারবার, কবরের চারপাশে পায়চারি করল, কিন্তু কোন কণ্ঠ আনন্দিত গলায় বলল না, 'নানা আইছো?' শুধু পাখি ডাকছে, বাতাসে গাছের ডাল নড়ছে, আর বুকের ভেতরে একটা চাপা আতঙ্ক চেপে ধরছে সুজনকে। কি হয়েছে বুজির? বুজি কথা বলছেন না কেন? ও আজকে ছালা টেনে বসতে পারে না। ঘন্টাখানেক সেখানে দাঁড়িয়ে বুজিকে ডেকে যায় বারবার, কিন্তু কেউ কথা বলে না। 
শেষে সুজনের কেন যেন ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। ও দৌড়ে গ্রামে গিয়ে কথাটা ছড়িয়ে দেয়, তারপর বুজির চার ছেলেকে জানায় ঘটনাটা। অল্প সময়ের মাঝেই মোটামুটি পুরো গ্রাম চলে আসে কবরস্থানে। কয়েকজন এসে ডাকে, বুজি! বুজি!! কিন্তু সুজনের কথা সত্যি প্রমাণিত হয়, বুজি অন্য দিনের মতো আজকে আর সাড়া দেন না। প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে কবরের নিচ থেকে বুজির কথা বলতে পারাটা খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল একসময়, এখন তাকে প্রকৃতির নিয়ম মানতে দেখে সবার কাছে অস্বাভাবিক লাগতে থাকে। গুনগুন করে আলাপ চলতে থাকে সবার মাঝখানে, কিন্তু সরাসরি কেউ কোন শব্দ উচ্চারণ করল না। 
অন্যদিকে কবরের কাছে দাঁড়িয়ে বুজির চার ছেলে চোখাচোখি করে নিজেদের মাঝে। মায়ের অভিমান থেকে ভয়ে বা সংকোচে মুখ ফিরিয়ে থাকতে থাকতে তাঁদের হৃদয় মৃতপ্রায় হয়ে গেছে; তবু বুকের ভেতরে যে অপরাধবোধটা তারা লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন সাবধানে, সেটা হঠাৎ এই ঘটনায় শতগুণে বেড়ে গিয়ে মাথা চাড়া দেয়, একে আর এড়িয়ে যেতে পারে না পুত্রগণ। জায়েয নাজায়েয, পুলিশের ভয়, জমির অজুহাত এসব কিছু অদৃশ্য হয়ে যায় কর্তব্যের সামনে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় না তাঁদের। বড় ছেলে কাঁপা গলায় বলে, ''তোরা কোদাল নিয়া আয়। মা-রে আজকে বাইত্তে নিয়া যামু।''
মনে মনে এই কথাটারই যেন অপেক্ষা করছিল সবাই, মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎবেগে সব ব্যবস্থা হয়ে যায়। জোড়া কোদাল আসে, বড় আর মেঝ ছেলে খুঁড়তে শুরু করে। বাকিরাও কাজে লাগবার জন্যে তটস্থ হয়ে পড়ে। জানাযার খাট নিয়ে আসা হবে কিনা আলোচনা হয়। তাঁদের ইচ্ছা বুজিকে কষ্ট দেবে না, এতে শুইয়েই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। লিজাদের খালার একটা হুইল চেয়ার ছিল, তারা ভাবে সেটা বুজিকে দিয়ে আসবে। বয়স্ক মানুষ, তাঁর মধ্যে কবরে ছিলেন এত দিন, হাঁটতে চলতে নিশ্চয়ই কষ্ট হবে। দরকার হবে একটা হুইল চেয়ারের। বাকিরাও, ভাবে। যেন এতদিন বুজিকে ভুলে ছিল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, সেই পাপ আজকের ক্ষণিকের ভালবাসার স্রোতে কাটিয়ে নেবে। তাঁরা ভাবে আর তাকিয়ে থাকে বুজির দুই ছেলের দিকে। 
বড় ছেলে খোঁড়ে।মেঝ ছেলে খোঁড়ে। তারা কাত করে রাখা বাঁশ, তালাই এগুলোর কোন অস্তিত্ব পায় না। তারা খোঁড়ে।তারা কপাল থেকে ঘাম মুছে একটা শাদা কাফনের কাপড় খোঁজে।উঠে আসে মাটি, গুঁড়ো গুঁড়ো চাপ চাপ মাটি। সেখানে মোচড় খায়, কিলবিল করে ক্ষুদে পোকা, শূককীট। তারা খোঁড়ে, মাটি সরায়, বাইরে মাটির স্তুপ উঁচু হয় আরো। তারা দ্যাখে আর খোঁড়েখোঁড়ে আর দ্যাখে। মেঝ ছেলের কোপে খট করে আওয়াজ হয় হঠাৎ।সে দেখে, একটি খুলিতে গেঁথে গেছে কোদালের মাথা। কেউ খোঁড়ে না আর। সবাই দ্যাখে। 
দেখে তাদের বিশ্বাস হয় না। অজানা আতঙ্কে তাদের হৃদয় জমে যায় বুকের ভেতর। মুহূর্তের জন্যে সবার মনে হয় একটা সুপ্রাচীন দুঃস্বপ্ন টেনে নিচ্ছে তাদেরকে অতল কোন অভিশপ্ত গহ্বরে। সামনের দৃশ্যটা, মাটির বুকে বসে থাকা এই ক্ষয়ে-যাওয়া-খুলির অস্তিত্বটা তারা আর বিশ্বাস করতে পারে না। 
কিন্তু তারা জানে, বিশ্বাস পাল্টায়, বিশ্বাস ভঙ্গুর; কিন্তু সত্য, পরম সত্য, অপরিবর্তিত থাকে। এবং সত্য-ই হটিয়ে দিতে পারে আতঙ্ককে, দুঃস্বপ্নকে। তাই সেদিন রূপপুর গ্রামের সবাই চুপচাপ, সম্মিলিতভাবে একটি সত্য সৃষ্টি করলো- বুজি মরে গেছেন। তিনি মরে গেছেন বহু মাস আগে এক শুক্রবারের মরা-রোদ-জড়ানো বিকেলে। 
তারা পুরো ব্যাপারটিকে করোটি থেকে মুছে ফেলে সেখানে এই সত্যটি স্থাপন করে, তারপর দ্রুতপায়ে পালিয়ে যায় যার যার বাড়িতে। সেজ আর ছোট ছেলে তাঁদের বিহ্বল দুই ভাইকে কবর থেকে টেনে উঠিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ভরাট করে ফেলে গহ্বরটি, তারপর কাঁপা পায়ে পিছু ফিরে হাঁটা দেয়। দুটো কোদাল পড়ে থাকে গোরস্থানের এক পাশে, নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতন। তারা চারজন এরপরে প্রতি শুক্রবার সেখানে আসবে, এসে জিয়ারত করবে মায়ের কবর, তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করবে। মাতৃভক্ত সকল সন্তানেরা যেমনটা করে থাকে।
সুজন স্বয়ং ঠিক বুঝতে পারে না ওর কি করা উচিত। ও বাসায় এসে আম্মার কাছে অনেকক্ষণ বসে রয়, আম্মা যখন রান্না করছেন, তখনো তাঁর শাড়ির এক কোণা ধরে অথর্বের মতো বিড়বিড় করতে থাকে। রাতে ও কিছু মুখে তুলতে পারল না, প্লেটভর্তি ভাত হাতে ছেনে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠিক আট ঘণ্টা পরে ঘুম থেকে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে ছেলেটা, আগের মতই বাপের ঝাড়ি খাবে, মাঠে খেলবে, বড় হবে; এবং পরবর্তী জীবনে বুজিকে নিয়ে কখনো অস্বাভাবিক কিছু যে ঘটেছিল, সেটা কারুর মনে থাকবে না। 
সেদিন রাত্রে সুজনসহ গ্রামের সবাই একই স্বপ্ন দেখল - তারা একা একা ছ'ফিট মাটির নিচে শাদা কাফন জড়িয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে, মাটির নরম আলিঙ্গনে ভীষণ আরাম লাগছে, শরীরের প্রতিটি কোষে শান্তি আর শান্তি। শুধু একটাই খটকা, পাশে কোথাও একটা কণ্ঠ বলিষ্ঠ গলায় আবৃত্তি করে যাচ্ছে বারবার- হে মোমিনগণ, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করো, এবং সুবিচার দেখলে করো উৎসাহিত, কারণ নিশ্চয়ই পৃথিবী তোমাদের শস্যক্ষেত্র এবং কর্মফল তোমাদের শস্য। হে মোমিনগণ...
একঘেয়ে কণ্ঠটা প্রথমে সজোরে পুনরাবৃত্তি করতে থাকে কথাগুলো, তারপর ধীরে ধীরে আওয়াজ কমে আসতে শুরু করে, যেন গলার শক্তি কমে যাচ্ছে ক্রমশ। তারপর মৃদু কণ্ঠের গুণগুণ আওয়াজ শোনা যায় কেবল। চারপাশের মাটি পুরনো বিছানাসঙ্গীর মতো আরও কাছে সরে আসে, অন্ধকারে আনন্দময় আলস্য বাড়ে ক্যান্সারের মতো; তারপর একটা সময় নিখুঁত নিস্তব্ধতা নেমে আসে কবরের ভেতরে। 
এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সেদিন রাত্রে খুব ভাল ঘুম হলো রূপপুর গ্রামের সবার।

