Some Important Website

বাংলা প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট সমুহ

Saturday, July 30, 2016

.৩।BANGLA GOLPO- 1.( আমার প্রেমিকারা - আপাত শেষ পর্ব ) 2.( ভেটকি মাছ ও কানা বেড়ালের গল্প ) 3.( ভেটকি মাছ আর কানা বেড়ালের শুভ বিবাহ )

               আমার প্রেমিকারা - আপাত শেষ পর্ব

বন্ধু চান্দু (কোম্পানি ছায়াছবির নায়ক বিবেক ওবেরয় নহে, বাস্তবে উহার নাম চাঁদ) মনে হয় প্রেমে পড়িয়াছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। বেচারা সারাক্ষণ উদাস হইয়া থাকে। আড্ডায় বসিয়া আমাদের লাগাম ছাড়া গল্প আর রাজ্যের খিস্তি খেউরের বদলে কলেজ মাঠে প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখিতেই উহার মনোযোগ বেশী। আমাদের সঙ্গে থাকিয়াও যেন সে এই স্থানে নাই। কাহাতক আর সহ্য করা যায়। একদা উহাকে ধরলা নাদীর পাড়ে তুলিয়া লইয়া গিয়া ভাঙ্গা একখানি নৌকার উপর বসাইয়া শুধাইলাম তাহার সমস্যা কি?

সে শীতল মস্তিষ্কে যাহা বলিয়া গেল তাহার সারমর্ম হইলো - সে তাহার কনিষ্ঠা ভগ্নীর প্রিয় বান্ধবীটির প্রেমে পড়িয়াছে। ইঙ্গিতে তাহার ভগ্নী উক্ত কইন্যাকে প্রেম সম্পর্কে তাহার দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করিতে বলিলে কইন্যা বলিয়াছে যে প্রেমে তাহার বিশেষ অরুচি নাই, কিন্তু উহার এক দজ্জালনী জৌষ্ঠা ভগ্নী রহিয়াছেন, যিনি প্রেম সম্পর্কে বড়ই কঠোর মনোভাব পোষণ করেন ও সদ্য অষ্টম শ্রেণীতে উত্তরণ পাওয়া তাহার কনিষ্ঠাকে প্রেমের ভয়াবহ কুফল হইতে রক্ষায় সদা সচেষ্ট। কনিষ্ঠা যদি আনমনে বাদাম ওয়ালা অথবা রিকশাওয়ালার পানেও কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকে, তবুও তাহাকে জৌষ্ঠার সন্দেহের দৃষ্টিতে পতিত হইতে হয়।

প্রিয় বন্ধুকে এই বিপদ হইতে রক্ষার মহান দায়িত্ব কাঁধে লইয়া আমরা ঝাঁপাইয়া পরিলাম। একেকজন এক এক রকম বুদ্ধি বাহির করিতে লাগিল। পরে আমার দেয়া বুদ্ধিটিই সকলের মনে ধরিল। তাহা হইলো - কোন না কোন ভাবে প্রেম কইন্যার বড় ভগ্নীকে কাহারও প্রেমে ফেলিতে হইবে, যাহাতে সে ছোটটির ব্যাপারে আর নাক বা মাথা না গলায়। কিন্তু সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল - উক্ত দজ্জালনীকে ভালবাসার জালে আটক করিবার সাহস কাহারও নাই। সকলেই নানা কারণ দেখাইয়া পিছলাইয়া যাইতেছে, কিন্তু কেহই প্রকাশ করিতেছেনা যে সে ভীত। এমতাবস্থায় এই অধম অসীম সাহসিকতার সহিত সবার সামনে শার্টের কলার তুলিয়া দিয়া, বুকের বোতাম দুখানা খুলিয়া দিয়া মাস্তান মাস্তান ভাব ধরিবার লোভ কিছুতেই সম্বরণ করিতে পারিলোনা। কইন্যাকে না দেখিয়াই নিজেকে উহার প্রেমিকের পদে নিযুক্ত করিয়া ফেলিয়া সেইদিন বন্ধু মহলে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করিলাম।

পরদিন মহা উৎসাহে জিন্স প্যান্টের ভিতরে ফুল হাতা শার্ট যথাসম্ভব গুজিয়া, ঢাকা হইতে সদ্য কেনা নতুন কেডস জোড়া পড়িয়া চকচকে নতুন হোন্ডা সিডিআই ১০০ বাইকে চাপিয়া কইন্যা দেখিতে গেলাম। কিন্তু চাঁদ যেক্ষণে আমাদিগকে কইন্যার বাড়ীর সামনে লইয়া গেল, সেক্ষণে ভয়ে আমার কলিজা শুকাইয়া উঠিল। কইন্যার পিতা আমার পিতার অধীনস্থ কর্মকর্তা যিনি দুর্ভাষী, রগচটা ও অত্যন্ত কঠিন প্রকৃতির মানুষ বলিয়া বিখ্যাত। কিন্তু আমি ততক্ষণে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়া পড়িয়াছি, বাহির হইতে খাঁচার দরজা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, কাজেই বাহির হইবার আর পথ নাই। সামনে জলজ্যান্ত ছানাপোনা সমেত বাঘ এবং বাঘিনী, মাঝখানে অল্প কয়েক কদমের ব্যবধান। প্রাণ বুঝি যায় এইক্ষনে আমার।

পরদিন সকাল ৬ ঘটিকায় মাতৃদেবীর আগমন আমার হোস্টেলে, কহিলেন - "রেডি হয়ে নে, রংপুর যাবো, স্বপন মামা অসুস্থ"। অনিচ্ছা স্বত্বেও বাহির হইয়া দেখিলাম পিতার আপিসের বিশাল সাদা ঘাড় ত্যাড়া ল্যান্ড রোভার জীপখানি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। শুধাইলাম - "এইটা কেন? ছোট গাড়ী কই?" মাতৃদেবী কহিলেন সঙ্গে আরও কয়েকজন যাইবেন, উহাদের কাউনিয়া ষ্টেশনে ড্রপ করিয়া দিতে হইবে যাহাতে উহারা ট্রেন ধরিয়া ঢাকা যাইতে পারেন। অতএব আমার অত্যন্ত অপছন্দের এই গাড়ীটিতেই চড়িয়া বসিলাম। দুই মিনিট পরে আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামাইয়া দিয়া গাড়ীটি আমার হবু প্রেমিকার বাড়ীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। ভয়ে কলিজা কাঁপিয়া যাওয়ার অনুভূতি পাইতে পাইতে দেখিলাম উক্ত বাড়ী হইতে একে একে কইন্যার পিতা মাতা ও দুই খানি কইন্যা বাহির হইয়া আসিলেন। উহাদের দেখিয়া আমার চক্ষু কোটর হইতে বাহির হইয়া আসিবার উপক্রম হইলো কারণ কন্যাদ্বয়ের বড়টিকে হাইস্কুল পড়ুয়া মনে হইলেও ছোটটি কোনভাবেই ক্লাস থ্রি বা ফোরের উপরে পড়ে না। তবে কি বন্ধু চান্দু এই শিশুটির প্রেমে পড়িল?

উহারা আসিয়া উহাদের বাক্স পেটরা গাড়িতে তুলিতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ ডাইরেক্ট মধ্যগগনে সূর্যোদয়ের অনুভূতিতে বেকুব হইয়া আশেপাশে তাকাইয়া দেখিতে পাইলাম উহাদের বাড়ী হইতে এক অপরূপা তরুণী বাহির হইয়া আসিলো এবং কঠিন ভাবের সহিত সোজা গাড়ীতে উঠিয়া উপবেশন করিল। এক্ষণে আমি বুঝিলাম - এই সেই কইন্যা, আমি যাহার প্রেমে পতিত হইবো বলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়াছ। মাতৃদেবীর আহবানে সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া আগাইয়া গিয়ে শুনিলাম গাড়িতে লোক একজন বেশী হইয়া গিয়াছে। উহাদের কাহাকেও ফেলিয়া রাখিয়া যাওয়া চলিবে না, এদিকে মাতৃদেবীরও আমাকে প্রয়োজন, উনার স্বপন মামার নিবাস আমি ছাড়া আর কেহ চিনেনা। কাজেই ঠিক হইলো ড্রাইভার স্বয়ং থাকিয়া যাইবে, আমি গাড়ী লইয়া যাইব। এক্ষণে কইন্যাটিকে ড্রাইভারের পেছনের সিটে উপবিষ্ট দেখিয়া আনন্দে আপ্লুত হইলাম। যদিও আমি এই বেয়াড়া গাড়ীটিকে চালাইতে কখনই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা, তথাপি আজিকের দিনে উহাই আমার সবচাইতে প্রিয় গাড়ীতে পরিণত হইল।

যাহা হউক, আমিও যথারীতি ভাবের সহিত গাড়ীতে উপবেশন করিয়া রিয়ারভিউ মিররে কইন্যার পরিবারের অস্বস্তি উপলব্ধি করিতে পারিলাম। সফেদ গুম্ফপরিমন্ডিত চালকের বদলে এই পুঁচকা ছোড়া গাড়ী চালাইয়া লইয়া যাইবে ভাবিতে অনেকেরই সন্দেহ হইতে পারে। উহা উপলব্ধি করিয়া আমার মাথায় শয়তানী খেলিয়া গেল যে প্রেম হউক আর না হউক, আজিকে উহাদের জানের ডর দেখাইয়া ছাড়িব। শীতের ওই শান্ত সকালে আমি তীর বেগে গাড়ী লইয়া কুড়িগ্রাম শহর হইতে বাহির হইয়া আসিলাম।

বেয়াড়া টাইপের সাদা ল্যান্ড রোভারখানি সেইদিন কি করিয়া যেন আমার হাতে পঙ্খীরাজ হইয়া উঠিল। যতই আঁকাবাঁকা করিয়া চালাইতে চাই, গাড়ী আমার সোজাই চলে। ইহার পর ক্রমেই আমার দৃষ্টি সাইড ভিউ মিররে আটকাইয়া যাইতে লাগিল। ছোট্ট আয়নাটি জুড়িয়া গোলাপি একখানি মুখ বারংবার আমার মনোযোগ কাড়িয়া লইতে লাগিল। এইদিকে পুঁচকা ড্রাইভারের গাড়ী চালনায় আশ্বস্ত হইয়া সকলেই মনে হয় খানিকটা স্বস্তির সহিত আরাম করিয়া বসিল। তরুণীর চোখ মুখ হইতেও ভয়ের চিহ্ন বিদায় লইয়া প্রশান্তির ছায়া পড়িল। মাঝে মাঝেই সাইড ভিউ মিররে উহার সহিত চোখাচোখি হইতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ উহার চোখে স্পষ্ট শাসনের ছায়া দেখিতে পাইয়া ভীত হইয়া উঠিলাম। শান্ত দিঘীর ন্যায় চোখ জোড়া আমাকে যেন ডাকিয়া বলিল "ওই ব্যাটা, সামনে দেইখা গাড়ী চালা, তোর পিছে দশ মাইলের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ নাই "। ডরাইয়া গিয়া গাড়ী চালনায় মনোযোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আয়নায় চাহিয়া সেই চোখে উপচীয়মান কৌতুক দেখিয়া মনটা আনন্দে ভরিয়া উঠিল।

রংপুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমার অবস্থা চান্দুর ন্যায় হইয়া উঠিল। বন্ধুগণকে এই বলিয়া আশ্বস্ত করিলাম যে - সমস্তটাই ধরলার পাড়ে করা প্লান মোতাবেক আগাইতেছে। কিন্তু আমি নিজে জানি যে কোন কিছুই প্লান মোতাবেক হইতেছেনা। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা আমি উহাকে চক্ষের সন্মুখে দেখিতে পাইতেছি। এমতাবস্থায় একদা কনিষ্ঠা ভগ্নীর নিকট মনের সকল কথা ভাঙ্গিয়া কহিলাম। সে অতি উৎসাহে জানাইল যে চান্দুর পছন্দ করা মেয়েটি তাহারই সহিত একই শ্রেণীতে অধ্যায়নরতা। কাজেই কয়েকদিনের মধ্যেই উহার হস্তে চান্দুর প্রেমপত্র পৌঁছাইয়া দেওয়া হইলো। কোন এক শুভক্ষণে উহাদের প্রণয় পর্ব শুরুও হইয়া গেল।

সময় গড়াইয়া যায়, কিন্তু প্লান মাফিক আমার প্রেমে পড়া আর হয়না। চান্দু এবং তাহার প্রেমিকা ভীত সন্ত্রস্ত জীবনযাপন করে, কবে যেন উহারা ধরা পড়িয়া যায়। কাজেই আমাদিগকে দ্রুত একশন প্লান লইতে হইলো। শম্পা তখন সদ্য সদ্য কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে ভর্তি হইয়াছে। রোজ সকালে সে বাড়ী হইতে উহার বান্ধবীর সহিত হাঁটিয়া হাঁটিয়া পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়া কলেজে যায়। আমাদের কল্যাণে উহাদের যাত্রা পথে সমস্যা সৃষ্টি করে এমন কোন আদম সন্তানের জন্ম তখনও হয় নাই। এই অবস্থায় একদিন সকালে দূত মারফত উহার হস্তে আমার লেখা প্রেমপত্র পৌঁছাইয়া দেওয়া হয়। পত্রটিতে একটি লাইনই লেখা ছিল - "ভালবাসি তোমাকে"।

কইন্যা পরদিন হইতে কলেজে যাইবার কালে আমাকে খুঁজিত, কিন্তু হোস্টেল হইতে সাজিয়া গুজিয়া বাহির হওয়া অতি লাজুক আমি কোনমতেই উহার ত্রিসীমানায় যাইতে পারিতাম না। পরের সপ্তাহে উহারা একদা পত্রবাহককে রাস্তায় পাইয়া আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে এবং নারী হস্তের থাবড়ার ভয়ে ভীত হইয়া  পত্রবাহক আমার যাবতীয় ডিটেইলস উহাকে বলিয়া দেয়।

এই ঘটনার ২ দিন পর আমার ভগ্নী একদা স্কুল হইতে ফিরিয়া আমার হস্তে একখানি মলাট করা পাঠ্য পুস্তক ধরাইয়া দিয়া বলিল যে, শম্পার বান্ধবী উক্ত পুস্তকখানি আমাকে দিতে বলিয়াছে। যারপরনাই উৎকণ্ঠিত হইয়া আমি পুস্তকটির সকল পৃষ্ঠা ঘাঁটিয়াও কোন ক্লু খুঁজিয়া না পাইয়া বেকুব হইয়া বসিয়া রহিলাম। হঠাৎ কি মনে করিয়া পুস্তকের মলাট টানিয়া খুলিতেই ভেতর হইতে একখানি সুগন্ধি পত্র বাহির হইয়া পড়িল। কম্পিত হস্তে উহা খুলিয়া আমার এক লাইনের জবাবে দুই লাইন কবিতা দেখিতে পাইলাম

প্রহর শুরুর আলোয় রাঙা সেদিন পৌষ মাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ ...

মুহূর্তে প্রশান্তিতে ভরিয়া গেল মন। বাহির হইয়া গিয়া বন্ধু মহলে ঘটনা বর্ণনা না করিয়াই উহাদের একচোট খাওয়াইয়া দিলাম, ফলে উহারা বুঝিয়া গেল যে শুভ কিছু ঘটিয়াছে। রাত্রিতে বাসায় ফিরিয়া অনেক সাধ্য সাধনা করিয়া আরেকখানি পত্র রচনা করিয়া ভগ্নীর হস্তে প্রদান করিলাম। এইভাবে আমাদের পত্র প্রেম মাসাধিককাল চলিলেও দেখা সাক্ষাতের কোন উপায় খুঁজিয়া পাইলামনা। এমনি সময় আমার পিতা বাসা বদল করিয়া এমন এক স্থানে বাসা লইলেন, যেই বাসার পার্শে উহার এক বান্ধবীর বাসা রহিয়াছে, যে স্থানে সে প্রায়শই যাতায়াত করিত।

উহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় আমাদের বাসাতেই। নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় বাসায় মেয়েদের আগমনে আমার মাতৃদেবী মোটেও বিচলিত হইতেননা, কাজেই উহাদের আগমনেও হন নাই। কিন্তু শম্পা ইচ্ছায় হউক আর বিব্রত হেতু হউক, প্রথম দিনেই মা জননীকে দেখিয়া মাথায় ওড়না দ্বারা ঘোমটা টানিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়া কদমবুচী করিয়া ঘোষণা করিয়া দিয়াছিল যে, সে এই বাড়ীর বিশেষ কেহ হইবার তালে রহিয়াছে। জননীও উহাকে বুকে টানিয়া লইয়া, গণ্ডদেশে চুম্বন করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে ইহাতে তাঁহারও কোন অমত নাই।

শম্পা আমার প্রেমিকার চাইতে বন্ধুই বেশী ছিল। যতক্ষণ একসাথে থাকিতাম, আমরা একে অপরকে খেপানোতেই বেশী মনোযোগী থাকিতাম। তবে শর্ত ছিল প্রতিদিন ভালবাসায় পরিপূর্ণ একখানি পত্র উহার হস্তে পৌঁছাইয়া দেওয়া লাগিবে। বৎসরাধিককাল এইভাবে চলিবার পরে উহার পিতা উহাদিগকে লইয়া রাজশাহীতে গমন করেন এবং আমার প্রেম পর্ব স্থগিত হইয়া যায়। পরে আমি উচ্চশিক্ষার্থে রাজশাহীতে গমন করিলে তিন বছর পরে আবার আমাদের প্রেমের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। সেই সময় শম্পা মাঝেমাঝেই আমাদের কলেজে আসিতো এবং সারা কলেজ আমার হাত জড়াইয়া ধরিয়া হাঁটিয়া বেড়াইত সবাইকে জানাইয়া দেওয়ার জন্য, যাহাতে আমি আর নতুন কোন প্রেম করিতে না পারি।

এমতাবস্থায় আমার পিতামাতার সহিত উহার পিতামাতা পর্যায়ের আলোচনার ধার্য হয় যে আমার অনার্স শেষ হইলে আমাদের বিবাহ হইবে।

কিন্তু উহার বেরসিক পিতা ভাল ব্যাংকার পাত্র পাইয়া বিনা উস্কানিতে এক রাত্রিতে উহার আক্‌দ পড়াইয়া দেন।

[ আমার প্রেমিকারা নামক অর্ধ সত্য ধারাবাহিকের ইহাই শেষ পর্ব। এই বোরিং গল্পগুলি দেবার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল, পাঠকের কাছে গতানুগতিক প্রেমের গল্পের বাইরে ভিন্ন মাত্রার রম্য স্টাইলের একটি লেখা উপস্থাপন করা। সবাইকে ধন্যবাদ ]



              ভেটকি মাছ ও কানা বেড়ালের গল্প

 

এক ধরনের মানুষ আছে যারা কখনো কোনও কিছুতে কথা বলেনা, যারা জানে অন্যের সমস্যায় নাক গলিয়ে লাভ নেই। আর এক ধরনের মানুষ আছে যাদের সবার ব্যাপারে শুধু নাক না,পুরো শরীর গলানোর বিশ্রী অভ্যাস আছে। তারা এও বুঝেনা যে এইসব দেখলে রাগে গাটা জ্বলতে থাকে। আশিক দ্বিতীয় দলের মানুষ।


ওর সাথে আমার পরিচয়টা খুবই অপমান জনক টাইপের হাস্যকর।

তখন সবে মাত্র নতুন বাসায় উঠেছি আমরা। আগের বাসাটা আমার ভার্সিটি আর নিপুর কলেজের জন্য অনেক দূরে হয়ে যায়। তাই অনেক দিন ধরেই আব্বু ভালো একটা বাসা খুজছিলেন,কিন্ত মনের মত পাচ্ছিলেন না। আমাদের ভাগ্য ভাল আব্বুর এক কলিগ,ইকবাল আঙ্কেল এই এলাকাতেই থাকেন। তারই পরামর্শে এখানে বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছে। আঙ্কেলদের বাসা আমাদের উলটা দিকেই। এলাকাটা আসলেই সুন্দর। আগেরটার মত এত ঘিঞ্জি না। কিন্তু এখানে এসেই আমার সাথে যা হল,আমি কখনই ভুলবোনা।
যেদিন আমরা এসেছি তার দুদিন পরের কথা। ঘর গোছানো শেষ। বিকেলের দিকে আমি নিপুকে নিয়ে বের হয়েছিলাম একটু মার্কেটে যাব বলে।