১৫।অনুবাদ গল্পঃ দ্যা স্ট্রীট দ্যাট গট মিসলেইড

মার্ক জিরনডিন সিটি হলের প্রকৌশলী বিভাগের নথি সংরক্ষণ সেকশনে এত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে যে পুরো শহরটা একটা মানচিত্রের মত তাঁর মনের ভিতরে ছিলো অধিশায়িত। শহরের প্রতিটা জায়গা, আনাচ-কানাচ, রাস্তাঘাট, কানা গলি আর চিপা গলি সবই ছিলো তাঁর মুখস্থ।
পুরো মন্ট্রিয়ালে শহর সম্পর্কিত এত জ্ঞান তাঁর মত আর কেউ রাখতো না। ডজন খানেক পুলিশ আর ট্যাক্সি চালক মিলেও এই বিষয়ে প্রতিযোগিতায় তাঁকে হারাতে পারেনি। ব্যপারটা এমন না যে সত্যিই সে শহরের প্রতিটা জায়গা চিনে, যদিও সে মন্ত্র পাঠের মত তাঁদের নাম গড়গড় করে বলে যেতে থাকে যেন সে সবকটি রাস্তায় নিজে হেঁটে বেড়িয়েছে। আসলে শুধুমাত্র তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে অবগত —কোথায় কোন জায়গায় কোন রাস্তা আছে, এক জায়গার সাথে আরেক জায়গার সম্পর্ক কি ইত্যাদি।
কিন্তু এইটুকু জ্ঞান এই বিষয়ে তাঁকে বিশেষজ্ঞ বানানোর জন্যে ছিলো যথেষ্ট। কেবিনেটের নথি সংরক্ষণের ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা ছিলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যেখানে অ্যাবোট থেকে যটিক পর্যন্ত সকল রাস্তার সমস্ত খুঁটিনাটি — রাস্তার সামনে, পিছনে, মাঝামাঝি— সকল তথ্য ছিলো নথিবদ্ধ । সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিরা, প্রকৌশলী, ইন্সপেক্টর, তাঁদের মত আরও অনেকেই তাড়াহুড়োর মধ্যে বিশেষ তথ্য বা খুঁটিনাটি উপাত্তের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তাঁরা হয়তো তাঁকে নিম্ন শ্রেণীর একজন কেরানী হিসেবে অবজ্ঞাই করতো কিন্তু উপায় নেই, অন্য সবার মত তাকেও তাঁদের সমভাবে দরকার।
কাজ-কর্মে উদ্দীপনার একটা বড় ধরনের ঘাটতি থাকলেও মার্ক তাঁর ওভেন স্ট্রীটের বাড়ি থেকে নিজের অফিসটাকেই বেশী পছন্দ করতো। ওভেন স্ট্রীটের ওখানে তাঁর প্রতিবেশীরা বড্ড হৈচৈ করে, মাঝে মাঝে মারামারিও করে আর বাড়িওয়ালীও তো নিরন্তর কোলাহলে মেতেই থাকে। একবার সে সাথের ভাড়াটিয়া লুইসকে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অর্থটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। লুইস যখন প্রাচিরের উপর উঠে বসলো, তখন তাঁর চেহারায় একটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক ভাব ফুটে উঠলো।
“সুতরাং ক্রেইগ গিয়ে ব্লেউরির খিড়কি খুলে ঢুকে এবং ব্লেউরি হয় পার্ক, তো এই নিয়ে মাথা ঘামায় কে? এত উত্তেজনার কি আছে?”
“সেটা আমি তোমাকে দেখাবো” বললো মার্ক, “তাঁর আগে আমায় বলো তুমি কোথায় বাস কর।”
“পাগল নাকি? কোথায় আবার? ওভেন স্ট্রীট। আর কোথায় হবে?”
“তুমি কি করে জানলে?”
“আমি কি করে জানলাম মানে? আমি এখানেই থাকি, থাকি না? আমি ভাড়া দেই, এখানেই আমার চিঠিপত্র আসে, আসে না?”
মার্ক আলতো ভাবে মাথা নাড়লো।
“যা যা বললে, এর কোনটাই প্রমাণ করে না যে তুমি এখানকার বাসিন্দা,” সে বললো। “তুমি যে এই ওভেন স্ট্রিটে থাকো এর একমাত্র প্রমাণ হলো সিটি হলের নথির কেবিনেটে এই কথাটা উল্লেখ আছে। পোস্ট অফিস তোমার কাছে চিঠি পাঠায় এর কারণ হলো আমার কার্ড ইনডেক্সে তোমার ঠিকানা লেখা আছে। যদি আমার নথিতে এসব লেখা না থাকতো, তাহলে তোমার হয়তো কোন অস্তিত্বই থাকতো না, এমনকি এই ওভেন সড়কেরও কোন অস্তিত্ব থাকতো না। বুঝেছ বন্ধু, এটাই হলো আমলা প্রশাসনের বিজয়।”
“এইসব কথা বাড়িওয়ালীকে গিয়ে বলার চেষ্টা করো,” বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে লুইস হেঁটে চলে গেলো।
অতএব মার্ক তাঁর অখ্যাত কর্মজীবনে দিনাতিপাত করতে থাকলো। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশতম জন্মদিন আসলো এবং চলেও গেল, কেউ লক্ষ্যই করলো না। দিনের পর দিন পার হতে থাকলো নিরস আর ঘটনা বিহীন। ওদিকে কোথাও কোন রাস্তার নাম পাল্টানো হয়েছে, নতুন আরেকটা নির্মিত হয়েছে, তৃতীয় কোনটা প্রশস্থ করা হয়েছে, এইসব তথ্য সতর্কতার সাথেই নথিবদ্ধ হচ্ছিলো।
তারপর এমন কিছু একটা ঘটলো যা তাঁকে হতবিহব্বল করে দিলো, সে মাত্রাহীন বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে গেলো, কেঁপে উঠলো পুরো কেবিনেটের লৌহ ভিত্তি।
অগাস্টের এক বিকেলে, ড্রয়ার খুলতে গিয়ে সে হাতে কিছু একটা অনুভব করলো। আরেকটু হাতিয়ে দেখতে পেলো ড্রয়ারের উপর-নিচে একটা কার্ড আটকে আছে। টেনে বের করে দেখলো জীর্ণ, মলিন একটা ইনডেক্স কার্ড। পুরনো হলেও কার্ডটা এখনো অর্থোদ্ধারযোগ্য। কার্ডের গায়ে লেখা ছিলো, “রুয়ে দে লা বউতলে ভারতে” অথবা “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”।
মার্ক বিস্ময়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো কার্ডটার দিকে। এরকম কোন বেখাপ্পা জায়গার নাম সে জীবনেও কোনদিন শোনেনি। নিঃসন্দেহে আধুনিক ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে এই জায়গার পুনরায় নামকরণ করা হয়েছে। সে রাস্তার নামের পুরো লিস্ট আর সব মাস্টার ফাইল এলোমেলো করে ঘেঁটে দেখতে লাগলো। কিন্তু এই জায়গার নাম কোথাও দেখতে পেলো না। সে আবারো সবকটি কেবিনেটে খুব সতর্কতার সাথে, আস্তে আস্তে খোঁজে দেখতে লাগলো। সেখানে এই নামের কিছু ছিলো না। একেবারেই কিচ্ছু না।
আরও একবার সে কার্ডটা পরখ করে দেখলো। কোন ভুল নেই সেখানে। সড়কটা সর্বশেষ নিয়ম মাফিক পরিদর্শিত হয়েছিলো ঠিক পনেরো বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিন আগে।
যখন ভয়ঙ্কর সত্যটা এসে ভর করলো তাঁর উপর, আতঙ্কে হাত থেকে সে কার্ডটা ছুড়ে ফেলে দিলো। ভঁয়ে ভঁয়ে কার্ডটাকে আবার ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিয়ে চকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। এটা ছিলো একটা হারিয়ে যাওয়া, বিস্মৃত সড়ক। সিটি হল থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে মন্ট্রিয়ালের কেন্দ্রে গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সড়কটা এখানেই ছিলো সেটা কেউই জানতো না। জলে পতিত একটা পাথরের টুকরোর মতই সড়কটা সবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলো।
হৃদয়ের গভীরে, মার্ক মাঝে মাঝেই এমন একটা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতো। শহরে অনেক অজ্ঞাত জায়গা ছিলো— আঁকাবাঁকা গলি আর মিশরীয় গোলকধাঁধার মত এলোমেলো পেঁচানো সব রাস্তাঘাট। কিন্তু এমন কোন জায়গা থাকার কথা না যার নাম তাঁর হাতের সর্বজ্ঞ নথিতে উল্ল্যেখ নেই। অথচ এই একটা সড়কের নাম সত্যিই এখানে নেই। ঘটনাটা যেন একটা বিস্ফোরক।
হতবুদ্ধিকর অবস্থায় মার্কের অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো, এখানে কাজ শুরু করার কিছুদিন পরেই কিভাবে তাঁর কেবিনেট অন্য তলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলো। পুরনো সব নথিগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নথি বানানো হয়েছিলো। অবশ্যই ঠিক সেই সময়ে “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”টা ড্রয়ারের চিপায় আটকা পড়েছিলো।
কার্ডটা পকেটে নিয়ে সে বাড়ি চলে গেলো। সেই রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলো না। ভয়ঙ্কর সব দৈত্যাকৃতি তাঁর স্বপ্নে এসে হানা দিলো। সে স্বপ্নে দেখলো তাঁর অফিস প্রধানের বিশাল একটা ছায়ামূর্তি প্রচণ্ড রাগের মাথায় তাঁকে একটা তপ্ত লাল বর্ণের নথির আলমারিতে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।
পরের দিন সে মনস্থির করে ফেললো। অসুস্থতার অজুহাতে বিকেলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুরু দুরু বুকে সে জায়গাটা খুঁজতে বেরিয়ে গেলো।
যদিও সে জায়গাটার অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালো ভাবেই অবগত ছিলো, তবুও সে দুই বার জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। বিমূঢ় হয়ে সে চোখ বন্ধ করলো। তাঁর মনে অধিশায়িত অব্যর্থ মানচিত্রটা অনুসরণ করে সে সরাসরি চলে গেলো প্রবেশদ্বারে। প্রবেশদ্বারটা এতই সরু ছিলো যে মার্ক তাঁর প্রসারিত হাত দিয়ে সংযুক্ত দেয়াল গুলোকে ছুতে পারছিলো। ফুটপাত থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা লম্বা, শক্ত কাঠের কাঠামো যার বেশীর ভাগ অংশই ছিলো জর্জরিত। কাঠামোটার মাঝখানে ছিলো একটা সাদামাটা খিড়কি ওয়ালা দরজা। দরজাটা ঠেলে সে ভিতরে ঢুকলো। তাঁর সামনে এখন শুয়ে আছে সেই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’।
জায়গাটা ছিলো একেবারেই জলজ্যান্ত। শান বাঁধানো ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তিনটে ছোট বাড়ি, সব মিলিয়ে বাড়ি ছিলো মোট ছয়টা। প্রতিটা বাড়ির সামনেই ছিলো একটা করে লোহার বেড়ায় ঘেরা ক্ষুদ্র বাগান। বাড়িগুলোকে মাত্রারিক্ত পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিলো আর তাঁদের গায়ে লেগে ছিলো যত্নের ছাপ। ফুটপাতের পাথর গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো সম্প্রতিই কেউ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। গুদাম ঘরের পুরনো জানালাহীন ইটের দেয়াল গুলো বাড়ি ছয়টাকে ঘিরে রেখেছিলো আর দেয়াল গুলো মিলিত হয়েছিলো রাস্তার ঠিক শেষ মাথাটায় গিয়ে।
প্রথম ঝলকেই মার্ক বুঝতে পারলো কিভাবে জায়গাটার এমন অস্বাভাবিক নামকরণ হয়েছে। গলিটা দেখতে ঠিক বোতলাকৃতিরই ছিলো।পাথর আর বাগানে প্রতিফলিত সূর্য কিরণ, মাথার উপরের নীল আকাশ এইসব কিছু নিয়ে গলিটা তাঁকে একটা ক্ষণস্থায়ী ভালো লাগা আর প্রশান্তিতে ডুবিয়ে রাখলো। পঞ্চাশ বছর আগের খোদাইকৃত এই দৃশ্যটা ছিলো পুরোপুরি মোহনীয়।
মার্কের হাতের ডান দিকের প্রথম বাড়িটার বাগানের গোলাপ গাছে একটা বয়স্ক মহিলা জলসেচন করছিলো। মহিলাটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলে মার্ক অনুমান করলো। মার্ককে দেখে মহিলাটা তাঁর দিকে নিস্পন্দ পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো, আর তাঁর হাতের কৌটা থেকে মাটিতে এলোমেলো ভাবে পানি পড়তে লাগলো। মার্ক তাঁর মাথার হ্যাট খুলে বললো, “আমি শহরের প্রকৌশলী বিভাগ থেকে এসেছি, ম্যাডাম।”
মহিলা নিজেকে সামলে নিয়ে তাঁর জলের কৌটা ঠিক করে নিচের দিকে তাক করলো।
“সুতরাং অবশেষে তুমি তাহলে এই জায়গার খোঁজ পেয়েছ।” সে বললো।
মহিলার এই কথা গুলো শুনে মার্কের মনে পুনর্জন্ম নেয়া তাঁর নির্দোষ, হাস্যকর ভুলের ধারণাটা দ্রুত বেগে পালিয়ে গেলো। সে কোন ভুল করেনি।
“দয়া করে আমায় সব খুলে বলুন,” মার্ক নিরাসক্ত গলায় বললো।
গল্পটা ছিলো বিস্ময়কর। অনেক বছর ধরে, মহিলা বললো, গ্রিন বোটল স্ট্রীটের ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতো। বাড়িওয়ালা এখানকারই কোন এক ছোট বাড়িতে থাকতো। ভাড়াটিয়াদের সাথে বাড়িওয়ালার সম্পর্কটা এতটাই গভীর হয়েছিলো যে মৃত্যুকালে সে তাঁদেরকে একটা ছোট অংকের টাকা সহ তাঁর সম্পদ লিখে দিয়ে গিয়েছিলো।
“আমরা আমাদের কর পরিশোধ করতাম,” মহিলাটা বললো, “আর ফরমের একটা পুঞ্জিকা বানিয়েছিলাম এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আমাদের সম্পদ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতাম। অতঃপর, কিছুদিন পর থেকে আমাদের কাছে ট্যাক্সের নোটিশ আসা বন্ধ হয়ে গেলো, আমরাও আর কোন কর পরিশোধ করলাম না। কেউ আর আমাদেরকে ঘাটালো না। অনেক দিন পর আমরা বুঝতে পারলাম যে কোন না কোনভাবে ট্যাক্সের লোকজন আমাদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।”
মার্ক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অবশ্য, গ্রিন বোটল স্ট্রীট যদি সিটি হলের দৃষ্টি সীমার বাইরে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কোন পরিদর্শক, আদমশুমারি পরিচালক, কর সংগ্রাহক সেখানে যাওয়ার কথা না। কেবিনেটের অব্যর্থ নথি সবাইকে সানন্দে বরং অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাবে।
“তারপর মাইকেল ফ্ল্যানাগান, যে কিনা চার নম্বর বাড়িটায় বাস করত,” মহিলা বলে যেতে থাকলো, “লোকটা বড়ই মজার মানুষ, তাঁর সাথে তোমার দেখা করা উচিত — মি. ফ্ল্যানাগান আমাদেরকে ডেকে বললো, ব্যাপারটা যদি কোন অলৌকিক ঘটনা হয়েই থাকে তাহলে আমাদের উচিত এটাকে সাহায্য করা, উৎসাহ দেয়া। ইনিই সেই লোক যে দরজাটা বানিয়ে প্রবেশ পথে বসিয়েছিলো, যেন কোন পথচারী অথবা অফিসিয়াল যখন তখন ভেতরে ঢুকতে না পারে। আমরা সবসময় দরজাটা তালা মেরে রাখতাম, কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল কেউ আর এদিকে আসে না। তাই আমরা আর এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না, এখন দরজাটা খোলাই থাকে।”
“ওহ, আরও অনেক ছোট ছোট জিনিস ছিলো যা আমাদেরকে করতে হতো, যেমন পোস্ট অফিস থেকে আমাদের চিঠি পত্র নিয়ে আসা। কারণ আমাদের দরজায় কখনই কেউ কিছু দিয়ে যেত না। এখন শুধুমাত্র খাবার আর কাপড় কেনা ছাড়া বাইরের জগতে যাওয়া আর কোন কারণ আমাদের নেই।”
“আর এতদিনে এখানে আর কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটেনি?” মার্ক জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ, এর মধ্যে আমাদের দু’জন স্বজন মারা গেছে এবং তাঁদের ঘর গুলো কিছুদিনের জন্যে খালি পড়ে ছিলো। তারপর ছয় নম্বর বাড়িতে বাস করা জিন ডেসেলিন মাঝে মাঝে শহরে যায়। একদিন সে মি. প্লন্সকাই নামের একজন শরণার্থী সাথে নিয়ে ফিরলো। ভ্রমণ করে মি. প্লন্সকাই ছিলো বড্ড ক্লান্ত আর জরাগ্রস্ত, সে সানন্দেই আমাদের সাথে থেকে গেলো। তিন নম্বর বাড়িতে বাস করা মিস হান্টার একদিন এক দূরবর্তী আত্মীয়কে নিয়ে আসলো। মানুষটা বড় ভালো লোক বলেই আমার মনে হয়। তাঁরা দুজনেই আমাদের সার্বিক অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারে।”
“এবং আপনি, ম্যাডাম?” মার্ক জানতে চাইলো।
“আমার নাম সারা ত্রুসডেল। আমি এখানে বিশ বছর ধরে বাস করে আসছি। জীবনের শেষ দিন গুলি আমি এখানেই কাটাতে চাই।”মহিলা মার্কের দিকে তাকিয়ে একটা সন্তোষজনক মুচকি হাসি দিলো। আপাতভাবে সে মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল যে মার্কের পকেটে এমন একটা গ্রেনেড রয়েছে যা তাঁদের এই সুন্দর ছোট্ট প্রশান্তির জগতটাকে উড়িয়ে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে।
এই যে গ্রিন বোটল স্ট্রীট, এই আশ্রয় খানায় নিজেদের খুঁজে পাওয়ার আগে এদের সবার জীবনই জর্জরিত ছিলো সমস্যায়, জটিলতায় আর ব্যর্থতায়। নিজের শোচনীয় অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে মার্কের মনেও এখানে এসে বাস করার ইচ্ছাটা জেগে উঠলো। সে আনমনেই পকেটে আঙুল ঢুকিয়ে কার্ডটা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। “মি. প্লন্সকাই আর মি. ফ্ল্যানাগান দুজনের ভিতরে খুব ভাব জমেছে।” মিস ত্রুসডেল বললো, “তাঁরা দুজনই ছিলো ভ্রমণকারী, তাই ভ্রমণ কালীন স্মৃতি নিয়ে কথা বলতেই তাঁরা ভালোবাসে। মিস হান্টার পিয়ানো বাজাতে পারে আর মাঝে মাঝেই আমদেরকে নিয়ে কনসার্ট করে। তারপর আছে মি. হ্যাযার্ড আর মি. ডেসেলিন, দাবা খেলা তাঁদের খুব প্রিয়। তাঁরা আমাদের জন্য চোলাই মদ বানায়। আর আমার কথা বলতে গেলে বলা যায়, আমি আছি আমার ফুল গাছ আর বই নিয়ে। মোট কথা এখানে আমারা সবাই মিলে বেশ ভালোই আছি।”
মার্ক আর মিস ত্রুসডেল দীর্ঘক্ষণ নীরবে বসে রইলো। আকাশের নীল রঙটা ধীরে কালো হয়ে আসলো, গোলাঘরের বাঁ দিকের দেয়ালের পেছনে সূর্যটা হারিয়ে গেলো।
“তোমাকে দেখে আমার ভাতিজার কথা মনে পড়ছে,” মিস ত্রুসডেল হঠাৎ কথা বলে উঠলো, “ছেলেটা বড় ভালো ছিলো। যুদ্ধের পরে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে ছেলেটা যখন মারা গেল, তখন আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিলো। তুমি জানো, আমিই আমার বংশের শেষ ব্যক্তি।”
মার্ক মনে করতে পারলো না শেষ কবে সে এমন সুন্দর বন্ধু সুলভ কথা বার্তা কারো সাথে বলেছে। এই বৃদ্ধ মহিলাটার জন্যে তাঁর হৃদপিণ্ডটা উষ্ণ হয়ে উঠলো। একটা মহৎ নৈতিকতা আবিষ্কারের অস্পষ্ট একটা অনুভূতি তাঁর উপর এসে ভর করলো। পকেট থেকে সে কার্ডটা বের করলো।
“নথির আলমারিতে গতকালকে আমি এই কার্ডটা পেয়েছি,” মার্ক বললো। “এই সম্পর্কে এখনো কেউ কিছু জানে না। জানাজানি হলে বড় ধরনের একটা কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে আর পাশাপাশি আপনাদের সমস্যারও আর শেষ থাকবে না। পত্রিকার রিপোর্টার, কর সংগ্রাহক.........”
মার্কের বাড়িওয়ালীর কথা আবার মনে পড়লো, মনে পড়লো তাঁর ঝগড়াটে প্রতিবেশীদের কথা, তাঁর ঘরটার কথা। সে আস্তে করে বললো, “আমি ভাবছি, আমি একজন ভালো ভাড়াটিয়া এবং আমি ভাবছি......”
“ওহ, হ্যাঁ,” মহিলাটা সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে বললো, “আমার বাড়ির উপরের তলায় তুমি থাকতে পারবে। আমার এখানে এত জায়গা পড়ে আছে তা দিয়ে আমি কি করবো আমি নিজেই জানিনা। আমি নিশ্চিত জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। তুমি এখনি এসে দেখে যাও।”
নথির কেরানী মার্ক জিরনডিন মনস্থির করে ফেললো সে এখানেই থেকে যাবে। পরিত্যাগের ভঙ্গিতে কার্ডটাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জলের কৌটার মধ্যে ফেলে দিলো। তারপর যতটুকু তাঁর মনে হলো, এই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’ এর কথা আর কেউ কক্ষনো জানবে না, জায়গাটা বিস্মৃতই থেকে যাবে, অনন্তকাল।