কথা বলতে বলতে আমরা হেটে যাচ্ছি,হঠাৎ দেখলাম নিপুর হাঁটু আর আমার মাথা একি লেভেল এ।
ছোটবেলা থেকে আমি খেয়াল করেছি সোজা পথ আমি হেঁটে পার হতে পারবনা,মাঝে কোনও না কোনও একটা ঝামেলা হবেই। হয় পড়ে যাব,নাহয় ধাক্কা খাবো...একবার কোনও হোঁচট খাওয়া ছাড়া ভার্সিটি থেকে বাসায় চলে এসেছিলাম। শুধু বাসায় ঢুকতে যাব তখনি কাকের বাচ্চা কাক দিলো আমার উপর...ঈঈঈঈঈঈ...চিন্তা করেই বমি আসছে। বলা যায় আমার সাথে এরকম ফালতু কিছু হবেই,এটা একটা নিয়মের মত হয়ে গেছে।

কিন্তু তাই বলে সেদিনও এক গণ্ডা মানুষের সামনে? কোন এক বজ্জাত কলা খেয়ে তার খোসাটা রাস্তাতেই ফেলে গেছে। আর তাও পড়লো ঠিক আমার পায়ের নিচেই। আমিও দেখিনি যার ফলে স্লিপ খেয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনাই যে কি হল আসলে? কয়েক সেকেন্ড মাটিতে পড়ে আমি চিন্তা করছিলাম যে একটা গর্ত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু হাহাহা হিহিহি হাসির শব্দ শুনে এটা বুঝতে কষ্ট হয়নি যে বেইজ্জতী এখনো শেষ হয়নি। আমার চেহারা টা সম্ভবত কান্না আর রাগ মিলিয়ে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গিয়েছিলো। আমি দেখলাম সবচেয়ে বেশী চিৎকার করে যে ছেলেটা তখন হাসছিল সেই এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসির দমকে তার হাত আর মাথা দুটোই সমান তালে কাঁপছে। নিপুও তাড়াতাড়ি ধরতে আসলো। আমি ওদের সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়ালাম।
''কেউ পড়ে গেলে এভাবে বেহায়ার মতো হাসতে হয়?'' আমি নিপুর দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি মেরে বললাম।
ওমা,বেয়াদব ছেলে ''ঠিক বলেছেন,হাসাটা একদমই উচিৎ হয়নি'' বলে আবারও পেট চেপে হাসতে লাগলো!

আমি কথা না বলে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে। নিপু কোন কথা না বলে আমার সাথে হাঁটা দিল। ও জানে আমি রেগে গেলে আমাকে যাই বলুক না কেন আমি শুনবোনা।
পেছন থেকে ছেলেটা আবারো ডাক দিলো
''আপাগো,আল্লাহ আপনাকে যথেষ্ট লম্বা বানাইসে। হিল না পরলে কি হয়?'' বজ্জাতটা আমাকে রাগানোর জন্যই এসব বলছে। আমি হিল তেমন পরিনা।
''ওই ব্যাটা,তোর কি?''
আমার কথা শুনে আরও একটা ভেটকি মাছের মতো হাসি দিলো।

পরের দিন আমি রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম যে গতকালের ভেটকি মাছটা উলটো দিকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর আমার দিকে হেঁটে আসতে লাগলো। যাক,বোধ হয় কালকের জন্য সরি বলবে। আমি একটু ভাব নিয়ে দাঁড়ালাম। এত সহজে মাফ করবোনা।
ছেলেটা আমার ৩ হাত দূরে দাঁড়াল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
''আজকে আবারো হিল পরে বের হয়েছ? এবার যদি আছাড় খাও তাহলে আর তুলতে আসবনা বলে দিলাম''
এত অপমানজনক একটা কথা শুনে আমার কি করা উচিত ছিল জানিনা,কিন্তু আমি হিহি করে হেসে দিলাম। আসলে ওর বলার ধরণটাই এমন ছিল,যেন আমরা অনেক পুরনো বন্ধু।
বলা বাহুল্য,এই ছেলেটাই আশিক। ইকবাল আঙ্কেলের ছোট ছেলে।


আমার আম্মু আর আশিকের আম্মুর মাঝে ভারি ভাব হল। আম্মু কিছু রান্না করলে ও বাসায় এক বাটি পাঠাবেই,আর আশিকের আম্মুও একই কাজ করেন। বলা যায় অনেক আন্তরিক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের দুই পরিবারের মাঝে। নতুন এলাকাতে অনেক ধরনের সমস্যা হয়,কিন্তু আশিকের ফ্যামিলির কারনে আমাদের কোন কষ্টই হয়নি।

তো এভাবেই চলছিল আমার জীবন। রোজকারের ছোটোখাটো ঝামেলা ছাড়া আমার জীবন অনেক আনন্দের বলতেই হবে। বাসায় আব্বু আম্মু আর আমার বিচ্ছু বোনের সাথে আড্ডা,আর বাইরে বন্ধুরা তো আছেই। এর সাথে যুক্ত হল আশিক নামের বাঁদর। আমার জীবন কে যাকে বলে একদম ছ্যারা ব্যারা করে দিলো সে। আমার বাসায় এসে ওর হাব ভাব দেখলে মনে হয় বাসা তার,আমাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। আমি না থাকলে আমার বই,সিডি নিয়ে যায় (কারন আমি থাকলে নিতে পারেনা) । আর ফিরিয়ে দেয়ার নাম নাই। বেশ কয়েকবার ফেরত চেয়েছিলাম দেখে বলেছিল হারিয়ে ফেলেছে। তারপর আবার গানও গায় ''ফিরিয়ে দাও আমার বই তুমি ফিরিয়ে দাও,আমার সিডি তুমি ফিরিয়ে দাও...এভাবে মেরে দিও না...''

আমার খুব রাগ হয় এসব শুনে। বেহায়াপনারও তো একটা লিমিট থাকে। কিন্তু আশিকের কোন লিমিট নেই। সরি তো বলেই না উলটা দেমাগ দেখায়। বলে ''এরকম ফকিরের মতো করিস,তোর লজ্জা লাগেনা? যা আমি তোকে সব নতুন কিনে এনে দিব'' কিন্তু সেই নতুন সিডি বা বইয়ের নাগাল আমি কখনই পাইনা। আর সুযোগ পেলেই বলে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। কি লজ্জার ব্যাপার!


আশিককে আমি কখনো তেমন রাগ করতে দেখিনি। একবার শুধু দেখেছিলাম। সেদিন ক্লাস থেকে বাসায় আসছিলাম। আমাদের পাড়ারই একটা ছেলে আমাকে বাজে কিছু কমেন্ট করেছিল। আমিও পাল্টা থাপ্পর দিয়ে এসেছি। আমি খুব লড়াকু ধরনের মেয়ে। মারামারিতে এক্সপার্ট। স্কুলে থাকতে আমার ক্লাসের একটা মেয়ে আমাকে আন্ধি বলেছিল দেখে আমি ওর চুল টেনে,চড় মেরে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলেছিলাম। ফলাফল অভিভাবকের কাছে অভিযোগ আর আম্মুর হাতে উত্তম মধ্যম। লাভের মধ্যে লাভ হল,এই ঘটনার পর থেকে আমাকে কেউ আর উল্টাপাল্টা কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু সেদিন বাসায় এসে বুঝলাম না কি হল,শুধু কান্না পাচ্ছিলো। এমনিতে আমি অনেক শক্ত মেয়ে। কিন্তু শক্ত মেয়েদেরও মনে হয় মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। আশিক বাসায় এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। কিন্তু আমি আমার রুমের দরজা খুললাম না। আমার কান্না কাটি দেখে আমাকে আবার খেপাবে। ওকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না। ও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো।

বিকেলে নিপু এসে বলল আশিক নাকি কোন ছেলের সাথে মারপিট করে এসেছে। গিয়ে দেখলাম আশিক সাহেব ড্রয়িং রুমের সোফায় পা তুলে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছে।
''শুনলাম আজকাল তুই গুন্ডা রাজের রোল প্লে করছিস''
ও ভেংচি কেটে আবার চায়ে চুমুক দিল। ''জরুরি কাজ করছি,বিরক্ত করিস নাতো'' টাইপের এক্সপ্রেশন। ওর ভাবের যেন কেউ কেয়ার করে!
''কার মাথা ফাটালি আজকে?'' আমি আবার জিগ্যেস করলাম।
এবার হাসিমুখে জবাব দিল সে ''তুই যাকে সকালে চড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়েছিস তার''
এবার আমি আসলেই অবাক হয়ে গেলাম। ও আমার জন্য মারামারি করতে গেছে?
''মারামারি করতে গেলি কেন?''
''তুই কাঁদলি কেন?''
''আমি কাঁদলে তোর কি?''
ও জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে থাকলো। তাকানোটা স্রেফ তাকানো না। ওই চোখের দিকে তাকালে অনেক কিছু বোঝা যায়। ওর সাথে পরিচয়ের পর থেকে এত দিনের মাঝে এমন কখনো হয়নি যে ও কোন কথার জবাব দেয়নি। প্রত্যেক ব্যাপারে ওর মুখে কথা রেডি থাকে। আজকে সে ছেলে কিছুই বললনা...কিন্তু এই প্রথম বারের মত আমি ওর নিশ্চুপতার মাঝেই সব শুনে ফেললাম।

মেয়েদের মাঝে মনে হয় এক ধরনের বিল্ট ইন ডিভাইস থাকে যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি কেউ আমাদের একটু অন্য চোখে দেখছে নাকি। আমিও বুঝে গেলাম এবং প্রচণ্ড ভয় পেলাম। হায় হায়,ওকি আমার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? ও ফাজলামি করে,আমাকে নিয়ে হাসা হাসি করে এতটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ও আমাকে ন্যাকা স্বরে ভালবাসি বলছে এটা কল্পনা করেই আমার মাথা প্রচণ্ড ব্যাথা করতে লাগলো।

আমার দ্বারা ভালবাসা টালবাসা সম্ভব না। এইসব পুতুপুতু টাইপের ন্যাকামি আমার অসহ্য লাগে। আমি ঘোর প্রেম বিদ্বেষী নারী। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে যারা প্রেম করে তাদের ঢং দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই । ছেলে মেয়ে গুলোর যেন আর কোন কাজ নেই,সাররাত ফোনে গুটুর গুটুর করে। আর দিনের বেলা পড়াশোনা না করে ঘোরাঘুরি করে। যত এসব নিয়ে ভাবি ততই মাথাটা গরম হয়ে যায়। শুধু মাত্র প্রেমের কথা শুনেই আমার এই অবস্থা,আর প্রেম করলে যে কি হবে সেটা বুঝতে আমার আর বাকি থাকলোনা। আমি ঠিক করলাম আজকে থেকে আশিক কে এটাই বুঝাতে হবে যে ভালবাসা ভালো না। আর আমাকে ভালবাসা মানে তো জীবনের চরম ভুলগুলোর একটা। প্রথমে মনে হল ওর সাথে কথাই বলবোনা। পরে মনে হল সম্ভব না। আফটার অল,আমার এত ভাল বন্ধু...ওকে আমি এভাবে মাঝরাস্তায় কিভাবে ফেলে যাই? বাঁদরটা নাহয় একটা গাধামি করে ফেলেছে। আমি তো ওকে এভাবে ভুল করতে দিতে পারিনা। মনে মনে বললাম,আজকে থেকে শুরু হল মিশন ''রেস্কিউ আশিক'' ( বলতে লজ্জা নাই স্পাই মুভি দেখে দেখে আমার মাথা একদম নষ্ট হয়ে গেছে!)

কিন্তু সমস্যা হল কিভাবে কি করবো জানিনা। মানুষ প্রেমে পড়ে এটা জানি,প্রেম থেকে উঠে কিভাবে তাতো জানিনা! বান্ধবীদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলা সম্ভব না। আমি নেটে পর্যন্ত সার্চ দিলাম ''how to get someone fall out of ur love'' বিচিত্র সব রেসাল্ট। কোনটাই আশিকের উপর অ্যাপ্লাই করতে পারবোনা।
অনেক ভাবার পর আমার মনে হল,যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে আশিকের লাইন করিয়ে দেয়া যায়...তাহলে আমার প্রতি ওর প্রেম প্রেম ভাবটা উবে যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

এরপর থেকে আশিকের সাথে দেখা হলেই আমি ওকে শুধু অন্য মেয়েদের কথা বলতাম।
''জানিস,ইমতিয়াজ আঙ্কেলের ছোট মেয়েটা না তোকে পছন্দ করে''
''এই তুই বুঝিস না? আমাদের দোতলার মেয়েটা তুই খেলতে বের হলেই বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে''
''আশিক,লাবন্য ( আমার বান্ধবী ) তোর জন্য একদম ফিদা''
''রুমকি তোর নাম্বার চাইছিল,দিব ?'' ইত্যাদি ইত্যাদি
প্রথম কয়েকদিন ও কিছু বলেনি,শুধু শুনে যেত। কিন্তু একদিন একদম ক্ষেপে গেল
''আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগে এটা বললেই তো হয়,হুদাই প্যাঁচাল পারিস কেন? যা আর তোর সাথে কথাই বলবনা''
এই বলে সে চলে গেল।


আমি আশিক কে কি উদ্ধার করব,সেদিনের পর থেকে সেই দেখি আমাকে এভয়েড করছে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে,ডাকলেও না শোনার মত করে হেটে চলে যায়। প্রথম কয়েকদিন ভেবেছিলাম ও আসলেই ব্যাস্ত। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম ও ইচ্ছা করেই এমন করছে। একদিন আমার বাসায় এসে আমার সব সিডি আর বই দিয়ে গেল।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম '' তুই না বললি এগুলো হারিয়ে ফেলেছিস?'' ওর অবস্থা দেখে মনে হল যে অন্ধের সাথে সাথে কালাও হয়ে গেছে।
শুধুমাত্র বেরিয়ে যাবার আগে আমার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল ''নিপু শোন,সবাইকে বলে দিস আমি কারো জিনিস নিজের কাছে রাখি না...তোর কানা বোনকে বলিস দেখে নিতে সব ঠিক আছে কিনা''

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। এরকম কেন করছে ও? ভয়ঙ্কর মন খারাপ হল আমার। আর অনেক অনেক অভিমান। ওর ভাল করতে গিয়ে আমি খারাপ হয়ে গেলাম? আমি ঠিক করলাম আমিও ওর সাথে কথা বলবনা। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।


এরপর বেশ কিছুদিন আশিকের সাথে কথা হয়নি। আসলে ওকে তেমন চোখেই দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কি আমি ওকে অনেক মিস করতাম।
এত প্রাণবন্ত ছেলে..ও আসলে বাসায় উৎসবের আমেজ পাওয়া যেত। এখন কেমন মরা মরা হয়ে থাকে সব।উহু,সত্যি কথা হল আসলে আমিই মনমরা হয়ে থাকি।
যাই হোক,একদিন ফেসবুকে গুতোগুতি করছি এমন সময় আশিকের প্রোফাইলে দেখলাম নতুন একটা অ্যালবাম আপলোড করেছে...ওর ছবি গুলো অনেক মজার হয়। তাই আমিও খুলে দেখতে লাগলাম। কমেন্ট করতে অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল কিন্তু করলাম না।
একটা ছবি দেখলাম এক মেয়ের সাথে তোলা। খুব নরমাল ছবি। কিন্তু দুজনকে অনেক মানিয়েছে একসাথে।

দিবনা দিবনা করেও কমেন্ট করে দিলাম ''তোদের দুজনকে অনেক ভালো লাগছে,এটা প্রো পিক দে''
কিন্তু কেন যেন মেজাজটা খারাপ লাগছিল,তাই ৫ মিনিট পর আবার রিমুভ করে দিলাম। আশিক অনলাইনে ছিলনা,থাকলে আমার কমেন্ট দেখে কিছু না কিছু বলতই। দেখে নাই ভাল হয়েছে।
সেদিন রাতে আমি আজব একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম খুব ধুমধাম করে আশিকের বিয়ে হচ্ছে,আর আমার সাথে ও নিজের বউ এর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এই বলে যে ''দিশা,এটা তোর ভাবী''
স্বপ্নটা দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং জানিনা কেন যেন আমার সারারাত আর ঘুম এল না।


পরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে গেলো। আমার আর কিছুই ভাল লাগেনা। সারাদিন শুধু আশিকের কথা মনে পড়ে। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। এর মাঝে নিপু আমাকে একদিন বলল ''আশিক ভাইয়ার সাথে আজকে একটা মেয়ে দেখলাম।''

কোন মেয়ে,কিভাবে কথা বলছিল,রিক্সায় কিভাবে বসেছিল,আশিক কি বেশি হাসছিল না কম হাসছিল? আমার এসব প্রশ্নের যন্ত্রনায় নিপু আর না পেরে রুম থেকেই চলে গেলো। ঠিকই তো? আমার এত গরজ কিসের? ও কার সাথে ঘুরে ফিরে তা আমার দেখার বিষয় না,এবং আজকে থেকে আমি এসব নিয়ে একদমই চিন্তা করবোনা...এরকম অনেক কথা নিজেকে বললাম। তারপর আমি আমার ল্যাপটপ অন করে ফেসবুকে ঢুকলাম। এবং আবারো আশিকের প্রোফাইলেই। আশিকের প্রোফাইল পিকে এবার সেই মেয়েটার সাথে ছবি। আগে যেটা দেখেছিলাম সেটা না। নতুন তোলা। আমি ছবিটা থেকে একদম চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কোন কারন ছাড়াই মনটা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় নিপু আবার এল। ল্যাপটপের ছবিটা দেখে বলল
''আচ্ছা,তলে তলে তাহলে এই কাণ্ড?''
''কি কাণ্ড?''
''আরে এই মেয়েটাকেই তো দেখলাম আজকে। নিশ্চয়ই আশিক ভাইয়ার গার্ল ফ্রেন্ড''
সম্ভবত আমি এমন কিছুই আশা করেছিলাম। কিন্তু নিপু কনফার্ম করার পর আমার মনে হল নিপুকেই কষে একটা থাপ্পর মারি। পৃথিবী নামক বস্তুর উপর আমার অসম্ভব রাগ লাগছিল। মনে হচ্ছিলো আমি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। আমি অনেক একা। কিন্তু আমিতো এটাই চেয়েছিলাম।
মিশন ''রেস্কিউ আশিক'' সফল। তবুও আমার এত খারাপ কেন লাগছে?


কিচ্ছু ভাল লাগেনা আমার...কি যে করি? এক এক বার ইচ্ছা হয় আশিক কে গিয়ে দুটা ঘুষি মেরে আসি। তাতে আমার মনে একটু শান্তি লাগবে। আবার মনে হয় এসব পাগলামির কোন অর্থই নেই। ও যখন আমার দিকে ভালবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল আমি তখন ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম। আমি এত ভিতু কেন? কি এমন হত ওকে ভালবাসি বললে? তারপর আবার মনে হয়,ও যদি সত্যি আমায় ভালবেসেই থাকে তবে এত জলদি অন্য মেয়ের সাথে কিভাবে রিলেশন করে? আমার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করলে এমন কি ক্ষতি হয়ে যেত? এসব চিন্তা করে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার যোগাড়। আমার মনে হল, আমার সব প্রস্নের জবাব আশিকই সবচেয়ে ভাল ভাবে দিতে পারবে...ওর সাথে দেখা করাটা খুব দরকার।
ওকে ম্যাসেজ দিলাম,রিপ্লাই দিলনা। কল করলাম,রিসিভ করেনা। বুঝতে পারছি,এভাবে হবে না...


পরের দিন আমি আশিকের ভার্সিটি গিয়ে হাজির। আর কোন ভাবে ওকে ধরা সম্ভব না। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটাকে সামনা সামনি দেখা। আমার শয়নে স্বপনে যেভাবে মেয়েটার ছবি দেখছি তাতে এক একবার মনে হয় আমিই ওর প্রেমে পড়ে গেছি! এটা ঠিক,দেখার পর আমি কি করবো সেই ব্যাপারে আমার আইডিয়া একদমই নাই। তবে রিঅ্যাকশন খুব খারাপ হবে আমি জানি। যাই হোক,আশার কথা হল আজকে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। রিক্সাঅলা ভাই আজকে পঙ্খিরাজের মত রিক্সা চালিয়েছেন, কাক কোকিল কোন কিছুই আমাকে ঠোকর ও মারেনি বা আমার গায়ে ইয়ে ও করেনি...যততুকু পথ হেঁটেছি কোন প্রবলেমই হয়নি। আজকে একেবারে যাকে বলে ''আমার দিন''