১৬।গল্পঃ সুপ্তির বিয়ে

এক ----
বিয়ে যে করতে হবে, এই ভাবনাটা অনেক দিন আমার মাথায় আসেই নি । এর পেছনে অবশ্য যুক্তি যুক্ত কারণও ছিল । এখনও জেরিনের কথা গুলো আমার কানে খুব পরিস্কার ভাবেই বাজে । মনে না করতে চাইলেও মাঝে মাঝে সেগুলো সুচালো তীরের মতই বুকের ভেতরে বিঁধে । অবশ্য আমি জেরিনকে দোষ দিতে পারি না । মেয়েটার কোন কিছু করারও ছিল না । চুপচাপ দেখা ছাড়া আর কিছু করারও ছিল না । 
শান্ত কন্ঠেই জেরিন আমর দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুটা সময় । ওর এই চেহারাটা আমি খুব ভাল করেই চিনতাম । কঠিন কিছু বলার আগে ও এমন করে তাকিয়ে থাকে । মনে মনে ঠিক করে নেয় কি বলবে । আরও কিছু সমু চুপ থাকার পরে জেরিন বলল-বাবা রাজি হচ্ছেন না !আমি জানতাম জেরিনের বাবা কোন দিনও রাজি হবে না । জেরিন আবার বলল-তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেন রাজি হচ্ছে না । কোন মেয়ের বাবাই চাইবে না তার মেয়ে একটা শূন্য ঘরে যাক । তার উপর তোমার অবস্থা এমন ভাল না যে আমি সাহস করে চলে আসবো । 
আমার অবস্থা বলতে জেরিন আমার আর্থিক অবস্থাকে বোঝাচ্ছে । সবে মাত্র একটা চাকরিতে ঢুকেছি তখন । বেতন খুব একটা ভাল না । নিজের চলে যায় ভাল ভাবে কিন্তু বউ নিয়ে চলার মত নয় । জেরিন বলল-আগামী সপ্তাহে ওরা আমাকে দেখতে আসবে ! আজকেই .....
লাইনটা শেষ করলো না জেরিন । আমি জানতাম ও কি বলতে এসেছিলো । সেদিনই আমাদের শেষ দেখা ছিল । এরপর আর ওর সাথে আমার দেখা হয় নি । শুনেছিলাম বিয়ে হয়েছে খুব ভাল জায়গায় । তারপর থেকেই আমি একা একা সামনের দিকে যাচ্ছি । সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করি । দুইদিন ঘুমাই আর বই পড়ি । অন্য কিছু মাথার ভেতরে আনি না । বেশ ভালই ছিলাম কিন্তু মাঝখান দিয়ে রফিক মামা আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলেন । 
আসলে আমার আত্মীয়ের ভেতরে কেবল এই মামাকেই আমি চিনি কিংবা কেবল ইনার সাথেই আমার যোগাযোগ আছে । ঢাকাতে আমার অভিভাবকও এই মামাই । মায়ের যদিও আপন ভাই নয় তবুও এক মাত্র জীবিত আত্মীয় বলতে এই রফিক মামাই আমার আছে । বাবা মা তো মারা গেছে সেই কবে । দাদা কিংবা নানার দিক থেকেও কেউ আর বেঁচে নেই । কিংবা থাকলেও আমি চিনি না তাদের তারাও আমাকে চেনার দরকার মনে করে না । বেশি চিনলেই ঝামেলা । এই রফিক মামাই আমাকে ঝামেলা মনে করেও একটু একটু চেনে । যদিও আমি তাকে খুব একটা ঝামেলাতে কোন দিন ফেলি নাই । 
মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল-বিয়ে করতে হবে না ?আমি টেবিলে বসে ভাত মাখাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে মামার বাসায় আমার দাওয়াত থাকে । মাসের ভেতরে দু এক দিন । অথবা বিশেষ কোন দরকার পড়লে মামা কিংবা মামি আমাকে ডেকে পাঠায় । আজকের বিশেষ দরকার তাহলে আমার বিয়ে । মামাকে বললাম-যা বেতন পাই এই টাকা দিয়ে বউ পালা যাবে না । 
টেবিলে মামী নেই । আমি আর মামা একা খেতে বসেছি । মামা বলল-সেটা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না । মেয়ের বেশ টাকা পয়সা আছে । ঢাকায় ফ্ল্যাট আসে একটা । সেই ফ্ল্যাটে থাকবি দুজন আর তোর চাকরির বেতন দিয়ে সংসার চলবে । ব্যস !
আমার মাথায় ঠিক ঢুকলো না যে মেয়ের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে সেই মেয়ে আমাকে কেন বিয়ে করবে । কোন দুঃখে ?মামা বলল-আসলে মেয়েরও তোর মত কেউ নেই । বাবা মা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে । মেয়েটা একাই থাকে । মেয়ের বাবার এক বন্ধু বলল আমাকে । আমাদের অফিসের এক কলিগের মাধ্যমে জানতে পারলাম । তুইও একা জেনে সেই আগ্রহ দেখালো । বলল যে দুজনের যখন কেউ নেই তাহলে একে অন্যের দুঃখটা বুঝতে পারবে । 
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । কিন্তু তবুও কেমন জানি লাগছিলো । আমার কাছে কেবল মনে হল মামা যেন কিছু যেন এখনও বলে নি আমাকে । মামার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম । আমি মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । মামা খানিকটা ইতস্তত করে বলল-মেয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল । স্বামীটা ভাল ছিল না । একদিনও সংসার করতা পারে নি । আসলে মেয়ের ফ্ল্যাটের পেছনে পড়েছিল স্বামীটা । মেয়েটা প্রথমেই দিতে রাজি হয় নি । 
হুম । এইবার বুঝতে পারলাম আমাকে কেন এতো পছন্দ হল তাদের । পাত্র হিসাবে আমি কোন কালেই কারো প্রথম চয়েজ হতে পারি না । না আমার পরিবার আছে, না আমি অনেক টাকার মালিক ! এমন ছেলেদের জন্য মানুষের কেবল মায়া কিংবা করুনাই জন্মে, ভালবাসা নয় । জীবন সঙ্গী হিসাবে কোন মেয়েই এমন ছেলেদের কে আশা করে না । 
একবার মনে হল মামাকে বলি যে আমি ঝামেলায় যাবো না তারপর কি যেন মনে বললাম -আচ্ছা আপনি যা ভাল মনে করেন । 
আমার উত্তর শুনে মামা খুশি হলেন । মেয়ের মোবাইল নাম্বার আমাকে দিয়ে বললেন-আমি জানতাম তুই রাজি হবি । আমি কথা বলেই রেখেছি । কাল মেয়ের সাথে দেখা করে আয় । কি বলিশ ! -আচ্ছা ! 
----দুই-----
বসুন্ধরার আট তলায় দাড়িয়ে আছি । আমার থেকে একটু দুরে মেয়েটা বসে আছে । বুঝতেই পারছি আমার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আমার কেন জানি সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না । তার প্রধান কারন হচ্ছে মেয়েটা দেখতে অন্য রকম সুন্দর । কি রকম সুন্দর আমি বলতে পারবো না তবে একম কাউকে আমি বহুদিন দেখি নি । আমি চোখ ফেরাতে পারছি না । আসে পাশের অনেকেই দেখি মেয়েটার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে । মেয়েটার ভাব দেখেই মনে হচ্ছে আসে পাশের মানুষের এমন আচরনে মেয়েটা অভ্যস্ত । তাই তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । আমার তবুও মনের ভেতর থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না । ছবিতে মেয়েটাকে কম সুন্দরী লাগছিলো । বাস্তবে আরও বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে । এই মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না । 
আমি আরেকটু সামনে গিয়ে ফোন বের করে ফোন দিলাম আরও ভাল করে নিশ্চিত হওয়ার জন্য । দেখলাম মেয়েটার ফোন বেজে উঠলো । আমার নাম্বার আগেই ছিল মেয়েটার কাছে । স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো আর আমার দেখতে পেল । দুজনের চোখাচোখী হল । 
আমি অনুভব করলাম যে আমার পা খানিকটা কাঁপছে । কেন কাঁপছে আমি ঠিক জানি না । না ঠিক পা নয়, আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছে । কিছু একটা হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি । আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম । 
বাসা থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম যে এই মেয়ে এখন বিয়ে করবো না । দেখা করবো । মামাকে খুশি করার তারপর মেয়েটার সাথে কথা বলে তাকে বলবো সে বিয়ে করার আমার কোন ইচ্ছে নেই । আমি এই ঝামেলার ভেতরে যেতে চাই না । কিন্তু মেয়েটাকে দেখার পরে আমার মনে আর কিছুই রইলো না । আমার কেবলই মনে হল জেরিন আমাকে বিয়ে করে নি ভালই করেছে তাহলে হয়তো এই মেয়েটার সাথে আমার দেখাই হত না । 
আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম ।বললাম-দেরি হয়ে গেল ?-না । সমস্যা নেই । আমি মাত্রই এলাম ! আমি বসতে বসতে বললাম-আমার নাম তো আপনি জানেনই তাই না ?মেয়েটা বলল-আমি আপনার ব্যাপারে সব কিছুই জানি । আপনি জানেন তো ?-হ্যা ! মামা বলেছে ।-কি কি বলেছে ?
আমি বলতে লাগলাম কি কি বলেছে । কথা বলার মাঝ খানে একটা সময়ে মনে হল আমি যেন একটু দ্রুত কথা বলছি । আসলে নিজের কাছেই একটু একটু বেশি উত্তেজিত মনে হল । মেয়েটা একটু হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর মেয়েটা বলল-একটু আস্তে বলেন । আমি তো কলেজের টিচার না । আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি স্যারের কাছে পড়া দিচ্ছে । -আসলে ......।
আসলে কি ? সত্যিই তো ! কেবল চেহারা দেখেই আমি কাত হয়ে গেলাম । এটা ঠিক হচ্ছে না । নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু কেন জানি মনে শুনলো না কথাটা । 
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ছিলাম সুপ্তির সাথে । সুপ্তি মানে যার সাথে আমি কথা বলছি । মামা অবশ্য ফারজানা আহমেদ বলেছিলো । ওটা ফরনাম নেইম । ডাকনাম সুপ্তি । আহ কি চমৎকার নাম ! যাই হোক দুই ঘন্টা কোন দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না । সন্ধ্যা বেলা ওকে একদম ওর বাসা পর্যন্তই এগিয়ে এলাম । আসলে আমি ওর সাথে রিক্সায় চড়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিলাম তাছাড়া সুপ্তির বাসাটাও চিনে আসা দরকার । 
রিক্সা থেকে নামতে নামতে বললাম-আবার কবে দেখা হবে ?-কবে আপনি চান ? এখনও তো সিদ্ধান্তই জানালেন না । বাসায় গিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন । এতো বড় সিদ্ধান্ত একটু ভেবে চিন্তে নেওয়া ভাল । 
আমি রিক্সা নিয়ে ফেরৎ আসার সময় যত কয়েকবার ফিরে তাকালাম দেখলাম সুপ্তি গেটের কাছেই দাড়িয়ে আছে । চোখের আড়াল হতেই আমার কি হল আমি ফোন বের করে সুপ্তিকে ফোন দিলাম ।-হ্যালো !
আমি কোন ভূমিকা না করে বললাম-আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে ?সুপ্তি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল-আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে ?-কি মনে হচ্ছে ?-এতো জলদি এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না । আপনি কিন্তু আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না । -যা জেনেছি ওটুকুই ঠিক আছে ।ওপাশ থেকে দীর্ঘ নিরবতা । তারপর সুপ্তি বলল-এমন কিছু বিষয় আছে যা জানলে হয়তো আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না । একটু সময় নিন । 
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । এমন কি বিষয় থাকতে পারে ! ওর যেমন কেউ নেই আমার কেউ নেই । আর ওর যে ডিভোর্স হয়েছে এটা তো ও আমার কাছ থেকে লুকায় নি । এর থেকে বড় আর কি পারে ! থাকুক ! আমার কিছু যায় আসে না । আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম । এই সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম । 
-----তিন -----
আমি মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম বোকার মত । মনে হচ্ছিলো যেন মামা অন্য কোন ভাষায় কথা বলছে । আমি কেবল তার মুখ নাড়ানো দেখছি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না । মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল-ঐ মেয়েকে বিয়ে করার দরকার নেই । মেয়ের এতো সমস্যা থাকলে তো সেটা মেনে নেওয়া যায় না, তাই না ? আমি ওদের কে ফোন করে মানা করে দিচ্ছি ! ঐ মেয়ের সাথে আর যোগাযোগ করার দরকার নেই । 
আমি মামার বাসা থেকে বের হয়ে কোন দিকে যাবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমার বাসার দিকে যাওয়া যায় আবার সুপ্তির বাসার দিকেও । কিন্তু ওর বাসায় গিয়ে কি বলবো ? বলবো যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না । তুমি আমাকে এসব কেন বল নি ! এসব তো আমাকে বলা উচিৎ ছিল । ও তো আমাকে বলেই ছিল যে এমন কিছু আছে যা জানলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাইবো না । আগে অনেকেই চায় নি হয়তো । 
আমি যাবো কি না ওদিকে এই কথা ভাবতে না ভাবতেই সুপ্তির ফোন এসে হাজির হল আমার ফোনে । একবার মনে হল সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলে যাই । একবার এড়িয়ে চললেই মেয়েটা বুঝে যাবে সব কিন্তু কেন জানি মন সায় দিলো না । ফোন রিসিভ করলাম । 
ওপাশ থেকে হ্যালোর শব্দ এল না । কিছু সময় নিরবতা । আমিও চুপ করে রইলাম । আরও কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরে সুপ্তি বলল-কথা বলবা না ?-তুমি তো কিছু বলছো না !আরও কিছু সময় নিরবতা । তারপর সুপ্তি বলল-তোমার মামা একটু আগে ফোন দিয়েছিলো । বিয়ে টা হচ্ছে না বলে দিয়েছে ।-হুম ! আমি জানি । তারপর আবারও দুজন কথা হারিয়ে ফেললাম । আমার কেন জানি নিজের কাছে খুব ছোট মনে হল । কেবল মনে হল আমি সুপ্তিকে এমন একটা কাজের জন্য দোষারোপ করছি যেটা ও করেই নি । ঠিক ওর আগের স্বামী সব জানার পরেই ওর সাথে থাকতে চায় নি ঠিক তেমনি টাই আমি আচরন করছি । 
সুপ্তির বিয়ের দিন ওর স্বামী সব কিছু জানতে পারে । বাসররাতে ওর সাথে একটা কথাও বলে নি । মেয়েটা অনেক কান্না কাটি করেছে কিন্তু ওর স্বামী সেটা শোনে নি । সকাল বেলা বাসা থেকে চলে যেতে বলেছে । সুপ্তি আমাকে সম্পর্ণ টুকু বলেনি । অর্ধেক কথা বলেছিলো । আরও একটা ঘটনা যে ছিল সেটা আমি আজকে মামার কাছ থেকে শুনলাম । এবং মনে হচ্ছিলো মেয়েটা আমাকে কেন বলল না আগে ! অবশ্যই বলা উচিৎ ছিল । 
ফোনের ওপাশ থেকে সুপ্তি বলল-আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম । বিশ্বাস কর চেয়েছিলাম । কিন্তু পারি নি । কেন যেন কোথায় একটা বাঁধা ছিল । তুমি যখন ঐদিন আমার বাসায় এসে হাজির হলে কি পরিমান যে ভাল লেগেছিল তোমাকে, আমি আশা করেছিলাম তারপর তুমি যখন এলে.... অনেক দিন ... অনেক দিন পর নিজেকে একটু মানুষ মনে হচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো যে আমাকে .....
লাইণটা শেষ না করে আবারও চুপ করে রইলো সুপ্তি । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । সত্যি সত্যি প্রথম দেখার পরে সুপ্তির কথা আমি মন থেকে বেরই করতে পারছিলাম না । ঘুরে ফিরে কেবল ওর কথাই মনে হচ্ছিলো । আমি পরদিন অফিস ছুটির পরেই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হই । কোন ফোন না দিয়েই । দরজা খুলে আমাকে দেখে সুপ্তি বেশ খুশি হল মনে হল । চেহারায় একটা সপ্রতিভ ভাব দেখতে পাচ্ছিলাম । আমি লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম-এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম যে আপনার সাথে আরেকবার দেখা করে যাই ।সুপ্তি একটু সেহে বলল-আপনার অফিস এদিকে ?-হ্যা ! এদিকেই তো । এই তো কাওরানবাজার ! 
আমার কথা শুনে সুপ্তি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো । কাওরান বাজার এই বাসা থেকে অনেক দুরে । আমার বাসার ঠিক উল্টো দিকে । অবশ্য মামার বাসা একটু কাছেই । আমি তখনও দরজাতেই দাড়িয়ে । একটু অস্বস্থি যে লাগছিলো না বলবো না তবে ভাল লাগছি বেশ । সুপ্তি হাসি থামিয়ে বলল-আসুন । ভেতরে আসুন । বাধরুম ডান দিকে । আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি ! আমি ঘরের ঢুকতে ঢুকতে বললাম-না না । আমি কিছু খাবো না । কেবল কিছু সময় থেকেই চলে যাবো । -বুঝতে পারছি আপনি এখানে খেতে আসেন নি । কিন্তু আমি আমার বাসায় আসা সবাইকেই আপ্যায়ন করতে ভালবাসি । আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন, প্লিজ !
হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হয়ে গেলাম । অনেক আয়োজন । এবং সব থেকে বড় কথা সেগুলো একটাও ঠান্ডা নয় । মনে হচ্ছে একটু আগেই রান্না করা হয়েছে । আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । আমাকে তরকারির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুপ্তি বলল-আসলে .....-আসলে কি ?-আসলে আমার সকাল থেকেই কেন জানি মনে হচ্ছিলো আপনি আসবেন । তাই নিজ থেকে কিছু রান্না করেছি । রান্না এখনও শেষ হয় নি । এখনও ডাল রান্না হচ্ছে । আপনি খেতে খেতে হয়ে যাবে !
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । মনে হল মেয়েটাকে তক্ষুনি কাজী অফিসে নিয়ে যাই । আর পর তিন কবুল বলে ফেলি ! আমি আপাতট কাজী অফিসের দিকে না গিয়ে টেবিলে বসে পরলাম । খাওয়ার সময় সুপ্তি আমার পাশেই বসে ছিল । কি পরিমান ভাল লাগছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না । বারবাই কেবল মনে হতে লাগলো এবার থেকে আমাকে আর একা একা হোটেলে হোটেলে ভাত খেতে হবে না । অন্তত খাওয়ার সময়ে আমার আপন কেউ বসে থাকবে আমার কাছে ।-জানেন আমি যখন হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি তখন কেন জানি বাসার কথা মনে হয় খুব । একা একা খেতে কেমন একটা কষ্ট হয় । আমার যে এই দুনিয়াতে কেউ নেই সেটা পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারি এই খাওয়ার সময় ! 
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে । আমার কষ্ট টা মেয়েটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে । সুপ্তি বলল-এবার থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে এদিক দিয়ে যাবেন । কেমন ! দুজন মিলে এক সাথে রাতের খাবার খাওয়া যাবে । আমিও খানিকটা ক্লান্ত হয়ে গেছি একা একা খেতে ।-আচ্ছা ! 
তারপর থেকে প্রত্যেকটা দিন আমি সুপ্তির বাসায় গিয়েছি । ওর সাথে অফিসের পর ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছি। বেড়াতে গেছি । কত কথা বলেছি । আর আজকে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি ! 
ফোনের ওপাশে তখনও সুপ্তির কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমি । সুপ্তি কান্না থামিয়ে বলল-এটাই কি আমাদের শেষ কথা ?-কি বললে ?-বললাম এর পরে আর কথা হবে না আমাদের ?-তুমি কি চাও ?-আমি কি চাই তুমি জানো না ? আমি তোমার কাছে লুকিয়েছি তোমাকে হারানোর ভয়ে । কিন্তু জানতাম একদিন তুমি ঠিক ঠিক জানতে পারবে । সেদিন হয়তো তোমাকে হারাতে হবে । সেদিন ....।আমি বললাম-তুমি কি বাসায় ?
কিছু সময় কোন কথা বলল না ও । তারপর বলল-হ্যা ! কেন ?-দরজা খোল । মামার বাসা থেকে না খেয়ে বের হয়েছি । -মানে ......-দরজা খোল !
সুপ্তির সাথে কথা বলতে বলতে আমি কখন যে ওর বাসার সামনে চলে এসেছি আমি নিজেই জানি না । দরজার সামনে দাড়িয়ে বেল চাপতে গেলাম তার আগেই দরজা খুলে গেল । কান্না ভেজা চোখ নিয়ে সুপ্তি দাড়িয়ে । কানে ফোন লাগানো । আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে । চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । 
আমি ভেতরে ঢুকবো কি ও নিজে বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো । ছোট বাচ্চাদের কোন জিনিস হারিয়ে যাওয়ার পরে যখন ফিরে পায় তখন যেমন করে সুপ্তির আচরনও আমার কাছে তেমন মনে হল । আমি বললাম-আজকে কি রান্না হয়েছে ?
আমার বুক থেকে মানা না উঠিয়েই সুপ্তি বলল-এখনও কিছু রান্না করি নি । -রান্না হবে না ? -হবে ।-আজকে আমি কি ঠিক করেছি জানো ?-কি ?-ঠিক করেছি যে আজকে আমি আমার বউয়ের হাতে রান্না খাবো ! বুঝেছো । এেকবারে রেজিস্ট্রি করা বউয়ের হাতে রান্না !
সুপ্তি আমার ছেড়ে দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো তারপর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো । ওর চোখ দিয়ে তখনও পানি বের হচ্ছে । ঠিক যেন বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না যে আমি ওকে আজকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি ! কান্না ভেজা কন্ঠে বলল -কিন্তু তোমার মামা যে ....-আরে মামাকে গুল্লি মারো ! মামা তো আর বিয়ে করবে না । আমি করবো । তারপর হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম-তোমাকেই বিয়ে করবো । রাজি তো ?
(সমাপ্ত) 

(কারনটা অজানাই থাক কেন সুপ্তির বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো)

১৭।গল্পঃ বিষণ্ণ মীরা কিংবা আমি....