ক্লাস শেষে আশিক বের হল। আমি পেছন দিকে ছিলাম বলে ও আমাকে খেয়াল করেনি। অনেক ক্ষন দেখলাম ফেসবুকের মেয়েটাকে দেখা যায় নাকি। দেখলাম না। আজকে আসেনি নাকি? আশিক ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের চায়ের দোকানে ঢুকল। এই সুযোগ । সবে মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিবে তখনি আমি ওর সামনে গিয়ে বললাম ''তোর সাথে জরুরি কথা আছে,একটু বাইরে আয়''
হিহিহি...ওর চেহারা যা হয়েছিল না,খাবি খাওয়া মাছের মত...ওর বন্ধুরা একবার আমাকে দেখে,একবার ওকে দেখে...নিজেকে চিড়িয়া খানার জন্তু মনে হচ্ছিলো। তাই কথাটা বলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটু পর বাঁদরটা বেরিয়ে এল
''তুই এখানে কেন?''
''কেন? আসলে সমস্যা?''
ও কিছু বললনা।
ভাবলাম যা বলার এখানেই বলে ফেলি ''তোর গার্ল ফ্রেন্ড কই?'' আমার কথা শুনে রাগে আশিকের চেহারাটা লাল টমেটোর মত হয়ে গেলো।
'',এই কথা জানতে এখানে আসলি?''
''তুই তো দেখালি না,তাই আমিই চলে আসলাম...লাবন্য,রুমকিদের কথা শুনে খুব তো তখন ভং ধরেছিলি । তা তোর মনের মধ্যে যে অন্য জিনিস ছিল আমাকে বললেই হতো ''
''ফালতু কথা বলে মেজাজ খারাপ করিসনাতো...''
''এখন ফালতু কথা হয়ে গেলো? আমাকে বললেই হত তোর অন্য মেয়ে কে ভাল লাগে ''
''তোকে কেন বলব? তুই কে? ''
''আমি কেউ না? তাহলে সেদিন কেন আমার জন্য কেন মারামারি করতে গিয়েছিলি ? আমি কাঁদলে তোর কি?''
''কথাটা নিজেকে জিগ্যেস করে দেখ,দিশা...আমার মনে হয় তুই আরো ভালো ভাবে জানিস''
''আমি কিভাবে জানব?''
''ঠিক...তুমিতো জানবানা...মাত্র কালকেই তো জন্মাইলা.....শুনে রাখ,আমি যদি ভং ধরি তাহলে তুই ঢং করিস''

অসম্ভব কান্না পাচ্ছে আমার। কেন এসেছি আমি এখানে? কি দরকার ছিল? আমি হাঁটা শুরু করলাম। আর কোন কথা বলবনা আমি এই বদ ছেলের সাথে। এই শেষ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। আমি ''আজকে আমার দিন'' থিওরিকে মিথ্যা প্রমানিত করে আবারো আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। আর ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। আশিক তাড়াতাড়ি আমাকে তুলতে এলো। আশেপাশের সবাই হাসছে। চড় দিয়ে সবগুলোর দাঁত ফেলে দিতে পারলে ভাল লাগত আমার। কিন্তু আজকে আমার কপালই খারাপ। আজকে ওদের হাসার দিন।
আমি নাক টানতে টানতে আশিকের উপর ভর দিয়ে উঠলাম। পায়ে খুব ব্যাথা হচ্ছে। নাড়ালেই টান লাগে।
''আমাকে সিএনজি ঠিক করে দে,আমি চলে যাব''

ভয়ঙ্কর গরম চোখ নিয়ে ও আমার দিকে তাকাল। ওরে বাবা,সে চোখের যা দৃষ্টি..আমার আর কিছু বলার সাহস হলনা। এমনিতে আমি বাঘের বাচ্চা,কিন্তু ওর সামনে এরকম মেনী বিড়াল কেন হয়ে যাই? কয়েকটা নড়বড়ে বেঞ্চ ছিল ওখানে,আমার হাত ধরে সাবধানে একটা বেঞ্চ এর উপরে বসাল।
অনেকক্ষন চুপ থাকার পর আশিক বলল
''তোর সমস্যা কি আমাকে একটু বলবি?''
''আমার কোন সমস্যা নাই''
''আমার প্রেমিকা দেখার তোর এত শখ কেন?''
''একশ বার দেখব,হাজার বার দেখব''
আশিক হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে লাগলো। আমি আবার বললাম
''প্রেমিকা পেলে সবাইকে ভুলে যেতে হয়? তুই আমার কল রিসিভ করিস না,আমার সাথে কথা বলিস না...আমাকে দেখেও না দেখার ভান করিস...কেন? ''
''কি হবে কথা বলে? আমার ইচ্ছা করে না''
''তোর তাহলে কি সারাদিন প্রেমিকার সাথে ঘুরতেই ইচ্ছা করে?
''আমার ইচ্ছার কথা সত্যি জানতে চাস তুই?''
''জানতে চাই বলেই তো এখানে আসলাম।''
আশিক অনেক থেমে থেমে উত্তর দিল ''শোন তাহলে,আমার তোকে তুমি ডাকতে ইচ্ছা করে,তোর হাতটা ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে...ভালবাসি বলতে ইচ্ছা করে''
ওর প্রতিটা শব্দ যে সত্যি তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও লাগেনি। কিন্তু মাঝখানের ঘটনা গুলোর সাথে হিসাব মিলছেনা দেখে মেজাজটা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেলো
''আমাকে ভালবাসিস তো অন্য মেয়ের সাথে তোকে দেখা যায় কেন?'' রাগে ফেটে পড়লাম আমি

এক মুহূর্ত চুপ করে আশিক আবার বলল, '' এগুলো সব নিপুর আইডিয়া ছিল। ও শুরু থেকেই জানত আমি তোকে ভালবাসি। আর ওই বলেছিল যে তুইও আমাকে ভালবাসিস,কিন্তু কখনই মানবিনা। ছবির মেয়েটা আমার জুনিওর এক বোন। সেদিন রিমুভ করার আগেই তোর কমেন্ট আমি দেখে ফেলেছিলাম। আমি অফলাইন মোডে ছিলাম বলে তুই ভেবেছিস আমি দেখবোনা । একথা নিপুকে বলার পর ও বলেছিল তোকে জেলাস ফিল করানোর জন্য প্রো পিক চেঞ্জ করতে। বাকি সব ও দেখবে...ও যা বলেছে আমি ঠিক তাই করেছি।''

আর যাই হোক,এ কথা আশা করিনি। আমারই বোন আমার সাথে এরকম নাটক করলো! উপর অলার আসলেই কোন বিচার নাই। আজকে বাসায় যাই,নিপুর কপালে অনেক দুঃখ আছে আজ...
আমি আশিকের সামনে আর কথা বাড়ালাম না। শান্ত ভাবে বললাম ''আমাকে বাসায় দিয়ে আয়''

সিএনজি তে বসে আছি। আশিক সিটের ওই মাথায় আর আমি এই মাথায়। কোন কথা বলছিনা। আশিক মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় ওর মোবাইলে একটা এসএমএস এলো। ও একটু অবাক হয়েই ওপেন করলো ম্যাসেজটা। আমি আড়চোখে দেখলাম ম্যাসেজটা পড়ে ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। কি দেখে ও এত খুশী আমি জানি,কারন ওটা আমারই পাঠানো। এসএমএস এ লিখা
''আজকের পর থেকে আমাকে তুই বলে ডাকলে জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো। ''

আবারও সেই চিরায়ত ভেটকি মাছ টাইপের হাসি দিয়ে ও আমার দিকে একটু সরে আসলো। একটু ভয়ে ভয়েই মনে হয়,আমার হাতটা যখন ধরতে যাবে ঠিক তখনি আশিকের মোবাইলে কল এলো,ওপাশ থেকে কি বলছে শুনিনি। কিন্তু আশিকের জবাব ছিল ''তোর ভাবীকে বাসায় পৌছে দিতে যাচ্ছি''
খুবই গৎবাঁধা ন্যাকা টাইপের কথা। কিন্তু এ প্রথম আমার মনে হল...নাহ,শুনতে ভালোই লাগছে তো !



শেষ হয়েও হইল না শেষ :

আমি আর আশিক কেমন আছি সেটা বলি এখন। দুদিন পর পর ঝগড়া না করলে ওর পেটের ভাত হজম হয়না। তারপর আবার আসে আমার রাগ ভাঙাতে...মাঝে মাঝে এত অসহ্য লাগে যে কি বলব? কেন যে ওকে সহ্য করছি আমি নিজেও জানিনা। রাত বিরাতে মোবাইলে কল দিয়ে আমার ঘুমটাই নষ্ট করে দেয়। বৃষ্টি হলেই আমাকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় বর্ষা বিলাস করবে বলে। আমার ল্যাপটপ নিয়ে গুতোগুতি করে আর বলে এখন থেকে আমার সব জিনিস নাকি ওর সম্পত্তি।

তবে একটা কথা বলতেই হয়,ও যখন মাঝরাতে হঠাৎ করে কল করে বলে ''তোমাকে অনেক ভালবাসি'' আমার ঘুম ভাঙ্গা দুচোখে মনে হয় আবার স্বপ্ন নেমে এসেছে। যখন ঝুম বৃষ্টিতে আমাকে বলে যে আজকে আমরা রিক্সায় হুড ফেলে দিয়ে ঘুরব,মনে হয় আজ আর বৃষ্টি না থামুক...যখন ল্যাপটপে ''মাই প্রিন্সেস'' দিয়ে কোন ফোল্ডার খুজে পাই যেখানে আমার অজস্র ছবি যা আমি জানিও না ও কখন কোন ফাঁকে তুলেছে...নাহ বলতেই হবে,আমি আসলে অনেক বেশী ভাল আছি। [:)] [:)]

এখন প্রায় সময় ও আমার পাশে পাশে থাকে। আমার আবার আছাড় খাওয়ার অভ্যাস আছে কিনা...


           ভেটকি মাছ আর কানা বেড়ালের শুভ বিবাহ (২)

 

 

''আফা,হেই ব্যাটা এমনে শু কইরা উপর থেইক্কা লাফ দিল কেমনে? হে কি বান্দর নাকি?''
জেসমিনের প্রশ্নের আমি কি জবাব দিব বুঝতে পারলাম না। টোয়াইলাইট দেখছিলাম খুব মনোযোগ দিয়ে। [আজকাল আমি একশান মুভি বাদ দিয়ে ভালবাসায় পরিপূর্ণ মুভি দেখতে বেশী উৎসাহ বোধ করছি। প্রেম ভালবাসা জিনিসটা বড়ই ছোঁয়াচে,এসব দেখে আমার চোখ জলে টলটল করে!]


তো ক্লাইম্যাক্স এর মারামারি দেখে জেসমিনের এই প্রশ্ন। ওকে কোন কথা বলতেই ভয় লাগে। কয়েকদিন আগেই একটা সিনেমার ভিলেন দেখিয়ে বলেছিল
''আফা, আশিক ভাইজান একদম এই গুন্ডা লোকডার মত হাসে না?'' সেদিন আবার সামনে আশিকও ছিল। তবে  আশিক ওর চেয়ে এক কাঠি সরস।
''জেসমিন,তুমি ভুল বলেছ। আমি ভিলেনটার মত না,ভিলেনটাই আমাকে নকল করে। টানা এক সপ্তাহ আমার সাথে প্র্যাকটিস করার পরও দেখো অতটা ভাল ভাবে নকল করতে পারেনি''
জেসমিনের মা আমাদের বাসায় ছুটা কাজ করে। ব্যাক্তিগত কারনে তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়েছে। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না বলে আমাদের বাসায় রেখে গেছেন। জেসমিনের সবই ভাল,শুধু একটাই সমস্যা। সে স্টার জলসা আর জি বাংলার একনিষ্ঠ দর্শক।তার সব মুখস্ত কখন কোথায় কোন নাটক চলছে। এবং খুব কম বাংলা সিনেমা আছে যেটা সে দেখেনাই। আমার নাম নিয়েও তার সমস্যা। ওর মতে আমার নাম দিশা না হয়ে প্রিয়া হওয়া দরকার ছিল। ''আশিক প্রিয়া'' শুনে নাকি সেরকম একটা ফিলিং আসে।
আজকে হল সপ্তাহের ''নো সিরিয়াল দিন'' মানে রবিবার। আজকে তার সিনেমা দেখার দিন।
আবারও জিজ্ঞেস করল সে
''এই ফিলিমের নাম কি আফা?''
আমি ভয়ানক অস্বস্তি নিয়ে জেসমিনকে জবাব দিলাম ''টোয়াইলাইট''
নামটা শুনে কুটকুট করে হেসে দিল সে। ''এতো কিছু থাকতে আপনে টয়লেট দেখতাসেন ক্যান?''
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম । এই মেয়ে বলে কি?
''টয়লেট না জেসমিন। ''''টোয়াইলাইট''''। এর মানে সন্ধ্যা''
''ওই একই কথা আফা,যেই লাউ সেই তো কদু। সইন্ধ্যা কালে যায় বলে এইডা তো আর আলাদা না।''
এবার অবশ্য আমি ওর কথাকে শুনিনাই ভাব দেখালাম। বেশী পাত্তা দিলে ওর বকবকানি এখন চলতেই থাকবে।
''আফা,ইকটু দেখেননা কোথাও বাংলা সিনেমা চলে নাকি? মেলাদিন দেখিনাই''
আমি আবারও ওর কথা না শুনে ফিল্ম দেখতে লাগলাম। এবার ও একটু দুখি দুখি ভাবে বলতে লাগল
''আমাদের বাসায় তো টেলিভিশন নাই, তাই আপনেগো এখানে একটু দেখতে মন চায় আর কি? আমরা তো গরিব মানুষ। যাউকগা,আপনে তো টয়লেট পরেও দেখতে পারবেন। আমি তো আর পারুম না''
এবার আমি চ্যানেল চেঞ্জ করে দিলাম। জেসমিনের ইমোশনাল অত্যাচারের  জন্য না। এটা ওর স্বভাব। যখনি ওর কোন কিছু দেখতে হয় ও এসব কথাই বলতে থাকে। আমি চেঞ্জ করলাম কারন ''টয়লেট'' শব্দটা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েকবার শুনলে দেখা যাবে আমি মুভির আসল নামটা ভুলে 'টয়লেট' বলা শুরু করে দিবো! আমার কাছে ডিভিডি আছে,পরে একা একা দেখা যাবে।
সৌভাগ্য বশত একটা চ্যানেল পেলাম যেখানে বাংলা সিনেমা চলছে। আশিক বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গেছে। ওর সাথে কথা হবে আরো কয়েক ঘণ্টা পর। আপাতত বাসায় আমার আর কিছু করার নেই,তাই আমিও জেসমিনের সাথে ফিল্ম দেখতে লাগলাম। যা বুঝলাম তা হল-
শাবনুর নায়িকা,শাকিব খান আর ফেরদৌস নায়ক। ত্রিভুজ প্রেমের গল্প । তিনজনেই একই কলেজে পড়ে। শাবনুর হল কলেজের সেরা সুন্দরী...(মাশা আল্লাহ,অনেক নতুন একটা বিষয়)
শাকিব খান কলেজের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে (এটাও অনেক নতুন)
ফেরদৌস হল কলেজের সবচেয়ে ভাল এবং পড়ুয়া ছেলে (আর বললাম না)
ফেরদৌস ভাই চোখে দেখেন না। এবং তিনি আর শাকিব বেস্ট ফ্রেন্ড। এবং তারা দুজনেই আবার শাবনুরকে ভালবাসেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শাবনুর কাকে ভালবাসবে? ভাল ছেলে ফেরদৌস না প্লেবয় শাকিব কে কে কে কে কে কে..... আশিক থাকলে ঠিক এমন করতো ভেবে আমি হেসে দিলাম। জেসমিন ভাবল আমি অনেক মজা পাচ্ছি
''দেখলেন তো আফা,শাকিব খান কত্ত সুন্দর! মাসুম বাচ্চা! আপনের টয়লেট এর নায়কডারে কেমন ভুত ভুত লাগে।''
''চুপচাপ দেখো,আর কোন কথা বললে টিভি বন্ধ করে দিব কিন্তু!''
হুমকি কাজে আসলো। সিনেমাটা দেখাই এ মুহূর্তে জেসমিনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শুধু মাঝে মাঝে ও
''হায় হায়,এইডা কি করলি'' ''ঠিক হয়নাই,একদমই ঠিক হয়নাই'' ''মাইয়া তর মাথায় গদাম'' এই সব বলে বিড়বিড় করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর নিপু রুমে আসলো। সেও দেখি আমাদের মত খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তাকে জেসমিন আবার গল্পের প্লট বুঝিয়ে দিলো।
যে মুহূর্তে ওকে আমি বললাম যে ফেরদৌস অন্ধ।
নিপুর প্রথম কথাটা ছিল ''ও অন্ধ হলে পাওয়ার গ্লাস কেন চোখে?''
এবার আমিও খেয়াল করে দেখলাম,আসলেই তো! সেই তখন থেকে ফেরদৌস চোখে পাওয়ার গ্লাস দিয়েই ঘুরছে। হাসতে হাসতে আমার আর নিপুর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। 
জেসমিনের ব্যাপারটা পছন্দ হলনা,শাকিব খানের পর ফেরদৌস ওর প্রিয় নায়ক। ''আফা এইডা হল নায়কের ফ্যাশন। ফেরদৌস হল এই ফিলিমের ভদ্দর নায়ক। এইজন্যই চশমা পরসে। এগুলান আপনেরা বুঝবেন না''
আমি আর নিপু মাথা নেড়ে ''ঠিক বলেছ,আমরা বুঝবনা'' বলে আবার হাসি। হিহিহি




আজকে পহেলা বৈশাখ। দুপুরে খেতে বসেছি। আজকে সব আমার পছন্দের আইটেম। আলু ভর্তা,শুঁটকি ভর্তা,বেগুন ভর্তা আর ইলিশ মাছ ভাজা। সাথে ঘন করে ডাল। আশিকের সাথে পরিচয়ের পর থেকে কেন যেন আমার ভর্তা প্রেম বেড়ে গেছে। আশিকের ধারনা ওকে কিলিয়ে ভর্তা বানাতে পারিনা দেখে ভর্তা খেয়েই আমি সুখ পাই। যেভাবে আমাকে যন্ত্রনা দেয়, তেমনটা হলেও হতে পারে।
বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে মাত্র দু গ্রাস মুখে দিলাম,এমন সময় মোবাইলে ওর কল
''এক্ষুনি বের হয়ে নিচে আসো''
''আমি ভাত খাচ্ছি তো,পনের মিনিট পর আসি''
''ভাত সারাজীবন খেতে পারবা,কিন্তু আশিক সারা জীবন নাও থাকতে পারে''
শুরু হল জনাবের নাটক। এই নাটক দেখতে দেখতে আমার জীবন শেষ হয়ে গেল। এতো বড় কথা শোনার পরও আমি সামান্য ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য বসে থাকব,এতটা পাষাণী এখনো হইনি! [আসলে ওর চোখ রাঙ্গানিকে অনেক ভয় পাই]

বের হবার সময় দরজায় বাড়ি খেয়ে,সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া থেকে কোনমতে বেঁচে যখন গেটে এসে দাঁড়িয়েছি। দেখলাম আশিক ওদের গেটের সামনেই আছে,আমাকে দেখে মোবাইলে কল দিল
''গেটের ভেতর দিকে একটা প্যাকেট আছে,ওটা নাও তো''
আমার হাতে দিয়ে গেলে কি হত? আমি আশেপাশে দেখলাম,ধ্যাত কোন প্যাকেটই তো দেখতে পাচ্ছিনা।
আশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল '' তোমাকে নিয়ে যে কি করবো,আরে বাবা তোমার ডান পায়ের কাছে দেখো''
তখন তাকিয়ে দেখলাম একটা বড় প্যাকেট পড়ে আছে। আমি এক হাত দিয়ে নিতে নিতে বললাম ''এটাতে কি?''
''নিজেই দেখনা,আমি কেন বলব?''
আমার মনে হল একটা শাড়ির প্যাকেট।
''শাড়ি কার জন্য?''
''তোমার আম্মুর জন্য। আন্টির হাতে দিও''
''আজব,তুমি দিলেও তো পারতে। আম্মু অনেক খুশী হত ''
''আচ্ছা দিশা,তুমি আসলে কি এতটাই বেকুব? শাড়িটা তোমার জন্য। এটা পড়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে আসো। আমরা আজকে ঘুরতে যাব''
আমাকে বেকুব ডাকার কারনে আমি যে ঝগড়া করবো সেটা সম্ভব হলনা। কারন তার পরের কথাটা শুনে আমি টাশকি খেয়ে গেছি। আমি পড়বো শাড়ি? শাড়ি আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমার অনেক সমস্যা হয় শাড়িতে। আশিক কি পাগল নাকি! ও জানেনা আমি দুই পা হাঁটতে গেলেই উষ্ঠা খাই?
''আশিক,তুমি জানো আমি শাড়ি পড়িনা''
''আজকে পড় প্লিজ? আমার জন্য''
এই তো,ঠিক এই জিনিসটাকে আমি ভয় পাই। ও যদি ঝগড়া করত,আমিও গলার রগ ফুলিয়ে ঝগড়া করতাম। কিন্তু এভাবে যখন ও অনুরোধ করে তখন আমি কিছু বলতে পারিনা। এই ছেলে এটা বুঝে ফেলেছে। বেশী চালাক। এতো বুদ্ধি কোত্থেকে যে পায়!