-আমি সাহায্য করবো ?
মেয়েটি একটু যেন চমকে উঠলো । একবার আমার দিকে তাকালো । তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিচে আবার নিচে পড়ে থাকা ব্যাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! আমি আবার বলে উঠলাম -কখন থেকে দেখছি বারবার ব্যাগ গুলো পড়ে যাচ্ছি । আমি সাহায্য করি ?
মেয়েটি একটু হাসলো । তবে হাসিটা জোর করে ফোটানো । আমার কেন জানি মনে হল আজকে মেয়েটার অসম্ভব মন খারাপ । আমি আর অনুমুতি তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে গেলাম । তারপর পড়ে থাকা কয়েকটা ব্যাগ তুলে নিলাম আমার হাতে । 
মেয়েটাকে আমি বেশ কিছু সময় ধরেই লক্ষ্য করছি । বসুন্ধরাতে আসলেই আমি এমনটা করি । আসে পাসের মানুষ গুলোকে দেখি । কোন কাজ নিয়ে আমি এখানে আসি না । আসি সময় কাটাতে । আজকে অবশ্য এসেছিলাম মুভি দেখতে কিন্তু সেটা শুরু হতে আরও বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে । তাই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম । দুই হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হাটছে এদিক ওদিক । ব্যাগ গুলো ঠিক মত সামলাতে পারছে না । 
অবশ্য মেয়েটাকে লক্ষ্য করার আরেকটা কারন হচ্ছে মেয়েটা সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে আছে । শুভ্র একটা সৌন্দর্য মেয়েটার সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে । আমার চোখটা তাই মেয়েটার দিকে বার বার ফোরে যাচ্ছিলো । 
আমি ব্যাগ গুলো হাতে নিলেও মেয়েটা কোন বাধা দিলো না । আমার চেহারায় সব সময়ই একটা ভাল ভাল মানুষ ছাপ আছে । মানুস খুব আমাকে প্রথম দেখাতে খারাপ মনে করে না । মেয়েটাও হয়তো তাই করছে । আমি বললাম -আপনি এখন কোন দিকে যাবেন না ? নিচে নাকি উপরে ?-উপরে ! ক্ষুধা লেগেছে ।
মেয়েটা এমন কন্ঠে ক্ষুধা লেগেছে কথাটা বলল যেন ক্ষুধা লাগাটা কোন অপরাধ কিংবা এবং সে এখন এই অপরাধ টা করে লজ্জিত । আমি মেয়েটার কথা বলার ধরন দেখেই হেসে ফেললাম । বললাম -আচ্ছা চলুন । আপনাকে আট তলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি । 
মেয়েটা কোন কথা না বলে আমার সাথে সাথে হাটতে লাগলো । আমি আটতলায় ক্যাপ্রিকর্নে মেয়েটাকে পৌছে দিয়ে যখনই ফেরৎ আসতে যাবো তখনই মেয়েটা বলল-আপনি কিছু খাবেন ?-আমার এখন এতো ক্ষুধা লাগে নি । আমি মুভি দেখে তারপর কিছু খাবো ভাবছি ।-কি মুভি দেখবেন ?-যেটা চলছে । ক্যাপ্টেন আম্রিকা !আমার বলার ধরন দেখে মেয়েটা হেসে ফেলল । আবারও সেই বিষণ্ণ হাসি ! নাহ একটা কিছু করতে হবে দেখছি । মেয়েটার বিষণ্ণতার কারনটা শুনতে হবে । তাহলে হয়তো একটু হালকা হতে পারবে । আমি বললাম
-তবে ....মেয়েটি আচ্ছা বলে নিচের দিকে তাকাতে যাচ্ছিলো আমার তবে শুনে আবার আমার দিকে ফিরে চাইলো । বলল-তবে ?-তবে কিছু অবশ্য এখন খাওয়া যায় যদি একটা শর্ত মানেন !-কি শর্ত ! -এখানে খাওয়ার পরে আমার সাথে মুভি দেখতে হবে !
মেয়েটা সত্যি একটু অবাক হল । প্রথম দর্শনে কোন মেয়েকে এভাবে প্রস্তাব দেওয়াটা কোন ভাবেই যুক্ত দেখায় না কিন্তু মেয়েটা মন কোন কারনে অসম্ভব খারাপ । আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা স্বাভাবিক আচরন করছে না এই কারনে । কোন স্বভাবিক মানুষ এক সাথে এতো শপিংও করতে পারে না । হাতে নেওয়ার সময়ে দেখি সেখানে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যে গুলো মানুষের একটার বেশি দরকারই পরে না । মেয়েটা সেখানে তিন চারটা কিনেছে । আমি নিশ্চিত মেয়েটা এগুলো ব্যবহারও করবে না । একেবারে প্রয়োজন ছাড়া কেনা কাটা । অস্বাভাবিক আচরন ! 
মেয়েটা বলল -আচ্ছা । আগে খাওয়া শেষ করি । তারপর দেখা যাবে ! 
আমি হাসলাম কেবল । 
খেতে বসতে বসতেই প্রথমে আমি নিজের নাম বললাম । মেয়েটা নিজের নাম বলল মীরা চৌধুরী । তারপর টুকটাক কথা বলতে লাগলো । তবে খুব আস্তে আস্তে । সম্ভব মেয়েটা এমন ভাবেই কথা বলে । মেয়েটার কথা বলার ধরন দেখে আমার মনে আগের ধারনাটা আরও দৃঢ় ভাবে আসন গেড়ে বসলো যে মেয়েটার মন আজকে সত্যিই খারাপ কোন কারনে । আমি কেবল এই কারনেই মেয়েটাকে মুভি দেখার প্রস্তাবটা দিলাম । যদি মেয়েটার কিছুটা ভাল লাগে । 
খাওয়া শুরু করতেই আমি মেয়েটাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই বললাম-আপনার আজকে মন খারাপ কেন ? মীরা চামচ মুখে নিতে গিয়ে থেমে গেল । তাকিয়ে রইলো আমার দিকে কিছুটা সময় । মেয়েটা আসলেই বেশ খানিকটা অবাক হয়েছে আমার কথা শুনে ।আমি বললাম-আজকে কোন কারনে আপনার মন খারাপ । এই মন খারাপ ভাব টা কাটানোর জন্যই মনে হয় এতো এতো শপিং করেছেন তাই ?
মীরা আবারও কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রাইসের চামচ টা মুখে দিলো । একটু চিবিয়ে তারপর গিয়ে ফেলল । তারপর বলল-হুম ! মন খারাপ থাকলে আমি শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি করি খুব । -মন খারাপের কারন টা কি আমাকে বলা যায় ?-যায় ! 
আবারও কিছুটা সময় চুপ করে থেকে মীরা বলল-আজকে আম্মুকে খুব বেশি করে মনে পড়ছিলো । কেন জানি না খুব বেশি । -উনি .....-মারা গেছে ! -সরি, আসলে আমি জানতাম না ! -নাহ ঠিক আছে । সরি বলার কিছু নেই । মাঝে মাঝে আম্মুকে খুব মিস করি ! খুব বেশি ! আর কেউ নেই আমার !
আর কেউ নেই তো এই কথাটা এমন ভাবে বলল আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগলো । আমি তাকিয়ে দেখি মীরার চোখে পানি চলে এসেছে । চোখের জল বিষণ্ণতা দুর করনে খুব কার্যকরী । এটা যত বের হবে তত মানুষের মন হালকা হবে ! অবশ্য কিছু সময় পরেই মীরা সমনে নিল । 
মীরা ওর মায়ের ব্যাপারে আরও অনেক কথা আমাকে বলল । আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম । মীরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো যে আমাকে বলতে পেরে মীরা ভাল লাগছে । আসলে কষ্টের কথা গুলো অন্যের সাথে শেয়ার করে নিলে মন খারাপের ব্যাপারটা কমে আসে । ঠিক তেমনি মীরাও যেন একটু হালকা হয়ে নিচ্ছিলো নিজের কাছে । 
খাওয়া শেষে দুজন মিলে মার্কিন অধিনায়ক দেখলাম । একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে মুভি দেখাটা খারাপ লাগলো না । বরং বেশ ভাল লাগলো । মুভি শেষ করে মীরার সাথে সাথে হাটতে হাটতে পার্কিং লরের সামনে এলাম । মীরা ওর ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলল । এবার মীরা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল-আপনার মন কেন খারাপ শুনি ?-মানে ? আমার মন খারাপ আপনাকে কে বলল ?-দেখুন একজন বিষণ্ণ মানুষ অন্য একটা বিষণ্ণ মানুষের চোখ খুব ভাল করেই চিনতে পারে । আপনি যেমন আমার কষ্ট টা বুঝতে পেরেছে তেমনি আপনারও যে কোন কারনে মন খারাপ সেটাও আমি আপনার চোখ দেখেই বুঝেছি । কেন জানি মনে হয়েছে আপনার সাথে বললে কষ্ট খানিকটা কমবে । আপনার বেলাতেও সেটা সত্যি । 
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । ততক্ষনে গাড়ি চলে এসেচে । মীরা আমাকে প্রায় জোর করেই গাড়িতে তুলে নিলো । তারপর আমার বাসার ঠিকানা জানতে চেয়ে সেদিকে গাড়ি ছোটাতে বলল । মীরা বলল-না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না । আমি কিছুটা সময় মীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম -আসলে গত সোমবার সুপ্তির বিয়ে গেছে । -আপনার প্রেমিকা ?-হুম ! -এই কথাটা আমি কাউকে বলতে পারছি না, ভেতরে যে কি হচ্ছে সেটা কাউকে বলতেো পারছি না । আমি ....।
আমি অনুভব করলাম আমার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়ে । সুপ্তির বিয়ে হওয়ার পর এই প্রথম আমি কাঁদতে শুরু করলাম । কেন জানি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না । মীরার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটার চোখেও পানি চিকচিক করছে । আমার জন্য মেয়েটা কোন করুনা নয় বরং স হানুভুতি অনুভব করছে । এটা যেন আমার কান্না কে আরও একটু বেশি বাড়িয়ে দিল । 
আমি জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম ! 
রাস্তা এই সময়ে বেশ ফাঁকাই বলা চলে । মীরার গাড়িটা বেশ দ্রুতই চলছিলো মোহাম্মাদপুরের দিকে । মীরা অনেক টা সময় পরে বলল-এখন ভাল লাগছে ?-হুম । 
আসলেই আমার একটু হালকা লাগছিলো , অন্তত একটা মানুষের সামনে নিজের কস্ট টাকে বের করে দিয়ে আসলেই একটু হালকা লাগছিলো । আমি বললাম-থ্যাঙ্কিউ ! আজকে এই কষ্ট টা বের না হলে হয়তো আর কোন দিন বের হত না । -আমার বেলাতেও তাই । কাউকে না বললে হয়তো কষ্ট টা ভেতরই রয়ে যেত । তোমাকেও ধন্যবাদ ! 
গাড়িটা একেবারে আমার বাসার সামনে এসে থামলো । আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা যখন চলে যাচ্ছিলো আমার মনের ভেতরে তখন একটা মিশ্র অনুভুতি হল । মেয়েটার সাথে হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না তবে মেয়েটা আজকে আসলেই বড় উপকার করলো আমার । আজকে রাতে আমি হয়তো একটু ঘুমাতে পারবো !

১৮।ছোটগল্প-বিসর্জন

রাশেদ মোড়ল তার সামনে রাখা খালি ঝুড়িটা লাথি দিয়ে কিছুটা দূরে ফেললেন। শারীরিক শক্তি খরচ করলে মানুষের রাগ বরাবর কমে তিনিও হয়ত এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হাবুলের সামনে দাঁড়িয়ে লুঙ্গিটা একটু তুলে ধড়লেন তারপর দ্বিতীয় লাথিটা দিলেন হাবলুর চোয়াল বরাবর। হাবুল তাতে ব্যাথা পেলেও রাশেদ সাহেবের পা জড়িয়ে ধরল।-চেয়্যারম্যান সাব আমারে মাইরাল্লেও গরু পাওন যাইব না। হাছাই আমি চুরি করছি না।হাবুলের সামনে এমনিতেই অনেক ভীড়। এদের মধ্যে চোরকে মারার ব্যাপারে কিছু সেচ্ছাসেবী মোড়ল সাহেবের তৃতীয় লাথি দেবার প্রস্তুতির আগেই এগিয়ে এল। চেয়ারম্যান সাহেব একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাবুলের প্রহার পর্ব দেখলেন। তারপর সোনা মিয়ার খোজ করলেন। সোনা মিয়া ভীড় হতে আলাদা দাঁড়িয়ে একমনে ভাবছিল। চেয়ারম্যানের ডাকে বিষন্ন মুখে এগিয়ে এল।-ডাকছুইন?-হ। বৈঠকখানায় চল তর লগে কয়ডা কতা কইয়াম।রাশেদ মোড়লের পিছু পিছু বৈঠকখানায় এসে বসে সোনা মিয়া। তার সামনে ছোট একটি কাপে চা। সে তার মুখের চিবানো পানের অবশিষ্ঠাংশ ফেলে দিয়ে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। রাশেদ মোড়ল খুব দ্রুত গতিতে পা নাচাচ্ছে তার কন্ঠেও আক্ষেপ আর অস্থিরতা,-চেয়ারম্যান বাড়িত্তে গরু চুরি অইলো কত বড় লইজ্জার কতা ক সোনা!-হ।হেইড্ডাতো শরমের কতাই ।-তিপ্পান্ন আজার টেহা দিয়া কিনছি।মাইনষেরে না দেহাইতারলে কি লাভ আছে কুন? এইল্লাই বাইরদারে হাবুলরে দিয়ে বাইন্দা রাখছিলাম।আম্মায় কিন্তু কইছিল ভিতর বাড়ির গোয়ালদারে বাইন্দা রাখতাম।আমি হুনছি না। আমার দোষ।এই একি কথাগুলো সকাল থেকে কম করে হলেও দশবার বলেছে রাশেদ মোড়ল তবু সোনা মিয়া মাথা দোলায়।এবার রাশেদ মোড়ল একটু ঝুকে পড়ে বলে,-গরুডা ফেরত পাইয়াম তো সোনা? সকাল ত্থেকে সন্ধ্যা অইয়া গেল হাবুলরে মাইর দোর করা অইতাছে, কাম অইছে না। এহন একটাই উফায় আছে।-কি?-নান্দাইল থানার যাইয়া একটা জি ডি করবাম। সন্দেহ তালিকায় এক নাম্বারে রাখবাম হাবুলরে আর দুই তিন নম্বরে হারুইন্নাগো বাড়ির দুই তিনডার নাম দিয়া দিয়াম।-চেয়ারম্যান সাব একটা কতা কই। হাবলু মিয়া এই কাম করছে না। হেরে আমি চিনি। আন্নে হের নাম বাদ দিন যে।-ছেড়া কিতা কয়? আমি বাদ দিলেওই পুলিশ হেরে ছারতো কেরে? হেই পাহারায় আছিল। নাম না দিলেই সন্দ করব। আর চুরিডাও হের লগে সল্লা কইরাই করছে কেউ।দেহছ না চুরে হেরে কুন ক্ষতি করছে না। তরে যেইড্ডা কইলাম হেইড্ডা কর। এহুনি যা হুন্ডা বাইর কর।সোনা মিয়া হুন্ডা বের করে আনতে গেলে হাবুলের কাছ দিয়েই যেতে হল।তাকে দেখেই হাবুল হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল।-সোনা আমারে বাছা দোস্ত। তুইতো জানস চুরি কিবায় করে আমি জানি না। তর ভাবি পোয়াতি।হের কসম।সোনা মিয়া হাবুলের কাঁধে হাত রাখল,চিন্তা করিছ না যে। আমি দেখবাম।হাবুলকে দেয়া আশ্বাসকে নিজের কানে কেমন দূর্বল শোনাল সোনা মিয়ার কাছে। রাশেদ মোড়ল এসে পড়ায় সে কথা না বাড়িয়ে হুন্ডা নিয়ে এগিয়ে যায়। হুন্ডায় উঠে সে আর একবার আড় চোখে তাকাল হাবুলের দিকে। হাবুলের ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াচ্ছে,শরীরের নানা জায়গায় রক্তের ছোপ। তার গায়ের জামাও ছিড়ে একাকার। নাম না বলে দিলে তাকে এখন আর চিনা যাবে না।এভাবে কাল পর্যন্ত মার খেলে আর বাচানো যাবে না এমনিতেই হয়ত আর পুলিশে দিলে তো একবারে মারাই পড়বে হাবুল। কারন ঘুষ দেয়ার পয়সা নাই হাবুলের। হাবুলকে এভাবে দেখে হঠাৎ হাল্কা চোখ জ্বালা করল সোনার।সে চোখ ফিরিয়ে নিল।চেয়ারম্যান সাহেব পিছে চড়ে বসতে সে হুন্ডা স্টার্ট দিয়ে রওনা হল নান্দাইল।চাঁদের শরীর এখনো পাতলা তাই তেমন আলো নেই। রাস্তা ঘাট খুব একটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। সোনা মিয়া তবু হুন্ডার গতি বাড়িয়ে দিল। চলার গতির সাথে তার জীবনের গতিটাও চলচ্ছবির মত চোখের সামনে ভাসতে থাকল। বাপ-মা মরা সোনা মিয়াকে সবাই ঠকাত আর পয়সার চেয়ে বেশি মজুর খাটিয়ে নিত। ছুটা কামলা করে এর বাড়ি তার বাড়ি একবেলা দুবেলা খেয়ে তার দিন কাটতো। তখন শুধু হাবুল আর হাবুলের মায়ের ভালোবাসায় এই পৃথিবীটাকে কিছুটা আপন মনে হত। কত দিন অভুক্ত সোনা মিয়ার চেহারা মেপে নিজের সাথে খেতে বসিয়েছে হাবুল!এমনকি তার গায়ে এখন জড়ানো আজকের চাদরটাও হাবুলের কষ্টার্জিত টাকা থেকে কিনে দেয়া। চেয়ারম্যানের এখানে হাবুলই বান্ধা কামলা ছিল বহুদিন ধরে।পরে সোনা মিয়াকে একরকম সুপারিশ করেই কাজে ঢুকায় হাবুল। কিছুদিনেই সোনা মিয়া ফুট ফরমায়েশ খাটা চাকর থেকে খাশ পরামর্শকারী হয়ে উঠে। হয়ে উঠে চেয়ারম্যানের খুব কাছের লোক।ঠকতে ঠকতে সে ভেতরে ভেতরে কতটুকু কৌশলী আর চালাক হয়ে উঠেছিল তা চেয়ারম্যানের এখানে না এলে বুঝতোই না হয়ত। কিন্তু হাবুল! হাবুল তার পেছনের আবছা পৃথিবীতে দাঁড়ানো একটা সাদা মসজিদের মত। হাবুলের ক্ষয় ক্ষতি তাই তার বুকে একটা বেঢপ খচখচানি তৈরী করছে।ভাবতে ভাবতে নান্দাইল শহরে কখন চলে এসেছে সোনা মিয়ার খেয়াল নেই। আর কিছুদূর গেলেই থানা হঠাৎ হুন্ডা থামায় সে। রাশেদ মোড়ল অবাক হয়।কিরে থামায়াল্লি কেরে?আন্নের লগে দুইডা কতা কইয়াম চেয়ারম্যান সাব।মানে?চেয়ারম্যান বাড়িতে নতুন গরু কেনা হয়েছে। গরুর ঘন ঘন ডাক আর উৎসাহিত জনগনের কোলাহলে বাড়িটি সরব। কিন্তু বৈঠকখানার দরজা চাপানো সেখানে রাশেদ মোড়ল,হাবুল, হাবুলের আট মাসের অন্তসঃত্তা স্ত্রী আর সোনা মিয়া। চেয়ারম্যান সাহেব গলা উঁচু করে বলল,-এই সোনা হাবুলের বান খুল।সোনা চটপট হাবুলের হাতের বাঁধন খুলে দিল। হাবুল আর তার স্ত্রীর মুখে তবুও আতঙ্ক। চেয়ারম্যান সাহেব এবার হাবুলের বউকে উদ্দেশ্য করে বলল,জামাই বাচাইতে চাও না?-হ চাই?-তাইলে কয়ডা কতা কইয়াম মনোযোগ দিয়া হুনবে।হাবুলেরও বউ বিস্ফোরিত চোখ আর আতঙ্কিত মুখ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাশেদ মোড়ল তার মুখের পান চিবোতে চিবোতে আয়েশ করে চিপটি ফেলল। গলা খাকড়ি দিল।চোখ বুজে আরো একটু সময় নিয়ে বলল,-থানায় গিয়া জিডি কইরালছি। তুমার জামাই এক নম্বর আসামী।এহন আমি কইলে দইরা লইয়া যাইব। এমুন প্যাদানী দিব আর জীবনে কামলাগিরি কইরা খাওন লাগব না। কেস চালানের টেহাও তুমরার নাই। আছে?হাবলুর স্ত্রী যেন ঘুমের ঘোরে বলল,-না।-হেইড্ডাই কতা।গরীব মাইষের নামে কেস কইরা আমার ও লাভ আছে কুন? জেল অইলে গরু চুরির দায়ে জরিমানা অইবো। টাকা দিবা কইত্তে?হাবলু আর তার স্ত্রী সম্মিলিত প্রশ্ন করে,-কইত্তে?-হেইড্ডাও অইলো কতা। আদালত তুমরার ভীডা বাজেয়াপ্ত করবো। তাইলে গনো কয়ডা শাস্তি,-পাকিস্তানি ঢলা দিব, জেল অইবো লগে ভীডা যাইবো। তিনডা। আর পুলিশের ঢলা খাইলে মইরা যাওয়াও খুব মামুলী কতা।হাবুলের স্ত্রী কাদঁতে শুরু করল,-অই মাইয়ালোক তুমার কান্দন হুন্তে বইছি না। এহন আমি তুমরারে একটা প্রস্তাব দিয়াম। তুমরা আপোশে ভিডা আমারে লেইক্ষা দেলাও আমি গরুর দাম আদায় কইরা লমু আর পুলিশের লিষ্টেত্তে তুমার জামাইর নাম কাইট্টা দিয়াম।-আমরা থাকবাম কই! করাম কি?-আমি চেয়ারম্যান ন্যায় করনঅই আমার কাম। আমি তুমরারে দয়া কইরা আমার ভিডায় থাকতে দিয়াম। এইহানে কামলা খাটবা আর গোয়ালদারের লগে একটা ঘর বাইন্দা লইবা।হাবুল আর তার স্ত্রী দুজনেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।তারপর আশা না আহত চোখে সোনার দিকে তাকাল বুঝা গেল না। সোনা আস্তে করে উঠে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস টানে।বাইরে থেকে শুনতে পায় হাবুলের বউ কেঁদে কেঁদে বলছে,আইচ্ছা তুমি হের কতা মাইন্না লউ যে। তুমারে পেডের বাইচ্চাডার দোহাই।হাবুল গলা ছেড়ে কেঁদে উঠে,-বাহের ভিডা চেয়ারম্যান সাব।-দূর!কানে আসা কথাগুলো সোনার সহ্য হয় না।সে এক পা এক পা করে ঊঠান পেরিয়ে যেতে থাকে।আট দশ পা এগুনোর পরই আবার সোনার ডাক পড়ল।-সোনা। মাষ্টররে লইয়া কাইলই কাগজ পত্তর রেডি কইরালবি। আপাতত এড্ডা সাদা কাগজে টিপসই নিয়া রাখবাম। দলিল রেডি অইলে বাহিডা করাম।কথাটি শেষ করেই রাশেদ মোড়ল উঠে দাঁড়াল।সে চলে যেতেই হাবুল সোনাকে জড়িয়ে ধরল।-সোনা আমার সব শেষ। তুইতো জানছ আমি চোর না।আন্ধারে মুখ ডাইক্কা কেডাযে আমার মুখ বানলো কেডাযে গরু লইয়া গেল কিছু ঠাহর পাইছি না।সোনা মিয়ার মুখে কথা ফুটল না। হাবুলের চোখের পানি আর ঠোঁট গড়ানো কালসিটে রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় তার গায়ের চাদর। (৩)বুকের মধ্যে দারুন ছটফটানি নিয়ে ঘরে ফিরছিল সোনা মিয়া। বাড়ির কাছে আসতেই নরম কোমল একটা উষ্ণতা তাকে ঝেকে ধরল। চাদরটা টেনে খুলে ফেলে জোড়ে জোড়ে পা চালিয়ে ঘরে ঢুকল সে।নতুন মাড় কাপড়ের খসখসে শব্দ ,কিছু চুড়ির টুং টাং তার অস্থিরতাকে যাদুর মত শান্ত করে দিল।সাত দিন হয় সে বিয়ে করেছে। ডুরে শাড়ি পরা নতুন বউটা তাকে দেখে খাবারের ঢাকনা সরাল।-যান আত মুখ দুইয়া আইয়ুন।-আইজ খাইয়াম না পারুল।-কেরে? শইল ভালা না? দেন আমি খাওয়াইয়া দেই।সোনা হেসে সম্মতি দিল। খেতে খেতে সে নারীর অসামান্য ভালোবাসায় আর মুগ্ধতায় স্তব্দ হয়ে থাকে। খাওয়া শেষ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সোনা।বউটি একটি খিলি পান হাতে দেয়। সোনা পান মুখে দিল না হাতে নিয়ে বসে থাকে।পারুল কাছে আসতেই সুগন্ধি তেলের গন্ধ,আরো কিছু প্রসাধনের গন্ধ সোনা মিয়ার শরীরের ভেতরে ঝড়ের ঘুর্নি তোলে। বউকে কাছে টেনে নিয়ে সে সেই সৌরভগুলো এড়িয়ে তার শরীরের ঘ্রানে ডুবে যেতে চায়।-আইচ্ছা আন্নের চাদ্দরে রক্তের দাগ কেরে?সোনা মিয়া যেন অনেক উঁচু থেকে আছড়ে পরে।-হাবুলের শইল্লেতে ভরছে।- ও! আন্নের দোস্ত যে? হ্যায় চুরি করছে হ্যার রক্ত দিয়া চাদ্দর নষ্ট করার কি আছিল?সোনা মিয়ার বলতে পারেনা এই চাদরটা হাবুলেরি দেয়া।কোন এক শীতের রাতে হাবুল তার গায়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,-শীতে কষ্ট পাছ।এইড্ডা তুই শইল্লে দিছ যে।বউএর শরীর হতে নিজের হাতের বন্ধন আলগা করে দিল সোনা মিয়া।ভশরীর জুড়ে কিসের যেন বিদ্রোহ আবার ঘুরপাক খাচ্ছে।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। আওয়াজ শুনেই সোনা বুঝতে পারে কে এসেছে।দরজা খুলে দেখে আপাদমস্তক একটা চাদরে জড়িয়ে আসলেই কাশু এসেছে। কাশু ঘরের ভেতর ঢুকে সোনার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,-মমসিং বাজারেতো গরুর মেলা দাম।তয় দরা পরনের ডরে তাড়াতাড়ি বেইচ্চালছি। পছাত্তর এ বেচছি। তুমার কতা মত পচিশ আমার পঞ্ছাশ তোমার।সোনা উচ্চবাচ্য না করে চাদরের নিচ থেকে টাকাটা নিল।কাশু তাড়া দিল,আমার জবান তো চিন।গইন্না দেখবা?সোনা শুধু বলল,না।কাশু আর কথা না বাড়িয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।টাকাটা হাতে নিয়ে সোনা মিয়ার শরীর হাল্কা কাঁপতে থাকে।হাবুলের এত বড় সর্বনাশ হবে জানলে সে এই কাজটা করত না।টাকাটা খরচ না করে কোন উপায়ে গোপনে হাবুলকে ফেরত দিয়ে দিবে ভাবে সে। বিছানায় আসতেই পারুল স্বামীর হাতে এত টাকা দেখে বিস্মিত হয়ে যায়।-এত্ত টেহা কার?-আমার না।-ইশ যদি আমরার অইতো!উত্তেজনায় পারুল সোনার কাছে চলে আসে।টাকাটা হাতে নেয় সে আর সোনা তাকে জড়িয়ে ধরে। নতুন ডুরে শাড়ি,সুগন্ধি তেল,কুপির আলোয় কাজল ভরা চোখ দেখতে দেখতে সোনার মাতাল মাতাল লাগতে থাকে। পারুল আবার টাকাটা তুলে ধরে সোহাগী কন্ঠে বলল,-ইশ টাকাডি যদি আমরার অইতো। একটা ছুডমুড খেত কিনতাম আর একটা গাই বাছুর। হেইড্ডা বড় অইলে দুধ দিত। আস্তে আস্তে আমরার গৃহস্থি বাড়তো।বউএর চোখের দিকে তাকিয়ে সোনা ও স্বপ্ন দেখে। দুরের কোন সোনালী দিন সে যেন দিব্যচোখে দেখতে পায়।পারুলের ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে সে যন্ত্রচালিতের মত বলল,-হ আমরার ই।-সত্য!-হ।-টেহাগুলো কই রাখবাম?-তুমার বারাত হামলায় রাহ যে।পারুল যেন দিশেহারা বোধ করে কিছুটা।কোথায় রাখবে ভেবে এদিক ওদিক তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করে,-কই রাখবাম?সোনা আর কথা বাড়াতে চায় না। পারুলের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে তোষকের নিচে রেখে তার শরীরের ঘ্রানে ডুবতে থাকে। ডুবতে ডুবতে তার চোখ বুজে আসে।সাথে সাথে বোজা চোখে জেগে জেগেই যেন সে দুঃস্বপ্ন দেখে সে যে একটা গরুর জবাই হচ্ছে অবুঝ পশুটি গোঙ্গানীর মত শব্দ করছে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। ঝট করে চোখ মেলে সোনা। ভাবে আর চোখ বুঝবে না । হারিকেনের আলো আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে,শরীরের খেলায় কখনো ডুবে কখনো ভেসে দেখতে থাকে বউএর কালচে সোনালী শরীর তার মিহি মসৃন ভবিষৎ। 


ভাত কাপড় ভালোবাসা ও অন্যান্য গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত।