আমি শাড়ি পড়েছি দেখে আম্মু অনেক খুশী। জেসমিন দেখি আম্মুর চাইতেও বেশী মজা পাচ্ছে। বের হবার সময় ও দরজা বন্ধ করতে আসলো।
''আফা,নায়ক ডাকলে নায়িকার দৌড় দিয়া যাইতেই হইব। ওই যে ওই সিনেমাতে দেখেন নাই। শাকিব খান কি সুন্দর বৃষ্টিতে গান গাইতেসিল,আর নায়িকা ছাতা নিয়া চইলা আসলো? আপনেও গানটা গাইয়েন''
''চুপ'' আমার ধমক শুনে জেসমিনের কথা বন্ধ হলেও সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমি স্পষ্ট শুনলাম ও গুনগুণ করছে
''কি জাদু করেছ বলনা? ঘরে আর থাকা যে হলনা ''

আমি সাবধানে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। আশিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। ও ঠিক আমার শাড়ির সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পড়েছে। কেন যেন এখন আর অতটা খারাপ লাগছে আমার।
''তোমার পেটে এতো প্ল্যান,আগে বলনি কেন?''
''প্ল্যান তো সবে শুরু ম্যাডাম। আর অনেক কিছু  বাকি'' ও আমার হাতটা নিজের হাতে নিল ''আমি থাকতে তোমার সাথে খারাপ কিচ্ছু হবেনা,প্রমিজ। শুভ নববর্ষ ''
নববর্ষের দিনটা সত্যি অনেক ভাল কেটেছিল।





সব লাভ স্টোরিতে কোন না কোন ঝামেলা হয়। কিন্তু আশিক আর আমার বিয়েতে যে কোন বাঁধা আসতে পারে এটা আমার মাথায় আসেইনি। আমাদের দুজনেরই ফ্যামিলি রাজি। জেসিমিনের বাংলা সিনেমার মত পারিবারিক শত্রুতা,মতের অমিল,টাকা পয়সার সমস্যা কোন কিছুই ছিলনা। আশিক আসলে একটু হতাশই ছিল এত সহজে সবাই মেনে নিয়েছে দেখে। জেসমিনের ভালই প্রভাব পড়েছে ওর উপর। ''পালায় বিয়ে করবো'' ''প্রেম মানেনা কোন বাঁধা'' ডায়লগ গুলো কাউকে শোনাতে পারছেনা দেখে ও বেশ হতাশ। তবে বেশী সহজ ভাবলে সরল জিনিসও জটিল হতে সময় লাগেনা। আর যেহেতু এখানে আমি ইনভল্ভড আছি,কিছু তো হতেই হবে।
তাই সমস্যাটা হল সম্পূর্ণ অন্যভাবে।
তখন এঙ্গেজমেন্ট এর কথা হচ্ছে বাসায়। আঙ্কেল চাইছেন এর পরের মাসেই করিয়ে দিতে। দুজনের পড়ালেখা শেষ হলে তারপর বিয়েটা হবে। সবাই রাজী। এ আলোচনা উপলক্ষে আমাদের দুজনেরই আত্মীয় স্বজনের ভালোই সমাগম ঘটছে। বেশ একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। নিপু তো আমার বিয়েতে কি করবে তারও প্ল্যানিং শুরু করে দিয়েছে। সাথে জেসমিনও ওর উর্বর মস্তিষ্কের প্রমান দিচ্ছে। ওর কিছু আইডিয়া তো বরাবরের মতই ভয়ঙ্কর।
একটা ছিল এরকম, পাল্কিতো খুব কমন জিনিস। আমাদের উচিত আনকমন কিছু করা। যেমন আমি যদি ঠেলাগাড়িতে করে হলুদের স্টেজে আসি তাহলে নাকি খুব অন্যরকম লাগবে!
সবচেয়ে ভয়াবহ আইডিয়া ছিল যে,আশিক হাতির পিঠে চড়ে বিয়ে করতে যাবে। আর আমার পক্ষের মেয়েরা সবাই নেচে ওকে স্বাগতম জানাবে।
নাচের জন্য একটা গানও ঠিক করে ফেলেছিল সে,কথা গুলো এরকম

''আসসালামালাইকুম বেয়াই সাব,ওয়ালাইকুম আসসালাম বেয়াইন সাব
কেমন আছেন বেয়াই সাব? বুকে বড় জ্বালা
কিসের জ্বালা বেয়াই সাব? নয়া প্রেমের জ্বালা
এই জ্বালাতে পুড়বে নাকো কোন শালি শালা?''

নিপুর চিল্লাচিল্লি আর আমার থমথমে চেহারা দেখে ও আপাতত ক্ষান্ত দিয়েছে। কিন্তু আমি শিওর ওর মাথায় আরো অনেক কিছু গিজগিজ করছে।
এর মাঝে আশিক জানাল যে ওর দাদীজান আসবে আমাকে দেখতে। আমাকে ভয় দেখানর জন্য নাকি জানিনা,আশিক আমাকে বলেছিল যে ওর দাদীজান নাকি সহজে কাউকে পছন্দ করেননা। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল।


আশিকের দাদীজান এলেন বাসায় আমাকে দেখতে। আমি শাড়ি পড়তে পড়তে যত দোআ জানি সব পড়ে ফেললাম। শাড়ি না পড়লেও হত,কিন্তু মনে হল যে দাদীজান খুশী হবে। এতো ভয় যে কেন লাগছে? এমন কিছু ভয়ঙ্কর কাজ তো না। দাদীজানের সামনে যাব,পা ছুঁয়ে সালাম করবো। আর কিছুক্ষণ কথা বলব। ভয়ের কিছু নেই।
আমি পা টেনে টেনে ড্রয়িং রুমে গেলাম। দাদিজান সোফায় বসে আছেন। উনি আমাকে দেখে একটা হাসি দিলেন। কেন যেন হাসিটা দেখে আমার মনে হল ''তোরে আজকে খাইসি'' টাইপের মনে হল। আমি মনে হয় আসলেই পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আমি সালাম করলাম উনাকে।  আমি বসার পর দাদীজান আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন। কেমন আছ ভাল আছ টাইপের কোন কথা না। এক্কেবারে যাকে বলে ইন্টারভিউ। হাত কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। আরেকটু হলে আমি দাদীজানের গায়ে গরম চায়ের কাপ উল্টে ফেলেই দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস,পানির গ্লাসটা উনার গায়ে না পড়ে সোফায় পড়েছিল।
অনেক প্রশ্ন করলেন তিনি,জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। শেষের দিকে জিজ্ঞেস করলেন
- এর আগে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল?
আমি বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকলাম। এটা কি হল? আশিকের সাথে আমার ব্যাপারটা জেনেও উনি এটা কি বলছেন?

আমি দাদীজান চলে যাওয়ার পর সবার আগে আশিককে কল দিলাম।
-আশিক,তোমার দাদীজান কি জানেনা যে তোমার আমার অ্যাফেয়ার আছে?
-দাদীজান,প্রেমের বিয়ের একদম বিপক্ষে দিশা। সত্যি কথা বললে দাদীজান কখনোই মানবেনা।
-আমরা এমন কোন খারাপ কাজ করিনি। শুধু শুধু মিথ্যা বলে বিয়ে করবো কেন?
-এখানে এতো আপসেট হবার মত কিছুই হয়নি।
-মিথ্যা বলার মত কিছুও হয়নি। প্লিজ আশিক,সবসময় মিথ্যা বলে কাজ হয়না। তোমার দাদীজান আর আমি এক মানুষ না।


এই প্রথম আশিকের সাথে আমার এরকম মারাত্মক ঝগড়া হল।
অনেক তর্ক হল সেদিন রাতে। ও কোনমতেই সত্যি কথা বলবেনা। আমিও নিজের জায়গায় অনড়। মিথ্যা বলে বিয়ে করবনা। শেষরাতের দিকে আমি ওকে বললাম ও যদি না বলে আমিই পরের দিন এসে দাদীজানকে সব জানাবো।
পরেরদিন আমার আর যেতে হলনা। ও বাসা থেকে খবর এল দাদীজান এই বিয়েতে রাজী না। তিনি আরো বলেছেন এই বিয়ে হলে তিনি আশিকদের কারো মুখ দর্শন করবেননা। সত্যি কথা বলতে কি যত টুকু খারাপ লাগা উচিত ছিল ততটুকু লাগেনি। অন্তত মিথ্যা বলার চেয়ে অনেক ভাল। দাদীজান ছাড়া আশিকের ফ্যামিলির এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমি বেঁকে বসলাম।
সবাই হয়ত ভাববে যে আমি বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু আমি যে পরিবারে যাব,তার একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আমাকে মেনে নিবেনা। আমার জন্য একটা ফ্যামিলির মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হবে, এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। আশিক আমাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছিল,কিন্তু আমি ওকে বলে দিলাম আমাকে যাতে ও আর কল না করে। ছোটবেলা থেকে আব্বু আম্মু আমার লাইফের সব সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে দিয়েছেন। সবসময়ের মত এবারো তাঁরা আমাকে সাপোর্ট দিলেন। শুধু নিপু অনেক বিরক্ত হয়ে বলেছে
''আপু,তুই আসলেই অনেক ঢং করিস''






গত কয়েকটা মাস অনেক কষ্টে কেটেছে আমার। এভাবে পালাতে ইচ্ছা হচ্ছে না আর। আশিকের কাছ থেকে দূরে থাকতে আমি আমার ফুপুর বাসায় চলে এসেছি। ওর কল রিসিভ করিনা দেখে ও অনেক পাগলামি শুরু করেছিল। ঘর থেকে বের হলে বা বারান্দায় গেলেই দেখতাম ও ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর চাহুনিটা এতো যন্ত্রণাদায়ক! এদিকে বাসায় নিপু রাগ করে আমার সাথে আর কথাই বলেনা । শেষ পর্যন্ত আব্বু আম্মুকে একটা ব্রেক দরকার বলে ফুপুর বাসায় চলে এলাম।  
বেশ কদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই আমার অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। আর এত্ত খারাপ লাগে!আর দাদীজানের উপর রাগ লাগে। প্রেম করে বিয়ে করলে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? দুপুরের দিকে আজকে যখন ঝুম বৃষ্টি নামলো আমি আর ঘরে থাকতে পারলাম না। ফুপুরা সবাই ঘুমুচ্ছে। আমি কাজের মেয়েটাকে দরজা লাগাতে বলে বের হয়ে গেলাম ছাতা হাতে।
প্রথমে ভেবেছিলাম রিক্সায় একা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াব। কিন্তু বৃষ্টিও এক নাম্বারের বেইমান। আমি বের হবার পর একদমই কমে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয়না,পাশেই একটা পার্ক আছে। সেখানে গিয়ে ঢুকলাম। ছাতাটা ফোল্ড করে ফেলেছি। দরকার হলে এই ফকিরা বৃষ্টিতেই ভিজব।
হালকা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছি,তবু অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে ।পুরো শরীরে কেমন এক অদ্ভুত দুঃখ মেশানো  সুখ সুখ অনুভুতি হচ্ছে। আগে মনে হত একা একা ভিজতে ভাল লাগবেনা। কথাটা আসলে সত্যি না। মানুষ কখনও একা থাকে না,মস্তিষ্কের ধূসর কোষের জমিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো সব সময় কলরব করতে থাকে।
আমার মন বলছে বৃষ্টি আরো জোরে পড়ুক,সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাক।
আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আমি চোখ বন্ধ করে গুনগুণ করলাম

''মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি,বকুলের তলায়
হায় মাঝে হল ছাড়া ছাড়ি,গেলেম কে কোথায়
আবার দেখা যদি হল সখা,প্রানের মাঝে আয়
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
ও সে চোখের দেখা প্রানের কথা, সে কি ভোলা যায় ………''


পেছন থেকে আওয়াজ শোনা গেল
''কার যেন বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগে? আজকে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে একেবারে গান গাওয়া হচ্ছে! ঠাণ্ডা কোথায় গেল?''
আমি চোখ খুলে দেখলাম আশিক। আমি তেমন অবাক হলামনা। ও আসবে আমি জানতাম।
''কোথায় যেন পড়েছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাঁদলেও নাকি চোখের পানি বোঝা যায় না,পুরাই ভুয়া কথা...কান্না করার সময় চোখ লাল হয়ে ছোট ছোট হয়ে যায়,যেমন এখন তোমারটা হয়েছে। নাকি তোমার মত কানাদেরই শুধু এমন হয়?'' সর্বনাশ,আমি কি কাঁদছিলাম নাকি?
''এখানে কেন এসেছ?'' বলতে বলতে ওকে দেখছিলাম। কত্ত দিন পর দেখা হল !
''হাহ্,আমাকে ছেড়ে আসা এতো সহজ না। তুমি যদি জাহান্নামেও লুকাও আমি ঠিকই খুজে বের করবো''
''সবসময় নিজেকে এত গুরুত্ত দাও কেন? আমি এখানে ঘুরতে এসেছি''
''আমিও ঘুরতেই এলাম,এসে দেখলাম এই পিঁপড়া মার্কা বৃষ্টিতে একজন মহা সূখে গান গাচ্ছে। এতো মধুর গলা শুনে ভাবলাম সুকণ্ঠী গায়িকাকে একটু দেখে যাই''
আমার ওর এই দার্শনিক হাবভাব দেখতে একদমই ভাল লাগছিলনা। অনেক ক্লান্ত লাগল হঠাৎ
''তোমার কথা শেষ ? আমি এখন যাব''
''এতো সহজ? যেতে চাইলেই যেতে দিব নাকি?''
বলে হাতটা ধরে ফেলল আশিক।
''হাত ছাড়ো আমার''
'ছাড়ার জন্য তো ধরিনি আমি,চল আমরা দুজন মিলে গাই
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
ও সে চোখের দেখা প্রানের কথা, সে কি ভোলা যায়...''
আশিক মাথা দুলিয়ে গান গাচ্ছে। অবিশ্বাস্য! এই পরিস্থিতিতেও ওর এসব করতে ইচ্ছা কিভাবে হয়?
আমার তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
''আশিক,প্লিজ আর নাটক দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না'
''নাটক এখনো শুরুই হয়নি,শুরু হলে তখন কি করবা?''
''তুমি খুব ভালভাবে জানো তোমার দাদী আমাকে পছন্দ করেননা,তো এসব করে লাভ কি?''
''বিয়ে তো করবো আমি,দাদীর পছন্দ দিয়ে কি হবে?''
আমি হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। এমনিতে দেখতে হালকা পাতলা হলেও ওর হাতে অনেক জোর। ও হাসিমুখে আমার হাত টানাটানি দেখছে। আমি ঠিক করলাম এবার না ছাড়লে একটা খামচি দিব।
''বাই দা ওয়ে,তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছিলাম। আমার দাদীজান বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে''
কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি জমে গেলাম। আশিক বলেই যাচ্ছে
''একটু নাটক করতে হয়েছে অবশ্য। ওটা আমি ভালই পারি। যখন দেখলাম কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। তখন বেশী কিছুনা,খাওয়া আর কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ৩ দিনের দিন দাদী এসে বলল যে 'বাপ তোর যাকে ইচ্ছা বিয়ে কর। আমি কিছু বলবনা ' তিন দিন ধরে না খাওয়া আমি এখন অনেক ক্ষুদার্ত। আমার পেটে এখন ইদুর ডিস্কো ডান্স দিচ্ছে। আর কিছু না পেলে এখন ঘাস খাওয়া শুরু করে দিব। তার আগেই  চলতো দেখি সামনের হোটেলটায় কিছু পাওয়া যায় নাকি''


হোটেলে বসে আশিক মহানন্দে ভাত খাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে কিছু খায়নি।  আমি প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছি।
''খাচ্ছনা কেন?''
''তুমি খাও তো,আমি দেখি''
''আচ্ছা আমি খাইয়ে দে০ই''
ও এক গ্রাস ভাত নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। অন্য কোন সময় হলে আমি কখনোই এতো গুলো মানুষের সামনে এটা করতাম না। আমার আবার লজ্জা বেশী। কিন্তু আজকে খেলাম। 
আমি ঠিক জানিনা এরকম বেহায়া হবার কারন কি,কারন এটা আশিকের একান্ত ব্যাক্তিগত টাইটেল! কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি আর কিছু ভাবতে পারিনি। আসলেইতো,ওকে ছাড়া আমি ভাল থাকব না। এটা ও আগে থেকেই জানতো,আজকে আমিও জানলাম।





অতঃপর-

বিয়ের বাদ্য বাজল শেষে
ও বর,আমি বধুর বেশে...

আশিকের বুদ্ধিতে এঙ্গেজমেন্ট না হয়ে সরাসরি বিয়ে হচ্ছে। আমি বলেছিলাম ওকে যে এতো তাড়াহুড়োর কি দরকার?ও জবাবে বলেছে
''তুমি তো মহাত্মা গান্ধীর লেটেস্ট ফিমেল ভার্শন, দেখা যাবে আবার কে এসে কি বলবে আর তুমি মহামানবীর মত বিয়েটা ভেঙ্গে দিবা। তোমাকে নিয়ে রিস্ক নিব,মাথা খারাপ নাকি? তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা সবাইকে মানানোর জন্য আমি যদি না খেয়ে থাকা শুরু করি তাহলে একবছর পর আমি না,আমার কংকালকে বিয়ে করতে হবে''
''সব কিছুতে ফাজলামি না করলে হয়না?''
''ফাজলামি কই করলাম? সবসময় শুনে আসলাম মেয়েরা নাকি জলদি বিয়ে করতে চায়। তোমার বেলাতেই যত উলটা পুরাণ! শুনো,তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবোনা। আর আমাকে ছাড়া তোমাকে আমি থাকতে দিবনা। তুমি এঙ্গেজড হয়েই আছ। তো আর এসবের কি দরকার? আমাকে ফেলে একবার তো পালিয়েছ। এবার নাহয় আমার সাথেই ভাগবা?'' এইকথার পর আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আবেগপ্রবন হয়ে কেঁদেই দিলাম। এই ছেলেটা এতো ভাল কেন?
''এই মেয়ে কাঁদো কেন? আরে এগুলাতো এম্নিতেই ডায়লগ দিলাম। আউচ...এই তোমার বাসায় নেইল কাটার নাই নাকি? এত্ত বড় নখ!!!''


বিয়ের দিন আমার পাশে বসে আশিক যখন বসেছিল আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারিনি যে আসলেই আমাদের বিয়েটা হচ্ছে। আশিক সারাক্ষণ প্যানপ্যান করছিলো ''ভেবে দেখলাম তোমাকে বিয়ে না করলে অনেক সমস্যা। সারা জীবন তোমাকে ঝামেলার হাত থেকে আমি ছাড়া আর কে বাঁচাতে পারবে বল দেখি,কার এত আজাইরা টাইম আছে?''
শুধু এটাই না,যখনি কেউ আমাদের শুভেচ্ছা দিতে আসছে বদমাশ ছেলেটা তাদের বলছে ''আমার বৌ চোখে ঠিকমত দেখেনা কিন্তু,আছাড় খেয়ে আপনাদের গায়ে পড়লে মাফ করে দিবেন''
শেষের দিকে জেসমিনের হাউমাউ কান্না দেখে আমি লজ্জায় একশেষ। আশ্চর্যজনক কথা হল আমি কাঁদব কি,খুশীর চোটে কান্না কান্না ভাবও আনতে পারছিনা। আশিক বলতে লাগল
''জেসমিনের থেকে কিছু শিখতে পারলেনা? ওর কান্না দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা ওর,তোমার না। এমনিতে কিছু হলেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদো। আজকে একটুও কাঁদলানা...ছ্যাঃ ছ্যাঃ...সবাই বলবে কেমন বেহায়া বৌ!...আমার সব মান সম্মান ধুলায় মিশে গেল''
অন্য কোন দিন হলে ওর পিঠে ধুম ধাম কিল মেরে দিতাম। কিন্তু এবারের মত ছেড়ে দিলাম। আজকে আমি একটুও রাগ করবনা। সারা জীবন পড়ে আছে শোধ নেবার জন্য। আজকের দিনটা আমার ভেটকি মাছটা এভাবে বলে যাক।




পুনশ্চ-
জেসমিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওর মতে ওর হবু জামাই নাকি একদম শাকিব খানের মত মাসুম! আমার বিয়েতে ও এমন হাউমাউ করে কেঁদেছে কেন জিজ্ঞেস করেছিলাম।ও নাকি প্র্যাকটিস করছিল যাতে নিজের বিয়েতে ভালভাবে কাঁদতে পারে। আমার মত দাঁত বের করে হাসলে ওর ''প্রেস্টিজ পাঞ্চার'' হয়ে যাবে না?


পৃথিবীর সব ভেটকি মাছ(!!) আর কানা বেড়ালের জন্য অনেক ভালবাসা...

 


 

 

 





Share this article :

0 comments :

Contact Form

Name

Email *

Message *

 

About Author

Recent Comments