১৯।ছোটগল্পঃ পলোনিয়াম 21

ডাঃ পিটার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।দেশের প্রথম সারির কয়েকজন মনোচিকিৎসকের মধ্যে উনার যথেষ্ট খ্যাতি।অনেক জটিল মানসিক রোগীকে উনি সুস্থ করেছেন।কিন্তু ইদানিং তিনি নিজেই জটিল ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন।নিজের চিকিৎসক জীবনকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।রাতে প্রায় বই পুস্তুক নিয়ে ঘাটাঘাটিও করছেন,বিভিন্ন বিখ্যাত ডাক্তারের কেস স্ট্যাডিতে এরকম কোন রোগী পড়ছে কিনা? তারা কিভাবে সমাধানে পৌঁচ্ছেন? কিন্তু এরকম অনেক কেস স্ট্যাডি পেয়েছেন এবং সেগুলো মনোবিজ্ঞানের সাধারণ চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে গেছে।তাহলে এখানে সমস্যাটা কি?
মার্ক যোহন,৩০বছরের যুবক।আজকে ১৮ বছর যাবৎ তিনি তার চিকিৎসা করছেন অথচ ফলাফল শূন্য।এমনকি তাকে দেখলে বা তার কোন আচরণে তাকে মানসিক রোগী মনে হয়না।কিন্তু সব সময় রুমের দরজা বন্ধ করে থাকে আর বাইরে যেতে বললে বলে; আমায় পুলিশে সোপর্দ করো,আমি একজন খুনি।
মার্ক যোহন যখন খুব ছোট,তখন তার বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে।মার্ক যোহন কার কাছে থাকবে, এনিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়।শেষ পর্যন্ত আদালত সিদ্ধান্ত অনুযারী ১২ বছর বয়স পর্যন্ত যোহন তার মায়ের কাছেই থাকবে কিন্তু এর পরে বাবার কাছে।তবে তারা যদি সমঝোতায় পৌঁছে তবে সে যখন যার কাছে ইচ্ছা থাকতে পারবে আর ১৮ বছর পর সে পুরো স্বাধীন।তার মা কিছুতে তার একমাত্র ছেলেকে ছাড়তে রাজি ছিল না।একসময় তার বাবা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যায় যোহনকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।যোহনও তার মাকে খুবই ভালবাসত,তার ইচ্ছা ছিল মায়ের কাছেই থাকার।কিন্তু যখন সে বুঝল বাবা মায়ের কারণে সে আর সম্পদ নয় বরং সম্পত্তি হয়ে গেছে এবং আদালত এনিয়ে একটা রায়ও দিয়ে দিছে।যোহন বুঝল, তার চাওয়া না চাওয়া এখানে মূল্যহীন।
কিন্তু তার মা এনিয়ে ঐদিন তার বাবার সাথে ব্যাপক তর্কে লিপ্ত হয়,এতে তার বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে তার মায়ের গায়ে হাত তুলতে যায় আর তখনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোহন তার বাবাকে একটা ধাক্কা মারে,আর এতে তার বাবা মারা যায়।সে থেকে যোহনের ধারণা হয় তার আঘাতেই তার বাবা মৃত্যু হয় এবং সে থেকে যোহন মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
যদিও ফরেনসিক রিপোর্ট এবং সকল তদন্তেই প্রমাণ হয় অতিরিক্ত মদ্যপান এবং উত্তেজতি হওয়ার ফলে তার ব্রেইনের স্ট্রোক হয় আর এতে তার মৃত্যু হয়।কোন রিপোর্টে কোন আঘাতের চিহৃ আসেনি।আদালত শুধুমাত্র মদ্যপ ব্যক্তির সাথে অসংযত ব্যবহারের জন্য তার মাকে মৃদু ভৎসনা করেন।
ডাঃ পিটার গত ১৮ বছরে যোহনের সাথে অনেকবার কাউন্সিলিং করেছেন এবং সে তাতে সায়ও দিয়েছেন, সুস্থভাবে কথা বলেছেন।রাতে আবার তার মা ফোন দিয়ে বলল,যোহনতো আবার পাগলামী শুরু করেছে।
বিরক্ত পিটার একবার তার মাকে প্রস্তাবই দিয়ে বসলেন,ওকে পুলিশে সোর্পদ করি।আর আদালত যখন ওকে বেকুসুর খালাস দিবে,তখন ওর ভুল ভেঙ্গে যাবে।আর এতে তো যোহনের মা রেগে মেগে আগুন।বললেন,ডাক্তার আপনি না পারলে ছেড়েদেন,কিন্তু এ ধরনের কথা বলবেন না।পিটার কিছুটা বিব্রত হলেন কিস্তু রোগী ছাড়ারতো প্রশ্নই আসে না,এতে উনার এত দিনের সকল সুনাম একরোগীতে নষ্ট হয়ে যাবে।
এই ১৮ বছরে কত হাজার হাজার রোগী উনি সুস্থ করেছেন আর এক যোহনই তার রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।পিটার ব্যর্থ এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।নিজেকে এখন মাঝে মাঝে মানসিক রোগী মনে হয়।নিজের সাথে নিজে অনেক কাউন্সেলিং করেছেন।তিনি হারতে পারেন না।তাই তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।যোহনের উপর এন্টি কাউন্সেলিং প্রয়োগ করবেন, যোহনকে তিনি দুনিয়ার থেকে সরিয়ে দিবেন।
যোহনের সামনে পিটার বসে আছেন।পিটার যোহন কে বললেন,আজ আটার বছর যাবৎ আমি তোমার চিকিৎসা করছি।ডাঃ হিসাবে রোগীদের অনেক গোপন তথ্য আমাকে গোপন করতে হয়।অনেক সিরিয়াল খুনের আসামী,কয়েক ডজন ধর্ষনকারী রোগীকে আমি চিকিৎসা করেছি,তারা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে এবং অনেক কল্যাণমূলক কাজ করছে।তোমার ক্ষেত্রে তোমার মা সঠিক কথা বলেননি,তাই তোমার চিকিৎসা সঠিকভাবে হয়নি।তাই আমি আমার শেষ চিকিৎসা তোমার উপর প্রয়োগ করব।আশা করি, তুমিও শান্তি পাবে আমিও শান্তি পাব।
ডাক্তার তার ব্যাগ থেকে ঔষুধটা বের করে সিরিঞ্জের ভিতরে টুকাতে যাবেন,তখনই যোহন ডাক্তারের হাত ধরে ফেলেন।যোহন বললেন,ডাক্তার পৃথিবীতে অন্ধ কোন জিনিসই ভালো নয়; অন্ধ ভালবাসা,অন্ধ মোহ,অন্ধ সম্মান।ডাক্তার কিছুটা বিচুলিত হয়ে উঠলেন।বললেন,যোহন আমাকে আমার কাজ করতে দেয়।আমাকে আপনি যে শাস্তি দিতে যাচ্ছেন,তা আমার পাপ্য নয়।তাও আমি সে শাস্তি ভোগ করছি তা ভালবাসার ঋণ পরিশোধে।ডাক্তার কিছুটা ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলেন।বললেন,তুমি এসব কি বলছ? হ্যাঁ, আমার শাস্তির আর একসপ্তাহ বাকী।
ডাক্তার একেবারে চুপ মেরে গেলেন।যোহন বলল,আপনি আমার ঔষধের সাথে যে ক্যামিকেলটা মিশাতে যাচ্ছেন তা পলোনিয়াম 21।আর এতে আমি সামান্য উত্তেজিত হলেই স্ট্রোক করে মারা পড়ব।আর এই পলোনিয়াম 21 যে কোন ক্যামিক্যালের সাথে মিশালে তা এমনভাবে মিশে যায় যে,উচ্চমাত্রার ফরেনসিক রিপোর্টেও তা ধরা পড়ে না।তবে বেশ কিছুদিন পর তা আবার আলাদা হতে থাকে।তবে তার আগেই সব খতম,সকল তদন্তও কমপ্লিট।পিটার স্তব্দ হয়ে যোহনের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার মনে হচ্ছিল,সেই রোগী আর যোহন তার ডাক্তার।
যোহন বলল,রোগীর সকল তথ্যই গোপন রাখা আপনাদের পেশার কমিটমেন্ট।পিটার মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ এবং আমি সে কমিটমেন্ট রক্ষার ১ম শ্রেণির একজন।তাহলে সত্যটা শুনন,আমার বাবাকে খুন করেছে আমার মা।যেদিন বাবা আসেন সেদিন মা বাবার জন্য অনেক মদের আয়োজন করে,আর তার সাথে গোপনে পোলোনিয়াম 21 মিশ্রিত করে দেয়।আমার মা একজন কেমিষ্ট,তিনি খুব ভাল করে এর সম্পর্কে জানতেন।পরে বাসার পিছনে একটি ছোট শিশি আমার নজরে আসে যাতে লেখা পলোনিয়াম 21।ব্যাপক কৌতুহল নিয়ে ঘাটাঘাটি করে এর সম্পর্কে জানি।এই ক্যামিকেলের এই ধরণের আচরণের কারণে এটি নিয়ে বিজ্ঞানের জগত নিরব,কারণ অনেকে এটার মিস ইউজ করতে পারেন এবং পলোনিয়ামের এই আইসোটোপটা সংগ্রহ করা বলা যায় দুরহ।বিজ্ঞান ও গভেষণা জগতের রেজিষ্টার্ড লোকজনই শুধু এটা সংগ্রহ করতে পারে।মা আমাকে পচন্ড ভালবাসে কিন্তু আমি তার এই ভালোবাসার অন্ধ আক্রোশ মেনে নিতে পারিনি।আমাদের দেশে যেহেতু মৃত্যুদন্ড নেই তাই বিচারের তার যাবৎজীবন অর্থাৎ ১৮ বছরের জেল হত।আর তার ভালবাসার সে ঋণ আমি পরিশোধ করছি নিজেকে বন্দি করে। ১৮বছরের আর একসপ্তাহ বাকী।
এতক্ষণে পিটারের চোখে জল চলে আসল।নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল তার।তার অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে বিদায় নিল।
একসপ্তাহ পরে ডাঃ পিটারের কাছে আবার যোহনের মায়ের ফোন আসে।তার মা জানায়,যোহন গত এক সপ্তাহ পুরো ভাল ছিল কিন্তু এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ,এখন সে তার মৃত্যুদন্ড দাবী করছে। ডাঃ বিনয়ের সহিত জানায়,আপনার ছেলের কেসটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।

২০।ছোটগল্পঃ শাড়ি

গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক দুপুর। বৃক্ষের শাখায়, পত্র-পল্লবে বাতাসের কোন স্পন্দন নেই। সূর্যও যেন ক্রোধে উন্মত্ত; জ্ঞাণশূণ্য হয়ে দিগ্বিদিক তাপ ছড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় উনুনে চড়ানো মাংসের মতো সেদ্ধ হচ্ছিল নগর-মফস্বলের আইপিএস কিনতে অসমর্থ মানুষগুলো। এমনই এক দুপুরে সেমিজের ওপর পাতলা সুতি কাপড়ের ওড়না ভিজিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল সুরাইয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভেজা কাপড় থেকে রীতিমত ভাপ বের হতে লাগল। কিন্তু বারান্দার গ্রিল ধরে দূরের ফুলে ফুলে ছেয়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এমন অসহ্য গরমের কথাও ভুলে গেল মেয়েটা। খর রৌদ্রে গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে গাছের মাথায় মাথায়। দাবানলের মতো সেই আগুন এক্ষুণি ছড়িয়ে পড়বে এ গাছে, ও গাছে।
ফুটে থাকা সেই আগুনের দিকে অদ্ভুত মাদকতায় তাকিয়ে ছিল সুরাইয়া। চোখ ফিরে আসতে চায়, তবু ফেরানো যায় না। সুরাইয়ার একবার মনে হল, ঠিক এরকম রঙের একটা শাড়ি যদি তার থাকত, তাহলে আজ সে ঐ শাড়িটাই পরত। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, এরকম রঙের একটা শাড়ি তো তার আছেই—সেই যে গেল বৈশাখে সাহিল উপহার দিয়েছিল, সেই শাড়িটা। কিন্তু সেই শাড়ির এমনই জংলী ছাপা যে, দেখলেই গা রি রি করে। পুরো শাড়ি জুড়ে বড় বড় লতানো ফুল, ঘন নীল রঙের। শাড়িটা সে যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিয়েছে, ভাঁজের ভেতর সুগন্ধি কর্পূর ঢুকিয়ে। পরেনি কখনোই। 
সাহিল একদিন জিজ্ঞেস করেছিল শাড়িটার কথা। কফি শপে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল, “নিম্মি, ঐ শাড়িটা পরলে না যে।“ নিম্মি সাহিলের দেয়া নাম। ছোটবেলায় সুরাইয়া নিমকি খেত খুব। পাড়ার সবাই তাকে ‘নিমকি' বলে ক্ষ্যাপাত। সাহিল বলল, “তোমার নামটা ডাকতে একটুও আরাম হয় না। তারচে নিমকি অনেক ভাল”। সুরাইয়া ক্ষেপে উঠতেই শুধরে নিয়ে বলল, “আচ্ছা যাও, নিমকি নয়, তোমাকে নিম্মি ডাকব।“ 
শাড়ির প্রসঙ্গ আনতেই সুরাইয়া মিথ্যে করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শাড়িটা সে গৃহ পরিচারিকা বিন্তিকে দিয়ে দিয়েছে। কাউকে দিতে হলে ভালো, নতুন শাড়িই দিতে হয় কিনা। উত্তর শুনে সাহিল বলেছিল, “হুঁ”। শুধুই একটা ‘হুঁ’। তাকে তখন ঝড়ের আগের নৈঃশব্দ্যের মতো গম্ভীর আর বিষাদ-আক্রান্ত দেখাচ্ছিল। সুন্দরও। কোন অভিযোগ সে করেনি, কোন অভিমানও দেখায় নি। কিন্তু সেই ছোট্ট ‘হুঁ’ তে সবই ছিল, যা কিছু প্রয়োজন ছিল। সুরাইয়া নিজেও জানে না, এই মিথ্যেটা সে কেন বলেছিল। নিশ্চয়ই পরবে না বলে নয়। কিন্তু অন্য কারনটা কী সেটাও সে আজ আর নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সেই দুপুরে হঠাৎ সুরাইয়ার মনে হল, অভিমান লুকিয়ে রাখা সেই মুখশ্রী দেখার জন্যই হয়তো সেই মিথ্যেটা বলেছিল সে। 
শাড়িটার কথা মনে হতেই হঠাৎই এক বাঁধ ভাঙা আবেগে তাড়িত হল সুরাইয়া। বারান্দা থেকে দৌড়ে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেল সে। চাবি খুঁজে নিয়ে আলমারি খুলে শাড়িটা নামিয়ে আনল। সেটার গন্ধ শুঁকল, বুকে আঁকড়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ, এবং সবশেষে হালকা ইস্ত্রি করে ভাঁজের দাগগুলো মসৃণ করে নিয়ে আলনায় মেলে রাখল। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সেদিন সেই শাড়িটা দেখে তার একটুও গা রি রি করল না।
সুরাইয়া মায়ের একটা মাড়হীন, পুরনো শাড়ি নিয়ে শাড়ি পরার কায়দা-কানুন রপ্ত করার চেষ্টা শুরু করল। ছোটবেলা থেকেই তার সমস্ত আগ্রহ বই কেন্দ্রিক। গৃহকাজ কিংবা সাজুগুজু কোন কিছুতেই সে তেমন করে মন দেয় নি কখনো। তাই তেমন পারদর্শিও নয় এসবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের যে এরকমভাবে বেড়ে ওঠা একেবারেই মানানসই নয়, সেকথা শুনতে শুনতেই সে বড় হয়েছে। কিন্তু কারো কথাতেই কোন রকম কর্ণপাত না করে সে সবসময়ই এক রকম উদাসীন থেকেছে। সুরাইয়ার মা আসপারি বেগম বলেন, শাড়ি পরতে পারাও নাকি এক ধরনের শিল্প। অতীতে যতবারই সে এই শিল্প চর্চা করার চেষ্টা করেছে, ততোবারই তার মাথার মধ্যে গণিতের জটিল সমস্যার মতোই তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। শাড়ি পরার পর দেখা যায়, হয় পেছনের অংশ খুব উঁচুতে উঠে থাকে, আর কুচিগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খায়; নয় কুচিগুলো বেশি ওপরে উঠে থাকে আর পেছনের অংশ পায়ের নিচে চলে যায়। যদিও বা কখনো দুটি পাশ সমান করে পরে, কুচিগুলো যদিও বা মন দিয়ে গুছিয়ে নেয় কখনো, তবু সবগুলো কুচি থেকে অন্তত একটি কুচি যে ভাবেই হোক, নির্লজ্জের মতো বেরিয়ে পড়ে তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। এই সবকিছুই যেদিন ঠিক থাকে, সেদিন আঁচল ঠিকঠাক করতে করতেই গলদঘর্ম হতে হয় তাকে। কুচির পাশে ধুতির মতো হয়ে আলাদা করে যে ক'টি ভাঁজ পড়ে, তার কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। শাড়ি পরার পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে গিয়ে সুরাইয়ার মনে হয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও বুঝি পঞ্চ পান্ডবেরা এরচেয়ে কিছুটা সহজে জয় করতে পেরেছিল। সেদিন দুপুরে শাড়ি-পরিধান শিল্প রপ্ত করতে করতে সে আচমকা পড়ে গেল। একলা যে পড়ল তাও নয়। খাটের পাশে রাখা টুলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কাঁচের গ্লাসটাও পড়ল। ভাঙা কাঁচ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শব্দ শুনে আসপারি বেগম ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে; হাঁপাতে লাগলেন তিনি। আসপারি বেগমের সামান্যতেই বুক ধড়ফড় করে ইদানিং। অল্পতেই হাঁপাতে থাকেন। চৌকাঠে পা রাখতেই সুরাইয়া চেঁচিয়ে উঠল, “মা, কাঁচ ভাঙা,,,” আসপারি বেগম সেদিকে না তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্মিত হয়ে। “একী অবস্থা! গরমের মধ্যে গায়ে শাড়ি পেঁচিয়েছিস কেন?” “এমনি, মা। সব কিছুতে এত কারণ খোঁজ কেন, বল তো?” “কখনো তো শাড়ি পরার আগ্রহ দেখাস না!” “আজ দেখিয়েছি। কোন সমস্যা আছে?” “এত রেগে গেলে কী করে হবে? মেয়েদের এত রাগ থাকা ভালো না”। এই কথায় সুরাইয়া আরো রেগে যেতে পারত। কিন্তু আজ সে রাগল না। হেসে ফেলল। তারপর কোমল সুরে জিজ্ঞেস করল, “রাগ থাকলে কী হয়, মা? আমার বর কি আমাকে মারবে? মারলে আমিও মেরে দেব”। বলেই আরও হাসতে লাগল। সাহিল তাকে মারছে আর সেও সাহিলকে মারার জন্য তেড়ে যাচ্ছে- এটা মনে করেই তার হাসি প্রাণবন্ত ঝর্ণার মতো উছলে বের হতে লাগল। সেই ছেলে এতই গোবেচারা যে, কিল দেয়ার বদলে খেয়েই ভূত হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি থেকে যায় তার। আসপারি বেগম ছিটিয়ে থাকা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করতে করতে মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকালেন। কোথায় যেন একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে বলে মনে হতে লাগল তাঁর। বিয়ে কিংবা বর সংক্রান্ত কোন কথা তো এভাবে তার মুখ দিয়ে বেরোয় নি কখনো! আজ হঠাৎ এসব কথা কেন বলছে? সুরাইয়ার মাথা ঠিক আছে তো?, ভাবলেন তিনি। আসপারি বললেন, “ঐ নতুন শাড়িটা কবে কিনেছিস? দেখলাম না তো একবারও”। সুরাইয়া আলনার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ের দিকে ফিরল আবার। বলল,“ওটা আমার এক বন্ধু দিয়েছে, মা”।আসপারী উৎসুক হলেন,“ছেলে, না মেয়ে?” সুরাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “এত ফিরিস্তি টেনে হবেটা কী? বন্ধু বন্ধুই, জান না? এই শাড়িটা পরে আমি আজ সেই বন্ধুর বাড়িতে যাব। আজ তার জন্মদিন। তুমি শাড়িটা পরিয়ে দেবে সুন্দর করে?” আসপারি বললেন, “দেব”। আর কোন বাক্য ব্যয় না করে তিনি ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো নিয়ে চিন্তিত মুখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। সুরাইয়া মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।মা'কে মিথ্যে বলার জন্য দুঃখই হল তার। কারো জন্মদিনেই সে যাবে না। সে যাবে বিয়েতে। তার নিজের বিয়ে। সুরাইয়ার বাবা ভয়ংকর রাগী মানুষ। চালচুলোহীন সাহিলকে তাঁর মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে, সুরাইয়ার বড় বোন যেভাবে তার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছে, তাতে করে ছেলে পছন্দ হলে ঘাড় ধরে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে সবাই। সাত-পাঁচ ভেবে কাজী অফিসে গিয়েই বিয়েটা সেরে ফেলা স্থির করেছে সে। পরে আস্তে-ধীরে জানানো যাবে। যদি দেখে খুব তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে, তাহলে দুম করে বলে ফেলবে। 
বেলা পড়ে যেতেই সুরাইয়ার বড় বোন শায়লা এসে হাজির হল। সঙ্গে তার দুই সন্তান- স্বদেশ আর প্রদেশ। সুরাইয়ার ভাষ্যমতে তারা মূর্তিমান আযাব। ধ্বংসাত্মক কোন খেলা ছাড়া তাদের অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহ নেই। দুই ভাই প্রয়িনিয়ত একে অপরকে মারছে, হাতের কাছে ভঙ্গুর কিছু পেলেই আছাড় মারছে, খাবার খেতে দিলে একজন আরেকজনের গালে গালে ঘষে দিচ্ছে, মুখে পানি নিয়ে অন্যের গায়ে কুলকুচা করছে, ওয়ারড্রোবের ওপর থেকে খাটে লাফিয়ে পড়ছে, দরজার পর্দা ধরে টারজানের মতো লাফিয়ে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, হেন কুকর্ম নেই যা তারা করতে পারে না। দুই ভাইই পাটকাঠির মতো শুকনো, অথচ গায়ে ঠিক ‘আলীর বল'। কেউ যে তাদের ধরে একটু শাসন করে দেবে সেই উপায় নেই। কামড়ে, খামচে, চিমটে ঠিকই দৌড়ে পালাবে। সুরাইয়ার ভয়ংকর রাগী বাবাকেও তারা ভয় পায় না, এতই অকুতোভয়। ছেলেদের এই দুঃশাসন মায়ের চোখেই পড়ে না। তার নির্লিপ্ত ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হয়, তার দুই ছেলে দুই ক্ষুদে বীর। সুরাইয়ার বোনের সহ্যক্ষমতা গিনেজ রেকর্ডভুক্ত হওয়ার যোগ্য বলেই সুরাইয়ার ধারণা। সুরাইয়া বোনকে মুখ কালো করে অভ্যর্থনা জানাল। আজ বোনের আগমন তার কাছে উপদ্রবের মতোই মনে হচ্ছে। স্বদেশ-প্রদেশ থাকলে এম্নিতেই উপদ্রব, কিন্তু আজকের মনে হওয়া আলাদা করে আলাদা। কেন, সেটা আবারও আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ বিকেলে সুরাইয়া সাহিলকে ফোন করল,“যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকবে, ঠিক আছে?” “হুঁ”“আমার আসতে একটু দেরী হতে পারে। বড় আপা এসেছেন। বকবক করেই চলেছেন”।“ঠিক আছে”।“কী ঠিক আছে!”“আপা বকবক করছেন সেটা ঠিক আছে। এতদিন পর এসেছেন, বকবক তো করবেনই”। “আপা মোটেও এত দিন পর আসেন নি। দুই দিন পর পর চলে আসেন”।“ঠিকই তো আছে”।“উফ, তোমার অভিধানে কি এই হুঁ, ঠিক আছে, আচ্ছা, এসব ছাড়া আর কিছু নাই?”“কী শুনতে চাও? প্রেমের কথা?”সুরাইয়া হেসে ফেলল। বলল, “না, এখন সময় নাই হাতে। আমাকে রেডী হতে হবে। আমি যাই। তুমি আমার দেয়া পাঞ্জাবীটা পরে আসবে। আসবে তো?” “আসব। আমি তোমার মতো উপহারের জিনিস কোন বিন্তিকে দিয়ে দিই নি”।সুরাইয়া মুচকি হেসে বলল,“তুমি লক্ষ্মী ছেলে, আর আমি অলক্ষ্মী মেয়ে”। “আচ্ছা”। সুরাইয়া বিরক্তি প্রকাশ করার জন্য ‘উফ' শব্দ করে লাইন কেটে দিল। সাহিলের দেয়া শাড়িটা পরেই তো সে যাবে। শাড়িটা পরনে দেখলে সাহিল একইসাথে বিস্মিত হবে এবং মুগ্ধ হবে। সাহিলের সেই বহু অনুভূতিতে আচ্ছন্ন মুখ কেমন হবে দেখতে, সেটা কল্পনায় দেখার চেষ্টা করল সে। তার কতই না অবাক লাগছে পুরো বিষয়টি চিন্তা করতে। সেই দিনের ছোট্ট সুরাইয়া বড় হয়ে গেছে এতটা! এক অদ্ভুত ভাবালুতায় আক্রান্ত হল সুরাইয়া। হাত-মুখ ধুতে স্নানঘরে প্রবেশ করল সে। আয়নায় কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখল নিজেকে। ঐ কৃষ্ণচূড়া রঙের শাড়িটা পরলে কেমন লাগবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই ভাবতে লাগল। এও ভাবল যে, যেমনই লাগুক, সাহিল তো খুশি হবে। সাহিলের চমকিত মুখের ছবি কল্পনা করে সুরাইয়া দ্বিতীয়বারের মতো পুলকিত হল।
সুরাইয়া স্নানঘরে চলে যাবার পর শায়লা এবার মায়ের সঙ্গে বকবক করতে শুরু করল। স্বামী-সন্তান-শাশুড়ি'র নৈমিত্তিক গল্প, তবু যেন শেষ হয় না। সপ্তাহান্তে বাপের বাড়ি এসে পুরো সপ্তাহের বিবরণ পেশ করতে না পারলে তার খাদ্য ঠিকঠাক হজম হয় না বলে মনে হয়। মা-মেয়ে গল্পে এতই মগ্ন হয়ে গেলেন যে দুই ক্ষুদে বীরের দিকে তাদের মন দেয়ার একটুও সময় হল না। তারা ততোক্ষণে তাদের খালামণির শাড়িটি দেখে বিশেষভাবে পছন্দ করেছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওটাকে তারা লুঙ্গি বানাবে। এত বড় লুঙ্গি প্যাঁচানো অসম্ভব, তাই তারা সেটা কেটে ছোট করার সিদ্ধান্ত নিল। তাছাড়া, মানুষও তারা দু'জন। তারা শাড়িটি নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল, মা এবং নানীর চোখের আড়ালে। স্বদেশ যতক্ষণে ভাবল যে, লুঙ্গির ভাগ নানাকে এবং তাদের বাবাকে না দিলে বিরাট অন্যায় হয়ে যাবে, প্রদেশ ততোক্ষণে নানির সেলাই মেশিনের আশেপাশের অঞ্চল খুঁজে কাপড় কাটার ধারাল কাঁচিটি নিয়ে চুপিচুপি ভাইয়ের পাশে বসে গেল। তারপর দুই ভাই মিলে প্রসন্ন মুখে শাড়িটি কাটতে শুরু করল। প্রথমে তারা নানা এবং বাবার জন্য বড় করে দুই অংশ কেটে নিল। তারপর নিজেদের জন্য দুই অংশ নিল। পরে যখন বুঝল, বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ভুল হয়ে গেছে, তখন আবার নতুন করে কাট-ছাঁট করার কাজে মগ্ন হল।
সুরাইয়া স্নানঘর থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখের পানি শুষে নিতে নিতে সেই বারান্দার দিকেই গেল। তার কন্ঠে গুনগুন করে বাজছিল রবীন্দ্রনাথের গান, “প্রেমেরও জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে,,,,”। তখনও কর্তন-কর্ম শেষ হয়নি। মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে বারান্দার এক কোনে বসে শাড়ি কাটাকাটিতে কর্মরত দুই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সে বুঝেই উঠতে পারল না, ঠিক কী বলবে, কী বলা উচিত। সে চিৎকার করতে পারল না, রাগে কাঁপল না, মাথা ঘুরে পড়েও গেল না। তার শুধু মনে হল, কাপড় কাটার শব্দের মতো তিক্ত আর জঘন্য শব্দ আর কিছুই পৃথিবীতে নেই। মনে হল, কাঁচি দিয়ে শাড়ি নয়, কেউ তার হৃদয়টা অনেকগুলো খন্ডে ফালা ফালা করে ফেলল। একটিমাত্র কাঁচির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তার কানে হাজার হাজার কাঁচির ক্যাঁচ-ক্যাঁচ হয়ে বাজতে লাগল। 
 


 
 
 

 

Share this article :

0 comments :

Contact Form

Name

Email *

Message *

 

About Author

Recent Comments